ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

স্কুল বন্ধ রেখে দলীয় সম্মেলন ও শিক্ষামন্ত্রীর দুঃখপ্রকাশ

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ০৪:১৭ পিএম, ২৮ জুলাই ২০২২

পত্রিকার পাতায় ঘুরতে ঘুরতে একটি হেডলাইনে চোখ আটকে গেল। প্রথম সারির একটি দৈনিকের হেডলাইনে বড় অক্ষরে লেখা “আমি ভীষণভাবে লজ্জিত ও দুঃখিত – শিক্ষামন্ত্রী”

ভাবতে পারছিলাম না হঠাৎ কোন কারণে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করলেন। পুরো সংবাদটি পড়ে মনে একদিকে শান্তি খুঁজে পেলাম আবার অন্যদিকে ভারাক্রান্তও হলো। শান্তি পেলাম এই চিন্তা করে যে আমাদের মন্ত্রীরা কোনো ঘটনার কারণে দুঃখ প্রকাশের মতো নমনীয়তা প্রকাশ করছেন আবার ভারাক্রান্ত হলো কারণ এই একবিংশ শতকের ডিজিটাল বাংলাদেশেও রাজনৈতিক দলের সম্মেলনের জন্য স্কুল বন্ধ করার সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছি আমরা।

মূল ঘটনা হচ্ছে, দক্ষিণ খান আওয়ামী লীগের থানা ও ওয়ার্ড সম্মেলন উপলক্ষে সেই স্থানের মোট পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল বলে প্রকাশিত হয়েছে। একদিন না হয় বন্ধ ছিল কিন্তু সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্য এর আগে কদিন শিক্ষার্থীরা সেই অঙ্গনে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল সেই হিসাবটি তো অনুমান করাই যায়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী। অভিভাবকদের ক্ষোভের কথাও জানা যায় এর পরিপ্রেক্ষিতে। এমনিতেই করোনায় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল। শিক্ষা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে ব্যাপক ভাবে। শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতিপূরণ পুষিয়ে নেওেয়ার জন্য কিছুদিন আগেই কর্তৃপক্ষ এক্সট্রা ক্লাস নেয়ার কথাও জানিয়েছে।

পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী আছে বলে জানা গেছে। এতগুলো শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে সম্মেলন করার কথা যারা চিন্তা করেন তারা কতটা গণবান্ধব এটা ভেবে দেখার অবকাশ আছে। এমন নেতৃত্ব আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের জন্য কতটা সহায়ক হবে সেটাও আশা করি ভেবে দেখবেন নেতারা।

পরে আসল ঘটনা জানার পর শিক্ষামন্ত্রী প্রকাশ্যে লজ্জিত ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এটা একটা অনুকরণীয় ঘটনা বটেই। বিশেষ করে যখন আমরা সারাদেশের জনপ্রতিনিধি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের অনেকের কাছ থেকে কেবল নেতিবাচক সংবাদই পেয়ে থাকি।

একটা সময় ছিল যখন স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হতো। স্কুলের মাঠে জনসভা করতো। প্রধান অতিথিকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড রোদের মধ্যে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট শিক্ষার্থীর জ্ঞান হারানোর মতো সংবাদও পাওয়া যেতো আগে। তবে সেসব ঘটনার জন্য কখনও কেউ কষ্ট পেতো না বা দুঃখ প্রকাশ করতো না।

দিন বদলেছে। এই সরকারের আমলেই কিন্তু সেই পরিবর্তন আমরা দেখেছি। মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বা শিক্ষার্থীদের কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করানো যাবে না। এটা একটা চর্চার বিষয়। অনেকদিনের চর্চা একদিনে চলে যাবে না কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এমন ঘটনা আমরা আর শুনিনি খুব একটা।

হঠাৎ করেই তাই, উত্তরার দক্ষিণ খানের এই ঘটনা মনে করিয়ে দিল আমাদের আদিম রাজনৈতিক একটি চর্চার কথা। অন্তত দুঃখ প্রকাশের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী তার পদকে একটা মর্যাদা দিয়েছেন। একজন শিক্ষামন্ত্রীর হাত দিয়ে কখনও একজন শিক্ষার্থীর ক্ষতি হতে পারে এমন কার্যক্রমের জন্য সেই শিক্ষামন্ত্রীর কাছে শিক্ষা খাত কতটা নিরাপদ সেটাই হয়তো ভাবতে পারি আমরা।

কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী আগে থেকে যেহেতু জানতেন না তাই জানার পরেই তিনি লজ্জিত ও দুঃখিত হয়েছেন। এই দুঃখ প্রকাশের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানাই কিন্তু এর পাশাপাশি অবশ্যই চাইবো তিনি সংশ্লিষ্ট দলীয় নেতাদের একটি জবাবদিহিতার আওতায় আনবেন যে কেন তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে রাজনৈতিক সম্মেলন করতে গেলো।

বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশের পথে হাঁটছে। উন্নত দেশ হতে গেলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। এই পরিবর্তন আসবে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমেই। সেখানে আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশাটাও তাই একটু বেশি। রাজনৈতিক নেতাদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব দলীয় নেতাদের ওপর বর্তায়। মন্ত্রী সেখানে প্রধান অতিথি হয়েছেন দলীয় পরিচয়ে, মন্ত্রী হিসেবে নয়। তাই দলের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও মন্ত্রী হিসাবে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আশা করি তিনি এই ঘটনাকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করবেন।

সারাদেশে এমনিতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খারাপের দিকে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মর্যাদা কমে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা সচেতন নাগরিক হয়ে বেড়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষকের মর্যাদা শিখছে না। একটি সংবাদে দেখলাম ছাত্রলীগের কোনো একটি উপজেলার কমিটিতে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রকে রাখা হয়েছে।

এর আগেও একবার কুমিল্লার লালমাইয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রকে কমিটিতে রাখার সংবাদ এসেছিল। ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতন হতে হবে অবশ্যই কিন্তু দলীয় দায়িত্ব নেয়ার মতো মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা হওয়ার আগেই তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া মানেই তাদের বিকাশকে বিপথে পাঠিয়ে দেওয়া।

এহেন অস্থির পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ অবশ্যই একটা বার্তা বহন করে আমাদের মতো সাধারণ অভিভাবকের কাছে।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস/ফারুক

আরও পড়ুন