ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নেপথ্যে থেকেও যেভাবে বঙ্গমাতা হলেন রেণু

ফরিদুন্নাহার লাইলী | প্রকাশিত: ০১:১২ পিএম, ০৮ আগস্ট ২০২২

মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব বেঁচে থাকলে আজ ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ঘাতক দলের বুলেটে প্রাণ হারান তিনি। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যেসব কর্ম করে গেছেন তা পথচলার ক্ষেত্রে আমাদের আদর্শ। তাঁর কর্ম ও আদর্শে তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন বাংলার ঘরে ঘরে। ৯২তম জন্মবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতির পিতাকে আজন্ম অনুপ্রেরণা দিয়ে এগিয়ে নেওয়া এই মহিয়সী জননীর প্রতি।

রাজনীতির মাঠে না থেকেও তিনি নেপথ্যে নিভৃতে ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ১৪ বছর বঙ্গবন্ধুকে কারাগারেই কাটাতে হয়েছে। এ সময়গুলোতে শত সংকট মোকাবেলা করেছেন। জেলখানায় দেখা করে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের ঘটনা বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সেই নির্দেশ জানাতেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ বাঁচিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। কারাগারে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুকে মনোবল দৃঢ় রাখার সাহস দিতেন। ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুস্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনেও তিনি নীরবে নিভৃতে কাজ করেছেন।

প্রবল স্মৃতিশক্তির অধিকারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে ‘জীবন্ত ডায়েরির’ সঙ্গে তুলনা করতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রিয়তমা সহধর্মিণীকে ডাকতেন রেণু নামে। এই মহিয়সী নারী শুধু বঙ্গবন্ধুর অফুরান প্রেরণার উৎস ও নির্ভীক সহযাত্রীই ছিলেন না। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির প্রতিটি মুক্তি সংগ্রাম ও সংকটে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুস্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনেও তিনি নীরবে নিভৃতে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি দুর্বিপাকে পরিস্থিতি সামলে গেছেন সাহসের সঙ্গে। এভাবে রেণু থেকে হয়ে উঠেন বঙ্গমাতা।
তিনি একদিকে যেমন সাধারণ একজন বাঙালি নারীর মতো স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে তখন তার অবর্তমানে মামলা পরিচালনা, দলকে সংগঠিত, আন্দোলন পরিচালনাসহ প্রতিটি কাজে নেপথ্যে থেকে সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অনিশ্চিত এ সময়ে অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন।

স্বামীকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন। এই অবস্থায়ও হারাননি মনোবল। নেপথ্যে থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদ ও হুমকি সত্ত্বেও ছিলেন অকুতোভয়। গভীর অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মাঝেও এ সময়টা মোকাবিলা করেছেন। এজন্য আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বঙ্গবন্ধু যে পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন, শেখ ফজিলাতুন্নেছাও একই পরিবেশে বড় হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই মুজিবের আদর্শ, তার সহজাত মানসিকতা, সাহস ও আত্মবিশ্বাসী সত্তা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। সেই কিশোরী বয়স থেকে সকল ক্ষেত্রে স্বামী মুজিবকে সমর্থন করে গেছেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকে তিনি প্রশ্নহীনভাবে সমর্থন দিয়েছেন, মনোবল ও সাহস জুগিয়েছেন, অপরিসীম প্রেরণা জুগিয়েছেন। এর সবই তিনি করে গেছেন একান্ত নিভৃতে থেকে। তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণ, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল নারী। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তাঁর প্রভাব ছিল অপরিসীম। অসমাপ্ত আত্মজীবনী লেখার পেছনে স্বামীকে মূল প্রেরণা ও উৎসাহ তাঁরই।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’গ্রন্থে বঙ্গমাতার প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেণু আমার সব দুঃখ কষ্ট, অভাব-অনটন, কারাবরণ হাসিমুখে মেনে নিতে না পারলে আমি বঙ্গবন্ধু হতে পারতাম না।’ এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনেও অনেক অবদান এই মহিয়সী নারীর। তিনি জীবনভর বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সংসারের দায়িত্ব একাই সামলে নিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু নিশ্চিন্তে মন দিয়েছেন দেশের কাজে । বিচক্ষণ উপদেষ্টা ও পরামর্শকারী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের আদর্শ ভাবি ছিলেন। মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও সবসময় নেপথ্যে থেকে কাজ করে গেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সাথে জড়িয়ে বঙ্গমাতাও বারবার হয়রানির শিকার হয়েছেন, গৃহবন্দী থেকেছেন।

রাজনীতে বঙ্গবন্ধুকে কেমন উৎসাহ দিতেন তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর ত্যাগকে উৎসাহ দিয়ে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব কারান্তরীণ বঙ্গবন্ধুকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান। ... আল্লাহর উপরে আমার ভার ছেড়ে দিন।’

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া ফজিলাতুন নেছা রেনু বেঁচে থাকলে আজ ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। এই আগস্টেই তার জন্ম ও মৃত্যু। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সুখ-দুঃখের সাথী হয়েই শুধু নয়, মৃত্যুতেও সাথী ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন। যখন ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, তিনি বাঁচার আকুতি জানাননি। তিনি বলেছেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ, আমাকেও মেরে ফেল।’এভাবে নিজের জীবনটা বিসর্জন দিয়ে গেছেন।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধু ওঠেন ১৯৬১ সালে। এরপর এ বাড়িই পরিণত হয় নেতাকর্মীদের আপন ঠিকানায়। এখান থেকে পরিচালিত হয় দলীয় ও মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনামূলক নানা কার্যক্রম। রাত-বিরাতে ৩২ নম্বরে অভুক্ত ছাত্রনেতা কিংবা রাজনৈতিক কর্মীদর নিজের হাতে রেঁধে মায়ের স্নেহে, বোনের মমতায় পাশে বসে খাইয়েছেন বেগম মুজিব। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করতে রাস্তায় নেমে লিফলেট বিতরণ করেছেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বলিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন নেপথ্যে থেকে।

দিনের পর দিন বঙ্গবন্ধুর কারাগারে থাকা অবস্থায় বেগম মুজিব শত সংকট মোকাবেলা করে সংসার সামলে ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করেছেন, তাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। আবার বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামে নেপথ্যে থেকে সহযোগিতা করে গেছেন। কোনোদিন স্বামীর প্রতি এতটুকু অভিযোগ করা তো দূরে থাক, সবসময় বঙ্গবন্ধুকে তার রাজনৈতিক লক্ষ্যের পানে এগিয়ে যেতে নিরন্তর উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন।

আবার প্রয়োজনে কোমলমতি বেগম মুজিব হয়েছেন কঠিনও। আরেকটি উদাহণ এখানে উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানের পর পতনোন্মুখ আইয়ুব খান টিকে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকের যে প্রস্তাব দেয় সে ব্যাপারে বেগম মুজিব যে ভূমিকা নেন তা ছিল ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী।

প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাবে বেগম মুজিব স্বামীর কাছে খবর পাঠালেন যেন তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত না নেন। আলোচনার শর্ত হিসেবে নিঃশর্ত মুক্তির পক্ষে দৃঢ় থাকার জন্য বঙ্গবন্ধুকে জেলখানায় চিরকুট পাঠিয়েছিলেন বেগম মুজিব। স্বামীকে জানান- দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে। মামলা তুলে বঙ্গবন্ধুসহ বন্দি ৩৫ জনের সবাইকে মুক্তি দিলেই গোলটেবিল বৈঠক হতে পারে, অন্যথা একা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যে দূরদর্শিতা তিনি সেদিন দেখিয়েছিলেন তা পরবর্তী সময়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথের নির্দেশনা দিয়েছিল। সহধর্মিনীর পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া সেদিনের সেই সিদ্ধান্ত জনরোষ জিইয়ে রাখতে সাহায্য করে এবং আইয়ুব খান ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ নীতিতে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।

এটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দীর্ঘদিন কারান্তরীণ স্বামীর প্যারোলে মুক্তির চেয়ে আন্দোলনের সাফল্য ও ব্যক্তি মুজিবের মর্যাদা রক্ষা ছিল তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময়ে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়া হলেও বিচলিত ছিলেন না তিনি। বরং তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মামলাটি আইনিভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে আইনজীবীদের পরামর্শ দেন।

৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে বারবার জেলে যেতে হয়েছিল। সেই কারারুদ্ধ দিনগুলোতে যোগ্য সহধর্মিণীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন । ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে শেখ মুজিবের দিকনির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন। তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বেগবান হয়। আন্দোলন ও গণবিরোধী গণবিক্ষোভের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হলেন ২২ ফেব্রুয়ারি। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা তাদের অবিসংবাদিত নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয় ।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৩ মার্চ এর পতাকা উত্তোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এ মহীয়সী নারী। তিনি সারাটা জীবন ভর বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে ছিলেন। সংসারের সকল দায়িত্ব তিনি একাই সামলে নিয়েছেন। শেখ মুজিব নিশ্চিন্তে মন দিয়েছেন দেশ গড়ার কাজে রাজনীতি ও জনসেবায়। এই মহীয়সী নারী ছিলেন বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতির পিতার একজন যোগ্য বিশ্বস্ত সহচর। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই স্বপ্ন দেখতেন। তাইতো তিনি শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘রেণু’ নন। আমাদের বঙ্গমাতা।

রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যেও ছিল বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সুচিন্তিত পরামর্শ। এ ভাষণের বক্তব্য কী হবে তা নিয়ে যখন নানা আলোচনা চলছিল- তখন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন ‘সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে। অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে। তুমি নিজে যে ভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটিই ঠিক হবে। এভাবে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করতে, ৭০ এর নির্বাচনের সময় জনমত গঠনে যেমন ফজিলাতুন নেছার ভূমিকা ছিল, তেমনি একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যেও ছিল ফজিলাতুন নেছার উৎসাহ ও প্রেরণা।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনেও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সহযাত্রী ছিলেন ফজিলাতুন নেছা। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মা-বোনদের পাশে দাঁড়ান, সান্ত্বনা দেন। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। মানবকল্যাণে তার ছিল অপরিসীম অবদান। তিনি সংগঠনের নেতাকর্মী ও গরিব আত্মীয়স্বজনের রোগশোকে চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক সংকটে মুক্তহস্তে দান করতেন। এ ছাড়া কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে আর্থিক সাহায্য, অনাথ, এতিম ও গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সব সময়ই। এছাড়া স্বাধীন দেশের নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। নারীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

তিনি আমৃত্যু স্বামীর পাশে থেকে একজন যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে দেশ ও জাতি গঠনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির জন্য তার অপরিসীম ত্যাগ, সহযোগিতা ও বিচক্ষণতার কারণে জাতি তাঁকে যথার্থই ‘বঙ্গমাতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। বঙ্গমাতা যে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তার জীবনী চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।

বঙ্গমাতার আরেকটি দিক উল্রেখযোগ্য। তিনি ছিলেন নিরহঙ্কার ও পরোপকারী। পার্থিব বিত্তবৈভব বা ক্ষমতার জৌলুস কখনো তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেগম মুজিবের সরল জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসেনি। রাষ্ট্রনায়কের স্ত্রী হওয়ার পরও কোনো অহংকার তাঁকে কখনো স্পর্শ করেনি। বঙ্গমাতার এই গুণাবলীগুলি পথ চলার ক্ষেত্রে আমাদের আদর্শ।

বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা, বন্ধু, পরামর্শদাতা, জীবনসঙ্গী, নির্ভরতা ও ভালোবাসার শেষ ঠিকানা। যার হৃদয় ছিল কঠোর-কোমলে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন আদর্শ নারী, বিচক্ষণ উপদেষ্টা ও পরামর্শকারী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস। কোটি বাঙালির স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত থাকবেন তিনি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন থাকবেন আমাদের অস্তিত্বে ।

তাই বলতে হয়, ইতিহাসে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল একজন সাবেক রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণীই নন, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম এক নেপথ্য অনুপ্রেরণাদাত্রী। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় চেতনাকে আরো শাণিত করেছিলেন এই মহীয়সী নারী। প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বলে থাকবে বঙ্গমাতার অবদান।

বাঙালির প্রতিটি মুক্তি সংগ্রামে রয়েছে তার অনন্য অবদান। তিনি সাধারণ নারী নন, বরং বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘজীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে শক্ত হাতে হাল ধরেছেন নিজ পরিবারের, সেইসাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী মুক্তিকামী, বাংলার আপামর জনসাধারণের পাশে ছিলেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো। তার মাতৃস্নেহ হয়ে উঠেছিল বাঙালির আশ্রয়স্থল।

দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন একাকিত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তার অনুপ্রেরণাদায়ী বলেছিলেন ‘তুমি ফিরে এসেছো সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। আমি উল্লসিত কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত ধূসর প্রান্তরে, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্ত পুরুষ এবং সন্তানহারা জনক-জননী তোমার প্রতীক্ষায়। এভাবে বঙ্গবন্ধুকে আজীবন উৎসাহ, সাহস জোগাতেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

লেখক: কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন