বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা যে কারণে স্মরণীয়
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা (রেণু) ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধু এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনিও নির্মমভাবে নিহত হন। বেগম মুজিব খুব অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারান। তবে শৈশবেই তাঁর মধ্যে সাহস, ধৈর্য ও দূরদর্শিতা গড়ে উঠেছিল। পরে স্বামী-সংসার অন্তঃপ্রাণ একজন বাঙালি নারী এবং শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা সহযোদ্ধা হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ, রাজধানীর আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দিতে বলেছিলেন এভাবে, ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধহয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত।
এমন সময়ও আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। মহিলার নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। সে জন্য আজকে আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা আমার, যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে।’
৪৫ বছরের জীবনের সবটাই বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে গিয়েছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব (রেণু)। কলকাতায় কলেজে অধ্যয়ন এবং রাজনীতিতে সক্রিয় বঙ্গবন্ধুকে কখনো সংসার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে দেননি তিনি। নিজেকে আড়াল করে সর্বদা পেছন থেকে সহায়তা দিয়েছিলেন স্বামীকে। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী লেখার সময় বারবার প্রিয় রেণুর গল্প, তাঁর ধৈর্য ও সহনশীলতা গুণের কথা স্মরণ করেছেন। তাঁর স্ত্রীর দূরদর্শিতা, ধৈর্য ও সাহস তাঁকে জনগণের জন্য কাজ করতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। তিনি সুপরামর্শ ও সৎসাহস দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহিত করে গেছেন।
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনে বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর ধৈর্য, সাহস, নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার কথা। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের লেখক হওয়ার অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- ক. ‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের দায়িত্ব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর পিতা যা বলেছিলেন তার প্রতিক্রিয়া কি ছিল তা এই উদ্ধৃতিতে দেখা মেলে, সেখানে বেগম মুজিবের কথাও আছে- ‘আব্বা বললেন, আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। তুমি বিবাহ করেছ, তোমার মেয়ে হয়েছে, তাদের জন্য তো কিছু একটা করা দরকার। আমি আব্বাকে বললাম, আপনি তো আমাদের জন্য জমিজমা যথেষ্ট করেছেন, যদি কিছু না করতে পারি, বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলতে পারে না। আমাকে আর কিছুই বললেন না।’
রেণু বলল, ‘এভাবে তোমার কতকাল চলবে। আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্যে টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’
সহধর্মিণী যথার্থই সহযাত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর। তাঁর আত্মত্যাগকে আমৃত্যু মনে রেখেছিলেন। গ্রন্থের বাক্যে বাক্যে তা স্মৃতিময় হয়ে আছে অনেক জায়গায়। একটি অংশ- ‘মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভালো করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলেমেয়ের পিতা হয়েছি। আমার আব্বা ও মাকে দেখতে মন চাইছে। তাঁরা জানেন, লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’
বেগম মুজিব কেবল শাশ্বত বাঙালি নারীর প্রতীক ছিলেন না তিনি ছিলেন ভালোবাসায়, মমত্ববোধে অনন্য। এতিম ও স্বল্প শিক্ষিত কিন্তু স্বশিক্ষিত একজন নারী- পরিবার, সংসার এবং শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর অসহায়ত্ববোধও ছিল স্পষ্ট- ‘রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’ কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হলো উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল, হাচু ও কামাল ওদের মা’র কাঁদা দেখে ছুটে যেয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম, ‘খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি?’ পরের দিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাকে বোঝাতে অনেক কষ্ট হলো।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একজন হয়েও নারীকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখার এই দৃষ্টান্ত সত্যিই অভিনব। একদিকে সংসার- ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ব্যয়ের ক্রমাগত বৃদ্ধি অন্যদিকে নির্ধারিত আয় নেই বললেই চলে; এমনকি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা না দেওয়ায় ১৯৬৬ সালে অসুবিধা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়। তখন বঙ্গবন্ধু স্ত্রীকে বলেন, ‘কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাংকেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালোভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপণতা করবে না। যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব’, রেণু বলল। সরকার যদি ব্যবসা করতে না দেয় তবে বাড়িতে যে সম্পত্তি আমি পেয়েছি আব্বার, মায়ের ও রেণুর তাতে আমার সংসার ভালোভাবে চলে যাবে। রেণু বলল, ‘চিন্তা তোমার করতে হবে না। সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি।’
বেগম মুজিবই যে বুদ্ধিমত্তা ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে সংসার চালিয়েছিলেন তা বঙ্গবন্ধু সরসরি উল্লেখ করতে ভুলেননি। ‘রেণু বলল, পূর্বেই সে জানতো যে আমাকে সাজা দেবে। দেখে খুশিই হলাম। ছেলেমেয়েরা একটু দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো, তবে হাবভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না। বললাম, তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আমার কতদিন থাকতে হয় জানি না। তবে অনেকদিন আরও থাকতে হবে বলে মনে হয়। আর্থিক অসুবিধা খুব বেশি হবে না, তোমার মা চালাইয়া নিবে। কিছু ব্যবসাও আছে আর বাড়ির সম্পত্তিও আছে। আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটাইয়াছি তোমার মা’ই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও।’
১৯৫৪ সাল থেকে বেগম মুজিব ঢাকায় স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, তাঁর সচেতন ও সতর্ক এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার শক্তি সম্পর্কে। ‘আমি সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় যেয়ে দেখি রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে গতকাল ঢাকায় এসেছে। সে এখন ঢাকায়ই থাকবে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত হওয়া দরকার। আমি খুশিই হলাম, আমি তো মোসাফিরের মতো থাকি। সে এসে সকল কিছু ঠিকঠাক করতে শুরু করেছে। আমার অবস্থা জানে, তাই বাড়ি থেকে কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে।’
বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবিনামা প্রকাশ করে প্রচারণা শুরু করলে ১৯৬৬ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সেসময় বেগম মুজিব কেবল নিজের ঘর-সংসার-সন্তান সামলে চলেননি বরং অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে একজন সচেতন নারী হিসেবে নেতাদের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। একটি স্মৃতি এরকম- ‘প্রায় এক ঘণ্টা রেণু এবং আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছিলাম। সংসারের ছোটখাটো আলাপ। ওদের বলেছি আর কোনো কষ্ট নাই; একাকী সঙ্গীবিহীন আছি। মানিক ভাইকে বলতে বললাম, তিনি যেন চিফ সেক্রেটারিকে বলেন কেন এই অত্যাচার? আমার স্ত্রী বলল, মানিক ভাইর সাথে দেখা করব। সাক্ষাতের সময় শেষ হয়ে গেছে আর দেরি করা চলে না। তাই বিদায় দিলাম ওদের। রাসেলকে গাড়ির কথা বলে কামালের কাছে দিয়ে সরে এলাম।’
এই সাক্ষাতে বেগম মুজিবের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা শেখ হাসিনার লেখায় আরও স্পষ্ট হয়েছে- ‘জেলখানায় দেখা করতে গেলে আব্বা তাঁর মাধ্যমেই দলীয় নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর পেতেন। আব্বার দিক-নির্দেশনা আম্মা নেতা-কর্মীদের পৌঁছে দিতেন। আব্বা কারাবন্দি থাকলে সংসারের পাশাপাশি সংগঠন চালানোর অর্থও আমার মা জোগাড় করতেন। তিনি কখনও ব্যক্তিগত-পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি। একদিকে যেমন সংসারের দায়িত্ব পালন অন্যদিকে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনাসহ প্রতিটি কাজে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।’
এভাবে সংসারের গণ্ডি অতিক্রম করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন বেগম মুজিব। নিজের বড় মেয়ে শেখ হাসিনার বিয়ের বিষয়ে ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে তাঁর অভিমত ছিল এরকম- ‘রেণুকে বললাম, মোটা হয়ে চলেছি, কি যে করি! অনেক খাবার নিয়ে আসে। কি যে করব বুঝি না। রেণু আমার বড় মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব এনেছে, তাই বলতে শুরু করল। আমার মতামত চায়। বললাম, জেল থেকে কি মতামত দেব; আর ও পড়তেছে পড়ুক, আইএ, বিএ পাস করুক। তারপর দেখা যাবে।’ রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কতদিন যে আমাকে রাখবে কি করে বলব! মনে হয় অনেকদিন এরা আমায় রাখবে। আর আমিও প্রস্তুত হয়ে আছি। বড় কারাগার থেকে ছোট কারাগার, এই তো পার্থক্য।’ অন্যত্র (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)- ‘আমি হাচিনাকে বললাম, ‘মা আমি জেলে আছি, কতদিন থাকতে হবে, কিছুই ঠিক নাই। তবে মনে হয় সহজে আমাকে ছাড়বে না, কতগুলি মামলাও দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে চলেছে। তোমাদের আবারও কষ্ট হবে। তোমার মা যাহা বলে শুনিও। রেণুকে বললাম, “আর কি বলতে পারি? আবার বললাম, ‘১০ তারিখে মামলা আছে। আকরাম ও নাছেরকে পাঠাইয়া দিও। বাচ্চারা কেমন আছে জানাইও।’ অন্যত্র (১৯৬৭, মে)- ‘১৭ তারিখে রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। হাচিনা আইএ পরীক্ষা দিতেছে। হাচিনা বলল, “আব্বা প্রথম বিভাগে বোধ হয় পাস করতে পারব না তবে দ্বিতীয় বিভাগে যাবো।” বললাম, ‘দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে মন দিয়ে পড়। দ্বিতীয় বিভাগে গেলে আমি দুঃখিত হব না, কারণ লেখাপড়া তো ঠিকমতো করতে পার নাই।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে যোগ্য সঙ্গী হওয়ায় বেগম মুজিব কেবল সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন না তিনি আন্দোলন সংগ্রামে হয়ে উঠেছিলেন গেরিলা যোদ্ধার মতো সতর্ক কর্মী। ছয় দফা দাবি আদায়ের লড়াইয়ে গোপনে প্রচারণা চালানো থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন তিনি। শেখ হাসিনার স্মৃতিতে তিনি উদ্ভাসিত- ১৯৬৬ সালে কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতার ৬ দফাকে ৮ দফায় রূপান্তরের চেষ্টা বেগম মুজিবের জন্য ভেস্তে যায়।
কারাবন্দিদের মুক্তির জন্য ৭ জুনের হরতাল সফল করা, সেটাও সফল হয়েছিল বেগম মুজিবের প্রচেষ্টায়। তিনি নিজ বাসা থেকে আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে সেখান থেকে স্যান্ডেল আর বোরকা পরে জনসংযোগে বেরিয়ে পড়তেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর কাছে দেশের অবস্থা বর্ণনা, সংগঠনের অবস্থা অবহিত করা এবং বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে এসে দলের নেতা-কর্মীদের কাছে তা হুবহু পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অসাধারণ স্মরণ শক্তির অধিকারী ছিলেন বেগম মুজিব।
বেগম মুজিবের একটি সিদ্ধান্ত বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায় পাক সামরিক সরকার। ছয় মাস পর্যন্ত তাঁর কোনো হদিস ছিল না, আমরা জানতেও পারিনি তিনি বেঁচে আছেন কি না। এরপরে কোর্টেই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার সুযোগ হয়। তখন পাকিস্তান সরকার আম্মাকে ভয় দেখান, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি না নিলে তিনি বিধবা হবেন।’ ‘আম্মা সোজা বলে দিলেন, কোন প্যারোলে মুক্তি হবে না। নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে কোনো মুক্তি হবে না।’ ‘আমি মায়ের সিদ্ধান্তের কথা কোর্টে যখন বঙ্গবন্ধুকে জানালাম তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখেছি তারা বলেছেন, তুমি কেমন মেয়ে? বাবার মুক্তি চাও না? আম্মাকে বলেছে-ভাবি আপনি কিন্তু বিধবা হবেন।’
‘আমার মা তখন কঠিন স্বরেই বলেছেন, প্যারোলে মুক্তি নিলে মামলার আর ৩৩ জন আসামির কি হবে। বঙ্গবন্ধু প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় বেগম মুজিব পুলিশ ও গোয়েন্দা চক্ষুর আড়ালে সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন। বিচক্ষণতার সঙ্গে ছাত্রদের তিনি নির্দেশনা দিতেন এবং অর্থ সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন। এমনকি নিজের গহনা বিক্রি করেও অর্থ জুগিয়েছেন।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বিকেলের কথা আছে শেখ হাসিনার লেখায়। সেদিন ভাষণ দিতে যাওয়ার আগে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘তোমার যা মনে আসে তাই তুমি বলবে। তুমি রাজনীতি করেছো, কষ্ট সহ্য করেছ, তুমি জান কি বলতে হবে। কারও কথা শোনার দরকার নাই।’ ‘এই লাখো জনতা যেন হতাশ হয়ে না যায়। আবার পাকিস্তানিরা যেন গোলাগুলি করে এদের শেষ করে দিতে না পারে।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বেগম মুজিবের মনোবল ছিল আশা জাগানিয়া। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। শেখ হাসিনা, রেহানা, রাসেল তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন কিন্তু তিনি হতবিহ্বল হননি। কারণ শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘বঙ্গমাতাই বোধহয় সবচেয়ে আগে জানতেন, এই দেশ একদিন স্বাধীন হবে।’ ডিসেম্বরে বিজয়ের মুহূর্তে তাঁর আনন্দের মধ্যেও বেদনা ছিল বঙ্গবন্ধুকে সুস্থাবস্থায় ফিরে পাওয়া নিয়ে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি ফিরে এলে তিনি দুশ্চিন্তা মুক্ত হন। তবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ফার্স্ট লেডি হওয়া সত্ত্বেও বিলাসিতা ত্যাগ করে তিনি এ দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন এবং আবাসনের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠিত হয়। ওই সময়ে বেগম মুজিবের প্রচেষ্টায় ১০ জন বীরাঙ্গনা নারীকে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল।
মূলত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে যেমন তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখনিতে বঙ্গমাতা আলোকিত হয়েছেন। ফজিলাতুন নেছা ছিলেন জাতির পিতার জন্য প্রেরণা, শক্তি এবং সাহসের এক অনন্ত উৎস। স্বামীর সকল সিদ্ধান্তে মনস্তাত্ত্বিক সহযোগিতা ছাড়াও বঙ্গমাতার পরামর্শ অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়েছিল। শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাশে ছিলেন। যখন ঘাতকরা আমার বাবাকে হত্যা করল, তিনি তো বাঁচার আকুতি করেননি। তিনি বলেছেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল।’ এভাবে নিজের জীবনটা উনি দিয়ে গেছেন। সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মহাপ্রয়াণের পরও বঙ্গমাতা আজও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর আত্মত্যাগের অবদানকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদের সবার।
লেখক: বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জিকেএস