ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ভাষার মাসে আশা

প্রকাশিত: ০৪:১২ এএম, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আবার এলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। মহান ভাষা আন্দোলনের মাস বলে এই ফেব্রুয়ারি মাসটি আমাদের কাছে অনেক শ্রদ্ধার, অনেক সমীহের। সীমাহীন ভক্তি আর ভাবগাম্ভীর্য মিশ্রিত আনন্দের কিন্তু এর পটভূমি বেদনার অশ্রুসিক্ত লোনাজলে ভেজা। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের কবল থেকে বাংলা ভাষার মুক্তি অর্জনে লেগেছে আন্দোলন,  লেগেছে মানবরক্তের স্রোতধারা। বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা ও মাতৃভাষা চর্চার আবেগ আর মুগ্ধতা নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাস আসে ক্যালেন্ডারের পাতা জুড়ে। বাংলাদেশে একুশ এসেছিল বলে আজ বিশ্বের নানা প্রান্তে, নানা জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা একুশের চেতনায় মন্দ্রিত হয়ে তাদের স্ব-স্ব মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত হতে পেরেছে। মানবসমাজে প্রচলিত প্রধান প্রধান ভাষাসমূহের পাশাপাশি পৃথিবীর সকল নৃগোষ্ঠীর জাতিগত ভাষার যেন বিলুপ্তি না ঘটে আমরা সে বিষয়টিও একুশের প্রেরণা থেকে সঞ্চয় করেছি। বহুজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাতৃভাষাকে রক্ষার মাধ্যমেই আমরা যে একটি সভ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে পারবো সে ভাবনাটাও আমাদের মহান একুশ থেকেই উৎসারিত হয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছে। এভাবে আমাদের ফেব্রুয়ারি, আমাদের একুশ হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক ভাষা সুরক্ষার প্রেরণা হিসেবে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

বাঙালি হিসেবে আবেগের তরঙ্গে ফেব্রুয়ারির সারাটি মাস আমরা ভেসে বেড়াই একুশের চেতনা বুকের গভীরে লালন করে। একুশের চেতনার অন্তর্নিহিত বিষয়ের মধ্যে এখনো আমরা বিশ্বাস করি স্বাজাত্যবোধের তীব্রতার কথা, বিশ্বাস করি বাঙালিত্বের মৌলিক কিছু সূচক-চিহ্নের কথাও। যেসব প্রেরণা আর প্রণোদনা বক্ষে ধারণ করে সালাম, রফিক বরকত, জব্বার, শফিউরসহ আরো অনেকে নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে পাকিস্তানি শাসকের নিষ্ঠুর বন্দুকের গুলি বক্ষে ধারণপূর্বক অপরিণত বয়সে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে আমাদেরকে এবং সর্বকালের বাঙালির উত্তর-প্রজন্মকে মধুময় মাতৃভাষায় কথার বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। ইতিহাস তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের কথা মনে রেখেছে। ইতিহাস সেসব বীর সন্তানদের স্বাজাত্যবোধ, দেশপ্রেম এবং মায়ের মুখের ভাষার প্রতি অপরিসীম সংগ্রামী চরিত্রকে আমাদের সম্মুখে হাজির করে দিয়েছে। আমরা সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসের প্রতি অবনত মস্তকে সম্মান জানাই- যারা এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন শ্রদ্ধা জানাই সেইসব শহীদদেরকেও।

কিন্তু এই সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ ইতিহাস নিয়ে আমরা এখন এক দুঃসময়ের মধ্যে বসবাস করছি। সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ ইতিহাস নিয়ে কোনো কোনো মহলে সংশয় ও বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে একের পর এক। তাই আমরা আতঙ্কিত হই এই ভেবে যে, বলা যায় না, ইতিহাসের পক্ষে এই সত্য কতদিন টিকিয়ে সম্ভব হবে! সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরও নির্বুদ্ধিতা নিয়ে বিএনপি-জামায়াত বিশেষত বিএনপি যে মাত্রাতিরিক্ত মাতলামো আরম্ভ করেছে তাতে সন্দেহ জাগে যে, কবে যেন তারা হঠাৎ কোনো একদিন সকালে ভাষা আন্দোলনের নূতন কোনো ইতিহাস নিয়ে হাজির হয়ে যান! শুধু ইতিহাসের বিকৃতি নয়, দেখা যাবে বিএনপির ‘থিংক ট্যাংক’ থেকে মহান ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নূতন নূতন উদ্ভট ও অদ্ভূত তত্ত্ব নির্গত হওয়া শুরু করেছে! বিএনপির থিংক ট্যাংকারগণ এসব নিয়ে হয়তো গভীর জলে ডুবে আছে এখন। মোক্ষম সময়ে এবিষয়েও তাদের শক্তিশালী বোমা হয়ত যেকোনো সময়ই বিস্ফোরিত হবে। সেই বিস্ফোরণজাত শব্দ থেকে সাধারণ কিছু মানুষের মধ্যে হয়তোবা ক্ষণিকের কিছু দোদুল্যমানতাও তৈরি হবে। শহীদের সংখ্যা নিয়ে, বুদ্ধিজীবীদের নির্বুদ্ধিতা ( !)নিয়ে বিএনপি-জামায়াত একের পর এক যেসব বোমা ফাটিয়ে ফাটিয়ে যাচ্ছে একদিন এসব বোমার অগ্নিতাণ্ডবে হয়ত বিএনপি-জামায়াতই পুড়ে ছাই হবে, এটি দুরাশা নয়।

আমরা দেখছি বিএনপির মধ্যে এখন কিছুসংখ্যক অতি উৎসাহী ব্যক্তির সরব মুখরতা। মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদের সংখ্যা, বুদ্ধিজীবীদের নির্বুদ্ধিতা প্রভৃতি বিষয়ক অদ্ভুত বোমা নিক্ষেপের কারণে দলটির কিছু কিছু নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ মানুষ থু থু ছিটিয়েছে। সংশয় জাগে, এসব উৎসাহী ব্যক্তিদের মাধ্যমেও ভাষাতত্ত্ব নিয়ে কিংবা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়েও নবোদ্ভূত প্রায় অনুরূপ ঘটনার প্রকাশ হয়তো ঘটে যেতে পারে।

১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন সামরিক ও স্বৈরশাসনের বলয়ে আবদ্ধ জাতি মিথ্যা ইতিহাসের কুহকে আবৃত থাকায় ‘প্রকৃত ইতিহাস’ যেন জাতিকেই পরাস্ত করেছিল। সামরিক রক্ত ও অগ্নিচক্ষুর কারণে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়েই ভ্রান্ত ইতিহাসের চোরাগলিতে নিজেদের সমর্পণও করেছিল। কিন্তু সত্য বেশি দিন চাপা থকে না।

প্রকৃত ইতিহাস আর জাতীয় আবেগ হাত ধরাধরি করে প্রজন্মান্তরে উত্তর পুরুষেও বাহিত করে চলে আমাদের চিন্তা ও চেতনার মগ্নতার সুর লালিত্য। তাই একুশ সর্বকালীন বাঙালি তথা বিশ্বের সকল জাতি গোষ্ঠীর মাতৃ-ভাষাভাষি মানুষের প্রেরণার এক নির্ভার আশ্রয়।

কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমরা আবার দেখি যে, আমাদের যত আবেগ আর উষ্ণতা তা কেবলই ফেব্রুয়ারি মাসের এই ২৮টি দিনের মধ্যে, কখনো আবার লিপ-ইয়ারের কল্যাণে ২৯টি দিনের মধ্যেই আবদ্ধ সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। চিন্তা বলি, চেতনা বলি কিংবা মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ইত্যাদি যাই বলি না কেন উত্তর-ফেব্রুয়ারির বাদ বাকি এগারোটি মাস আমাদের ঠিক এমন আবেগ থাকে না। কেমন যেন কুঁকড়ে যায় আমাদের যাবতীয় আবেগ ও অনুভূতি।

মহান একুশকে আশ্রয় করে প্রতি বছর অনুষ্ঠেয় মাসব্যাপী বই মেলার শুরুর দিন অন্তত রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু বৎসরান্তের হিসেব পুনরাপি সেই শূন্যের কোঠায়! অর্থাৎ একদিকে রাষ্ট্রীয় আদেশ যেমন জারি হয় অন্যদিকে চলে রাষ্ট্রীয়  নির্দেশনা অমান্যেরও মহোৎসব। এভাবেই আমরা ভাষা শহীদদের রক্তের সঙ্গে অনবরত অভিনীত প্রহসনে লিপ্ত হই। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের’ রাষ্ট্রীয় আদেশের এই একটি কথা প্রতি বছরই শুনে শুনে আসছি; কিন্তু কার্যত তেমন ফলপ্রসূ উদ্যোগ লক্ষ করছি না। আর, উল্টো দিকের বাস্তবতা হলো সরকার নিজেও তার রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের যাবতীয় নথিপত্র, অফিস আদেশ, বিচার বিভাগের আইনি বিষয়-আশয় এমনকি মামলার রায় প্রকাশেও বাংলা ভাষা ব্যবহারে অনীহা আজ সর্বজন বিদিত। তবে, কেন কেবল সাধারণ সমাজে বাংলা ভাষার প্রবর্তন নিয়ে এত কথা, বক্তৃতা ভাষণ তা আমাদের বোধগম্য হয়ে ওঠে না। রাষ্ট্রের শুধু নির্বাহী বিভাগ বা বিচার বিভাগই নয় শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান, আইন ও চিকিৎসা বিষয়ক বইপুস্তকের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এখন পর্যন্ত শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিষয়ক বইপুস্তকের যথাযথ অনুবাদকর্ম সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা সামগ্রিক অর্থে গতিশীল করে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। আর কতোদিন আমাদেরকে মাতৃভাষার প্রতি এই অবজ্ঞা দেখে দেখে যেতে হবে কে জানে!

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন