চীনে গরম: শেষ হয়েও হয় না যখন শেষ
‘মেঘের অনেক রং’—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। নামটা মনে আছে আজও। খুব ছোটবেলার কথা। দেখা হয়নি মনে হয়। আর দেখা হলেও গল্পটি মনে নেই। যতদূর জানি, ১৯৭৬ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল; সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল। আমার আজকের লেখা চলচ্চিত্র নিয়ে নয় অবশ্যই। তবে, লেখার শুরুতে ‘মেঘ’ নিয়ে দুটি কথা বলতে যাবো যখন, ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল চলচ্চিত্রটির নাম।
আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ভাসমান অতি ক্ষুদ্র জলকণার সমষ্টিকে ‘মেঘ’ বলে। বাংলা ভাষায় ‘মেঘ’ শব্দটির বেশ কয়েকটি সমার্থক শব্দ রয়েছে। তেমন কয়েকটি সমার্থক শব্দ হচ্ছে: কাদম্বিনী, জলদ, বারিদ, জলধর, নীরধর, নীরদ, অভ্র, পয়োধর, অম্বুধর, ঘন। আকাশে কীভাবে মেঘের সৃষ্টি হয়? সে এক জটিল প্রক্রিয়া। তবে সহজ করে বলার চেষ্টা করি।
জলীয় বাষ্পপূর্ণ হালকা বায়ু ক্রমশ উপরে উঠলে, অতিরিক্ত শীতলতার সংস্পর্শে সম্পৃক্ত হয়। এই সম্পৃক্ত বায়ুর তাপমাত্রা শিশিরাঙ্কের নিচে নেমে গেলে, ঘনীভবনের ফলে, অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা ও তুষারকণায় রূপান্তরিত হয়। আর বায়ুতে ভাসমান ধূলিকণা, কয়লাকণা, ইত্যাদিকে আশ্রয় করে এই সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা ও তুষারকণা আকাশে ভেসে বেড়ায়। এগুলোই হচ্ছে মেঘ।
আকাশে বিভিন্ন আকৃতির, বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন প্রকৃতির মেঘের সৌন্দর্য উপভোগ করেননি, এমন চক্ষুওয়ালা মানুষ পাওয়া কঠিন। শুধু চলচ্চিত্রের নামেই নয়, বাস্তবেও মেঘের অনেক রঙ। এই রঙ দেখে কবিরা তো আপ্লুত হনই, সাধারণ মানুষও হন উদ্বেলিত। ছোটবেলায় অবাক হয়ে আকাশে মেঘের ভাঙাগড়া দেখতাম। মেঘ ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়, রূপ বদলায়। কখনও কখনও মেঘ বিভিন্ন প্রাণির আকৃতি ধারণ করে বা অন্যভাবে বললে, মানুষ মেঘের আকৃতির মধ্যে কোনো বিশেষ প্রাণীর আদল খুঁজে নেয়।
সাধারণ মানুষ যেখানে শুধু মেঘের সৌন্দর্যসুধা পান করেই ক্ষান্ত হয়, সেখানে বিজ্ঞানীরা মেঘের বিভিন্ন আকার-আকৃতির কার্যকারণ খুঁজে বের করেন। মেঘের শ্রেণীবিভাগও করেছেন তাঁরা। কাজটা যদিও সহজ নয়। কারণ, ক্ষণে ক্ষণে মেঘের চরিত্র বদলায়। অনেক সময় অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরির মেঘ একসঙ্গে মিলেমিশে আকাশে ভেসে বেড়ায়। তখন তাকে কোনো নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে ফেলা মুশকিলই বটে।
তারপরও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের মেঘ-কে মোটা দাগে দু’ভাগে ভাগ করেছেন: ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মেঘের উচ্চতা অনুসারে, এবং আকৃতি ও চেহারা অনুসারে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা অনুসারে মেঘ আবার তিন ধরনের: নিচু মেঘ (২১৩৫ মিটার); মাঝারি উঁচু মেঘ (২১৩৬ থেকে ৬০৯৭ মিটার); এবং উঁচু মেঘ (৬০৯৮ থেকে ১২৩৫০ মিটার)। এদিকে, আকৃতি ও চেহারা অনুসারে মেঘকে মোটামুটি ৪ ভাগ করা হয়েছে: সিরুস (cirrus) বা অলক মেঘ; স্ট্রাটাস (stratus) বা স্তর মেঘ; কিউমিউলাস (cumulus) বা স্তুপ মেঘ; এবং নিম্বস (nimbos) বা নীরদ মেঘ বা বাদল মেঘ।
মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। কীভাবে হয় সেটা আমরা জানি। বৃষ্টি কখন হবে, কতোটুকু হবে, কতোক্ষণ স্থায়ী হবে—ইত্যাদি নানান প্রশ্নের উত্তর বলতে গেলে নিখুঁতভাবেই আধুনিক আবহাওয়া অফিসগুলো দিতে পারে। কিন্তু প্রাচীন কালে বিজ্ঞান উন্নত ছিল না। প্রকৃতির অনেককিছুর মতো মেঘ নিয়েও ছিল তখন নানান ধারণা-অনুমান বা পৌরাণিক বিশ্বাস প্রচলিত। প্রাচীন অ্যাকাডিয়ানদের (Akkadians) কথাই ধরুন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, মেঘ হচ্ছে আকাশের দেবী অ্যান্টু-র (Antu) স্তন এবং বৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে নির্গত দুগ্ধ।
প্রাচীন গ্রিসের কমেডি লেখক অ্যারিস্টোফ্যানিস (Aristophanes) লিখেছিলেন কমেডি নাটক ‘দা ক্লাউডস’ (The Clouds)। যীশুর জন্মের ৪২৩ বছর আগে নাটকটি প্রথম এথেন্সে মঞ্চস্থ হয়। তো, নাটকের অন্যতম মূল চরিত্র দার্শনিক সক্রেটিসকে দিয়ে নাট্যকার একটি মজার তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তত্ত্বটি এমন: মেঘ হচ্ছে একমাত্র ঈশ্বর; শুধু মেঘের উপাসনা করাই বিধেয়, অন্যকিছুর নয়! নাটকে আরেকটি কথা বলা হয়েছে: মেঘের দিকে যে-ব্যক্তি তাকাবে, মেঘ সে-ব্যক্তির প্রকৃত চরিত্রের বাহ্যিক রূপ ধারণ করবে।
চীনে মেঘ হচ্ছে সৌভাগ্য ও সুখের প্রতীক। মেঘের উপর যখন মেঘ জমে, তখন তা হয় অধিক সৌভাগ্যের। আর মেঘে যখন রঙ ধরে, তখন তাকে গণ্য করা হয় ‘চরম সৌভাগ্যের বার্তাবহ’ হিসেবে। চীনারা তাই প্রাচীনকাল থেকেই আগ্রহ নিয়ে আকাশের দিকে তাকায়, মেঘ দেখে। আজকাল তাঁরা মেঘ দেখার পাশাপাশি, স্মার্টফোনে মেঘযুক্ত আকাশের ছবি তোলে। তবে, চীনে আয়েস করে মেঘ দেখার একটা নির্ধারিত সময়কালও আছে। আর সেটা হচ্ছে চতুর্দশ সৌরপদ ‘ছুশু’ বা ‘গরমের শেষ’।
চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদে (সোলার টার্মস)। প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। ২২ অগাস্ট চীনে চতুর্দশ সৌরপদ ‘ছুশু’-র শুরু, শেষ ৫ সেপ্টেম্বর।
নামে ‘ছুশু’ বা ‘গরমের শেষ’ হলেও, এই সৌরপদে চীনের সর্বত্র গরম আসলে শেষ হয়েও হয় না শেষ। এবার চীনে ভীষণ গরম পড়েছে; কোনো কোনো জায়গায় তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করেছে। তাই, ‘ছুশু’ সৌরপদ যদি তার প্রকৃত চরিত্র নিয়ে হাজির হয়, তবে সেটা হবে স্বস্তির বিষয়। কিন্তু বাস্তবে, দক্ষিণ চীনে এই সৌরপদেও সাধারণত গরম আবহাওয়া বিরাজ করে। বেইজিংসহ উত্তরাঞ্চলের কথা আলাদা। এ সময় উত্তরাঞ্চলে ধীরে ধীরে গরম কমতে থাকে, শরতের হাওয়া লাগতে থাকে গায়ে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, শরতের হাওয়া বয়ে নিয়ে আসে ‘শরতের ক্লান্তি’! চীনে একটি কথা প্রচলিত আছে: ‘মানুষ বসন্তে নিদ্রালু হয়, গ্রীষ্মে ঝিমায়, এবং শরতে হয় পরিশ্রান্ত।’ শরতের আগমনে গরম কমে, আর গরম কমলে মানুষ অবসন্ন ও পরিশ্রান্ত অনুভব করে। একেই বলে ‘শরতের ক্লান্তি’। গ্রীষ্মে মানুষকে প্রচণ্ড তাপদাহ সহ্য করতে হয়। শরতের আগমনে যখন শরীর খানিকটা শীতলতার স্পর্শ পায়, তখন সে হঠাৎ হয়ে ওঠে ক্লান্ত। অনেক পরিশ্রমের পর যেমন আমাদের ‘শরীর ছেড়ে দেয়’—অনেকটা তেমন। সে তখন খানিকটা বিশ্রাম চায়। তাই ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিত্সাব্যবস্থা অনুসারে, এই সৌরপদে প্রচুর ঘুমাতে হবে, শরীরচর্চা কমিয়ে দিতে হবে, এবং ঘরের টবে কিছু গাছ-গাছালি রাখতে হবে। গাছ-গাছালি থেকে আসবে অতিরিক্ত অক্সিজেন।
ছুশু সৌরপদে চীনে রহস্যময় ফুল সিরিয়াস (Cereus) ফোটে। ‘সিরিয়াস’ শব্দটি এসেছে গ্রিক ‘কিরস’ থেকে, যার অর্থ ‘মোম’, ‘মশাল’, বা ‘মোমবাতি’। এই ফুল বড় ও ফানেলাকৃতির; লম্বায় ৯ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। রঙ হয় সাধারণত সাদা। তবে, গোলাপী, বেগুনী, হলুদ, সবুজাভও হতে পারে। এ ফুলের উত্পত্তি দক্ষিণ আমেরিকায়। চীনে ছুশু সৌরপদে এ ফুল ফোটার কারণ, তখন দিন গরম ও রাত তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা হয়; অনেকটা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমির পরিবেশের মতো। এ ফুল ফোটেও রাতে; দিনের সূর্যকে এড়িয়ে চলার জন্য। চীনাদের অনেকেই এই ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
‘বেইজিং ডাক’ টার্মটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। যারা বেইজিংয়ে বেড়াতে আসেন, তাঁরা ‘বেইজিং রোস্ট ডাক’ চেখে দেখবেনই দেখবেন। চীনারা ডাক বা হাঁসের মাংস পছন্দ করে। চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সাব্যবস্থা অনুসারে, হাঁসের মাংসে সুন্দর গন্ধ আছে এবং এর প্রকৃতি ঠাণ্ডা। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা প্রথা অনুসারে, চীনারা ছুশু সৌরপদে হাঁসের মাংস খেয়ে থাকে। আজও সেই প্রথা প্রচলিত আছে। আজও চীনারা এই সৌরপদে হাঁসের রোস্ট, লেবু দিয়ে রান্না করা হাঁসের মাংস, আখরোট দিয়ে ড্রেসিং করা স্মোকড হাঁসের মাংস, আদার অঙ্কুর দিয়ে ভাজা হাঁসের মাংস, ইত্যাদি খেয়ে থাকে।
চীনে ছুশু সৌরপদ জেলেদের জন্য স্বর্গসময়। চ্যচিয়াং প্রদেশের পূর্ব চীন সাগরে উপকূলরেখা বরাবর অঞ্চলগুলোতে এ সময় ‘মাছ ধরা উৎসব’ পালিত হয়। এ সময় জেলেদের জালে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। চীনারা তখন বিভিন্ন ধরনের সিফুড থেকে বাছাই করে নিজেদের পছন্দের খাবার খেতে পারেন। আর সিফুড চীনাদের প্রিয় খাবার।
শুরুতে মেঘ নিয়ে বলছিলাম। ছুশু সৌরপদে গরম কমে আসে, আকাশ হয় তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার। এ সময় আকাশে বিভিন্ন ধরনের মেঘের আনাগোনা দেখা যায়। চীনারা সৌভাগ্য ও সুখের প্রতীক মেঘ দেখে আয়োজন করে। চীনের প্রাচীন প্রবাদ অনুসারে, চান্দ্রপঞ্জিকার সপ্তম ও অষ্টম মাসে আকাশে বিভিন্ন আকৃতির ও রঙের মেঘ জমে। সেই মেঘ উপভোগ করা উচিত। আমরা যারা বেইজিংয়ে থাকি, তাঁরা সেটা করছিও। আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখতে সেই ছোটবেলায় যেমন লাগতো, এখনও ঠিক তেমনি লাগে। পরিষ্কার নীল আকাশে ‘সাদা মেঘের ভেলা’-র যে সৌন্দর্য, তার তুলনা হয় না।
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস