নির্বাচন, ইসি, সিইসি এবং রাজনীতি সমাচার
নির্বাচনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, আবার নির্বাচন কমিশনের বড় কর্তা হলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। আরও কয়জন নির্বাচন কমিশনার থাকলেও মূলত সিইসির ভূমিকাই হলো ইসির কাজকর্মে গুরুত্বপূর্ণ। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন থাকায় ইসি ও সিইসি নিয়ে আলোচনা এখন বেশ বাজার পাচ্ছে। এর মধ্যে সিইসি বা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কিছু বক্তব্য নিয়ে পানি ঘোলা করার তালবেতালও চলছে। সিইসি একটু কম কথা বললেই ভালো।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এটা একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনাররা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। হুট করে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় না। তাই তাদের উচিত দায়িত্ব পালনে যত্নবান হওয়া। কম কথা বলে বেশি কাজ করে উদাহরণ তৈরি করা, বিতর্কে কম জড়ানো।
একটি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে একেবারে কম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তবে এ পর্যন্ত দেশে যতগুলো নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার খুব কম কমিশনকেই তাদের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে দেখা গেছে। সম্ভবত সেজন্যই অধিকাংশ কমিশনের কার্যক্রমই বেশিরভাগ মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়নি। নির্বাচনের সময় যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকার মন জুগিয়ে চলার জন্যই মূলত নির্বাচন কমিশন বিতর্কমুক্ত থাকতে পারে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশে সুষ্ঠু বা ভালো নির্বাচন হয় বলে একটা ধারণা চালু হয়েছে। তবে এটা শতভাগ সত্য নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়েও কমবেশি বিতর্ক আছে, হয়েছে। আসল বিষয় হলো যেসব ব্যক্তিকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, তারা কতটা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং তাদের মেরুদণ্ড কতটা দৃঢ়। একজন মানুষ সোজা হয়ে হাঁটাচলা করতে পারলেই তার মেরুদণ্ড দৃঢ়- সেটা কিন্তু নয়। যিনি নিজের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক এবং প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেন, তার মেরুদণ্ডই দৃঢ়।
এবার দেখা যাক সুষ্ঠু বা ভালো নির্বাচন বলতে সাধারণভাবে আমরা কি বুঝি। নির্বাচন মানে হলো কয়েকজন মানুষ একটি নির্দিষ্ট পদের জন্য প্রার্থী হবেন এবং একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ভোট দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে যাকে যোগ্য বিবেচনা করবেন তাকে নির্বাচিত করবেন। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে, ভোটে একজন নয়, একাধিক প্রার্থী থাকতে হবে এবং ভোটারদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা থাকতে হবে। যারা প্রার্থী হবেন তাদের নিজ নিজ বক্তব্য প্রচারের সুযোগ থাকতে হবে এবং যাদের উদ্দেশ্য বলবেন তাদের সেই বক্তব্য অবাধে শোনার সুযোগও থাকতে হবে। প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে যেমন কাউকে বাধা দেওয়া যাবে না, তেমনি ভোটারদেরও নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া চলবে না।
প্রার্থী ও ভোটারদের এই অধিকার নিশ্চিত করাই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব যদি কমিশন যথাযথভাবে পালন করে এবং ভোটে দাঁড়ানো ও ভোট দেওয়া যদি নির্বিঘ্ন হয় তাহলেই সুষ্ঠু বা ভালো ভোট হয়। আরও একটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো একটি নির্দিষ্ট আসন বা পদে ভোটে দাঁড়ায় অনেকে, কিন্তু জয়লাভ করে একজন। কাজেই নির্বাচন মানেই জয় পরাজয়। জয়ের জন্য চেষ্টা করতে হবে এবং পরাজয় মেনে নিতে হবে। এটাও ভালো নির্বাচনের মাপকাঠি। জেতার জন্য যেমন বলপ্রয়োগ করা চলবে না, তেমনি হেরে গেলেও কারও ওপর বদলা নেওয়ার মানসিকতা বাঞ্ছনীয় নয়।
এই জয়পরাজয়ের খেলায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা রেফারির, ইসি কোনো বিশেষ পক্ষ নয়। খেলায় কেউ ফাউল করলে, খেলার নিয়ম ভঙ্গ করলে তাকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করার ক্ষমতা যেমন নির্বাচন কমিশনের আছে, তেমনি গুরুতর নিয়ম ভঙ্গ করলে লাল কার্ড দেখিয়ে ফাউল খেলোয়াড়কে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার ক্ষমতাও রেফারি বা নির্বাচন কমিশনের আছে। কিন্তু এই রেফারিংয়ের কাজটি নির্বাচন কমিশন ঠিক ঠিক মতো করতে পারে না বলেই আমাদের দেশে নির্বাচন, ইসি, সিইসি– সব কিছু নিয়েই এখন চারদিকে ছি ছি শোনা যায়।
কথা আরও আছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় অংশীজন হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। সংসদ সদস্য হিসেবে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে থাকে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। তবে এখন আর রাজনীতির বাইরে কেউ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন না। এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনও হয় দলীয় ভিত্তিতে। তবে এখনো যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হন, তারা আসলে রাজনীতিরই লোক। দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়েই স্বতন্ত্র পরিচয় ধারণ করেন।
নির্বাচনে কাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, কারা প্রার্থী হবেন সেটা নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের ওপর। এখানে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার নেই। আবার দেশের সব মানুষ রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও ভোটাররা ভোট দেন রাজনৈতিক দল বিবেচনা করে, আরও নির্দিষ্ট কর বললে মার্কা দেখে। প্রার্থীর যোগ্যতা বা গুণাগুণ মুখ্য নয়, ভোটের মাঠে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় মার্কা। মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার ঘাটতির কথা যদি বলা হয়, তাহলে এর দায়ও কিন্তু রাজনৈতিক দলের, নির্বাচন কমিশনের নয়। মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের।
আমাদের দেশের রাজনীতি প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের, অন্য ভাগের নেতৃত্ব বিএনপির। দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে সংকট বা ঝামেলা, বিতর্ক তার সমাধান নির্ভর করে মূলত এই দুই দলের ওপরই। সমস্যা তৈরি হয়েছে এই দুই দলের ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার একরোখা প্রতিযোগিতা থেকেই। দুই দল হয়তো সমভাবে দোষী নয়। নিশ্চয়ই একপক্ষের অন্যায্য আচরণের প্রতি কিছু মানুষের যুক্তিহীন পক্ষপাতিত্ব, অন্য পক্ষকেও অন্যায্যতার পথে চলতে প্ররোচিত করেছে। তবে আজকের আলোচনায় এটা মূল ফোকাস নয়।
যদি আমরা বলি, দেশের রাজনীতি সঠিক ধারায় চলছে না, রাজনীতিতে চলছে নীতিহীনতার উৎসব, তাহলে এটাও বলতে হবে যে রাজনীতিকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে চাপ দিতে হবে ওই দুই দলের ওপরই। নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনীতি শুদ্ধিকরণের ভার বা দায় চাপানো ঠিক নয়। অথচ এই বেঠিক কাজটি আমাদের অনেকে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে করতে নেমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের মাথা গরম করে দিয়েছি। দায়িত্ব পাওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে তিনি এত সব সংলাপ করছেন এবং তাতে কথা বলতে গিয়ে কিছু প্রলাপ বকে নিজেই আবার নানা জনের বকা খেয়ে শেষপর্যন্ত ‘সঠিকভাবে এবং আল্লাহর দিকে তাকিয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারার জন্য দোয়া চেয়েছেন’। আসুন আমরা সবাই তাকে এই দোয়া করি, তিনি যেন রাজনীতির যাবতীয় জঞ্জাল সাফ করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বেসামাল না হয়ে শুধু একটি সুষ্ঠু তথা ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানেই তার সহকর্মী কমিশনারসহ মনোযোগ সীমাবদ্ধ রাখেন।
গত রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে সিইসি বলেছেন, ‘আপনাদের প্রতি আমাদের একটাই অনুরোধ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের করণীয় নির্ধারণে আপনারাও ভূমিকা রাখবেন। অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সবারই প্রত্যাশা। সেই লক্ষ্যে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং থাকবে। আপনাদের সমর্থন ও সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা সবার পরামর্শ ও মতামত জানার জন্য চেষ্টা করছি।’
অনেক পরামর্শ ও মতামত এর মধ্যেই নির্বাচন কমিশন নিয়ে ফেলেছেন। এখন পরামর্শ নেওয়া থেকে বিরত হয়ে নিজেদের কাজ গুছিয়ে আনা ভালো। সিইসি শেষদিনের আলোচনা শেষে আরও বলেছেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকাও হবে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। কেউ বলছে নির্বাচনকালীন সরকার, কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদিও বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি বা সেটি কীভাবে হবে, তবে সরকার থাকবে। নির্বাচনের সময় যে সরকার থাকবে, সেই সরকার আমাদের সহায়তা করবে। সেটি সরকারের সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ দায়িত্ব হবে। কমিশন তার দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংবিধান, আইন ও বিধির আলোকে প্রয়োগ করবে।’
নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালনে ও ক্ষমতা প্রয়োগে কতটুকু সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে, সেটা দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস