ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ

মো. সামছুল আলম | প্রকাশিত: ০১:২৯ পিএম, ২৩ জুলাই ২০২২

হাজার বছর ধরে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে মাছ শব্দটি। তাই প্রবাদেও আছে “মাছে ভাতে বাঙালি”। এটি শুধু প্রবাদ নয়, বাঙালির জাতীয় চেতনাও বটে। এ চেতনাকে ধারণ করেই মাছ চাষী, মৎস্য বিজ্ঞানী ও গবেষক এবং সম্প্রসারণবিদসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ মৎস্য সম্পদে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে।

বৈশ্বিক করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় সকল ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হলেও মৎস্য সেক্টরে এর প্রভাব পড়েনি। এর ফলস্বরুপ দেখা যায়, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্ত্বেও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৪ হাজার ৪২ দশমিক ৬৭ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৫ হাজার ১৯১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা আয় হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে শতকরা ২৬ দশমিক ৯৬ ভাগ বেশি।

বাংলাদেশের সামগ্রিক কৃষি সেক্টরে মৎস্যখাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।এক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন কার্যক্রম অব্যহত থাকার ফলে মাছ উৎপাদন নিয়মিত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে মাছ উৎপাদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় রেকর্ড তৈরি করেছে।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশ আজ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বিশ্বে ৩য়, স্বাদুপানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে ২য়, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে ৫ম, অ্যাকোয়াকালচার, অর্থাৎ মাছের সঙ্গে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ উৎপাদনে ৫ম, ইলিশ আহরণে বিশ্বে ১ম, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাশিয়া এবং ফিনফিস উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১২তম। তাছাড়া তেলাপিয়া মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ৪র্থ এবং এশিয়ায় ৩য় (অ.স ২০২২)।

মাছের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে এজন্যই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৭২ সালে কুমিল্লার এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘মাছ হবে দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ’।

আর এই সম্ভাবনাময় সম্পদ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে প্রতিবারের ন্যায় এবারো নানা আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হচ্ছে “জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২২”। “নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ” এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২৩ জুলাই শুরু হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ । চলবে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি,প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে ও অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে মৎস্যখাত গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।সরকারের সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমানে দেশের মোট জিডিপি’র শতকরা ৩ দশমিক ৫৭ ভাগ, কৃষিজ জিডিপি’র শতকরা ২৬ দশমিক ৫০ ভাগ এবং মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ১ দশমিক ২৪ ভাগ মৎস্য খাতের অবদান। মৎস্যখাতে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি শতকরা ৫দশমিক৭৪ ভাগ।

মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষ, বিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতির সংরক্ষণ, মাছের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম সৃষ্টি, জাটকা সংরক্ষণ , মা ইলিশ সংরক্ষণ ও পরিবেশ বান্ধব চিংড়ি চাষ ইত্যাদি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর চীন হতে বিশুদ্ধ জিনপুল সমৃদ্ধ ৩৮ হাজার ৪ শত ৬১টি চাইনিজ কার্প, যথা- সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ও বিগহেড কার্প আমদানি করেছে। বর্তমানে দেশের ৩৯টি সরকারি খামারে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে রেণু উৎপাদন করে এই মূল জাত পর্যায়ক্রমে দেশের সকল সরকারি বেসরকারি খামারে এবং চাষি পর্যায়ে সরবরাহ করা হচ্ছে।

মাছের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে “ বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ” ঘোষণা করা হয়েছে।এছাড়াও মাছের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করতে,পাশাপাশি বর্তমান সরকারের আমার গ্রাম, আমার শহর এর কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার ‘দক্ষিণ বিশিউড়া’ ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ‘হালইসার’ গ্রামকে ‘ফিশার ভিলেজ’ বা ‘মৎস্য গ্রাম’ ঘোষণা করেছে।

এছাড়া সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিসারিজ প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প এলাকায় ১০০টি মডেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠা ও ৪৫০টি মৎস্যজীবী গ্রাম উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির বাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য মান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। গ্রামীণ মৎস্য চাষী ও জেলেদের তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে দেশব্যাপী জেলে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান এবং ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।

মৎস্যখাতে সরকার কর্তৃক গৃহীত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রকল্পসমুহের বাস্তবায়নের ফলে ২০২০-২১ অর্থ বছরে মাছ উৎপাদিত হয়েছে ৪৬.২১ লক্ষ মেট্রিক টন,যা ২০১০-১১ অর্থ বছরের মোট উৎপাদনের ( ৩০.৬২ লক্ষ মেট্রিক টন) তুলনায় ৫০. ৯১ শতাংশ বেশি। তাছাড়া ১৯৮৩-৮৪ অর্থ বছরে মাছের উৎপাদন ছিলো ৭.৫৪ লক্ষ মেট্রিক টন। গত ৩৮ বছরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ গুণের অধিক (অ.স ২০২২)।

মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় জাটকা রক্ষায় ফেব্রুয়ারি হতে মে পর্যন্ত পরিবার প্রতি মাসিক ৪০ কেজি এবং ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিনের জন্য পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে চাল প্রদান করা হয়। ২০২১-২২ অর্থ বছরে জাটকা ও মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে ৯ লক্ষ ৪৬ হাজার ৬৪৪টি জেলে পরিবারকে মোট ৭০ হাজার ২ শত ৬০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।

এছাড়া ৬৫ দিন সামুদ্রিক মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন গত বছরের ন্যায় ২০২১-২২ অর্থবছরেও দেশের ১৪ টি জেলার ৬৮ টি উপজেলার ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ১ শত ৩৫ টি জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি হারে ১ম কিস্তিতে প্রায় ১৬ হাজার ৭ শত ৯১ মেট্রিক টন ভিজিএফ (চাল) বিতরণ করা হয়েছে।

জনবহুল বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা মিটাতে, কলকারখানার বর্জ্য , ফসলি জমিতে কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে নদী দূষণ এবং অতিরিক্ত মাছ আহরণসহ নানা কারণে দেশি মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও বহু প্রজাতি হুমকির মুখে রয়েছে। মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩টি ছোট প্রজাতির। এর মধ্যে ৬৪টি মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। সরকারের পাশাপাশি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুলোও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবং বিলুপÍ প্রজাতির মাছকে আমাদের খাবার প্লেটে পুণরায় ফিরিয়ে আনতে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

গত ২১ বছরে ৩১টি দেশি মাছের চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করে মৎস্য চাষিদের হাতে তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে চলতি বছরেই ১০টি দেশি মাছের জাত বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করে উৎপাদন বাড়ানোর উপায় বের করা হয়েছে। সফলতার ধারাবাহিকতায় ৩১তম মাছ হিসেবে গত বছরের ২৫ আগস্ট যুক্ত হয় কাকিলা মাছ। এ মাছটির কৃত্রিম প্রজনন বাংলাদেশেই প্রথম।

পাবদা, গুলশা, গুজি আইড়, রাজপুঁটি, চিতল, মেনি, ট্যাংরা, ফলি, বালাচাটা, শিং, মহাশোল, গুতুম, মাগুর, বৈরালি, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা, কালবাউশ, কই, বাটা, গজার, সরপুঁটি, গনিয়া, জাইতপুঁটি, পিয়ালি, বাতাসি, রানী, ঢেলা ও কাকিলা- এই ৩১ প্রজাতির মাছ আবার ফিরিয়ে এনেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এর মধ্যে ট্যাংরা মাছের দুই রকম জাত রয়েছে। প্রায় এক যুগের প্রচেষ্টায় ২০২১ সালের জুন মাসে রুই মাছের নতুন জাত “সুবর্ণ রুই” উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়া মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের লাইভ জিন ব্যাংকে দেশের বিলুপ্তপ্রায় ৮৯ প্রজাতির দেশীয় মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে। গবেষক, চাষি ও উদ্যোক্তারা যেন সহজেই এ মাছগুলো পেতে পারেন- সে কারণেই এ প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গবেষণাকাজে সাফল্য আসায় গত ১১ বছরে দেশি ছোট মাছের উৎপাদন প্রায় সাড়ে চার গুণ বেড়েছে। ২০০৯ সালে পুকুরে চাষের মাধ্যমে দেশি ছোট মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার ৩৪০ টন, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় তিন লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।

আমাদের দেশে মৎস্য উৎপাদনে দেশি ছোট মাছের অবদান শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ। প্রাচীনকাল থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ আমাদের সহজলভ্য পুষ্টির অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে মলা, ঢেলা, পুঁটি, বাইম, টেংরা, খলিশা, পাবদা, শিং, মাগুর, কেচকি, চান্দা ইত্যাদি অন্যতম।

এসব মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে এবং রক্তশূন্যতা, গলগÐ, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।

সর্বোপুরি বলা যায়, মাছ আমাদের দেশে প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমাণ দৈনিক ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে ৪৬ লাখ মেট্রিক টন থেকে ৬৫ লাখ মেট্রিক টনে ও ২০৪০ সালের মধ্যে ৮৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করতে চায়।

খাদ্যনিরাপত্তা সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা। কেবল খাদ্যের প্রাপ্যতা নয়, ব্যালেন্স ডায়েট নিশ্চিত করাই সরকারের লক্ষ্য। কারণ, এটি ছাড়া কখনোই বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। এবং এসডিজি অর্জন করা যাবে না। মৎস্য খাতকে অগ্রাধিকার না দিলে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঁচটি সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) কখনোই অর্জন করা যাবে না। তাই ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে রূপান্তর করতে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে।

লেখক: গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন