পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আওয়ামী-বিরোধী রাজনীতিকে দিয়েছে বিরাট ঝাঁকুনি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভক্তি সর্বজনবিদিত। এই বিভক্তি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে যেমন থাকে তেমনতো নয়ই, এমনকি পাকিস্তানের মতো সামরিক-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতও নয়। পশ্চিমে মূলত দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমান। দু’পক্ষকে মোটাদাগে আলাদা করা না গেলেও ভোটের রাজনীতে বিশেষ করে নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে কারা জনগণকে কত ‘ট্যাক্স বেনিফিট’ দিল কিংবা আরও দু’একটি ‘ফ্যাক্টর’ দিয়ে সেখানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়।
অপরদিকে পাকিস্তানের মতো দেশে যে দল যত সেনাবাহিনী ঘনিষ্ঠ তারাই সরকার গঠন করা থেকে শুরু করে সকল সুবিধা ভোগ করে থাকে। কিন্তু এই দুই ধরনের গণতন্ত্রের কোথাওই একদল আরেক দলকে সমূলে বিনাশ করতে চায় না বা সে চেষ্টাও করে না। সমূলে বিনাশ বলতে গ্রেনেড হামলা করা কিংবা ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বাস্তবায়ন এদেশ ছাড়া আপনি আর কোথাও খুঁজে পাবেন না।
এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা অ্যাকাডেমিক আলোচনায় কখনোই এই প্রসঙ্গটি উঠে আসে না যে, এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্মগত অবস্থানটিই আসলে মূল সমস্যা রাজনৈতিক বিভাজনের। যেমন পাকিস্তানের জন্ম, বিকাশ এবং সফলতাই হলো পাকিস্তান-বিরোধী রাজনীতির মাধ্যমে। অপরদিকে বিএনপি’র জন্ম, বিকাশ এবং সফলতাসহ সকল তৎপরতাই নিহিত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ফেলে যাওয়া রাজনীতি তথা আওয়ামী লীগ বিরোধিতার মধ্যে।
পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যেমন পারলে সেই যুক্তফ্রন্ট সরকারের পর থেকেই আওয়ামী লীগ তথা দলটির নেতৃত্বকে ‘ইলিমিনেট’ বা নিশ্চিহ্ন করে দিতো তেমনই ১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়ার ক্ষমতায় আসা থেকে শুরু করে বিএনপি’র বর্তমান রাজনীতিও আসলে শুরুই হয় আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ফলে এই বিভাজন দূর হওয়ার সম্ভাবনা দূরের কথা সামান্য নিকটে আসার সম্ভাবনাও তৈরি হয় না।
আমরা পদ্মা সেতুর প্রসঙ্গে যদি আলাপ করি তাহলে প্রথম থেকেই আমরা দেখেছি যে, আওয়ামী লীগ তার দিন বদলের সনদ নামের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে যুদ্ধাপরাধীর বিচারসহ পদ্মা সেতুর মত মেগা প্রকল্পকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং ক্ষমতায় এসে এই ‘প্রায়োরিটি’ বাস্তবায়নে অনড় থেকেছে। শত বিরোধিতা ও প্রতিকূলতা পার হয়ে যুদ্ধাপরাধীর বিচারটি সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়েছে দলটি। এখন একে একে মেগা প্রকল্পগুলো উদ্বোধন হচ্ছে, যার প্রথমেই আমরা দেখলাম গত ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলো। এই সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে এদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের একটা বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই সুযোগটি কোনো পক্ষকেই গ্রহণ করতে দেখা গেল না।
আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু নিয়ে যে অবস্থান তা বোধগম্য এ কারণে যে, শুরু থেকেই এই প্রকল্পে যে বাধার সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে কারা জড়িত সেটিতো আর এখন কারো কাছেই অজানা নয়। বেগম জিয়া এই সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না যে টিটকারি দিয়েছেন এবং তারপরে এই সেতু জোড়াতালি দিয়ে সম্পন্ন হলেও তাতে তার নেতৃবৃন্দকে না ওঠার পরামর্শ দিয়ে কেবল হেসেছেন তা নয়, তার দলের সকল ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে সকলকে দিয়ে এই সেতু নির্মাণের বিরোধিতার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এদেশের সুশীল সমাজের একটি বিরাট অংশ।
ঠুঁটো অজুহাত দাঁড় করানো হয়েছে বিশ্বব্যাংককে দিয়ে। পদ্মা সেতুতে সরাসরি দুর্নীতি নয়, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে- এই অজুহাতে বাংলাদেশকে বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম করানো হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারকে দাঁড় করানো হয়েছে নিষ্ঠুর এক বাস্তবতার সামনে। সেই সময় শেখ হাসিনার সরকার যে ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও কৌশলে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ সংশ্লেষণ করেছে তা রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দেবে।
বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশে যা কিনা মূলত আমদানী ও বিদেশি ঋণ-নির্ভর, এরকম একটি বড় প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করা সম্ভব হবে না বলে রায় দিতে তখন কেউই পিছপা হননি। এই না হওয়াপন্থীদের তালিকায় পত্রিকা সম্পাদক থেকে টকশো’র সাংবাদিক যেমন রয়েছেন তেমনই রয়েছেন বিশ্বব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সি করা গবেষকগণও। শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে ‘লোন সোলজার’ বা একাকী সৈনিক।
এমনকি তার দলের অর্থমন্ত্রী এবং তার একজন উপদেষ্টার নামও এখন উচ্চারিত হচ্ছে যারা মূলত বিশ্বব্যাংক তথা তাদেরকে পেছন থেকে ইন্ধন দানকারী নোবেল বিজয়ী’র সঙ্গে আপোস করার ব্যাপারে শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। ফলে শেখ হাসিনার কাছে স্বাভাবিকভাবেই দু’টি পক্ষ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, এক. পদ্মা সেতু যারা চান; আর দুই. পদ্মা সেতু যারা চান না। পদ্মা সেতু যখন সম্পন্ন হয়েছে তখন তিনি প্রকাশ্যেই এই না-চাওয়া পক্ষকে ‘টুস’ করে ফেলে দিতে চেয়েছেন কিংবা পদ্মায় ‘চুবানি’ দিতে চেয়েছেন।
রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি খানিকটা বাড়াবাড়ি করেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তার পক্ষের লোকেরা বলবে যে, তিনিতো আর গ্রেনেড হামলা করে তার রাজনৈতিক তথা পদ্মা সেতুর বিপক্ষে থাকা লোকজনকে হত্যা করতে চাননি। এমনকি সর্বশেষ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি পদ্মা সেতুর বিরোধীদের সম্মন্ধে বলতে গিয়ে একথা জোর দিয়েই বলেছেন যে, কারো প্রতি তার আর কোনো বিদ্বেষ নেই, রাগ নেই।
একজন বিশ্লেষক হিসেবে আমার মনে হয়, এই জায়গাটিতেই পদ্মা সেতুর প্রকাশ্য বিরোধিতাকারীদের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল শেখ হাসিনার এই উদযাপনকে নিজেদেরও রাজনৈতিক অর্জন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার। বিশেষ করে বিএনপি যদি পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে অনুষ্ঠানে গিয়ে সাংবাদিক বা ক্যামেরার সামনে নিজেদের কথা বলতো তাহলে পদ্মা সেতুর ক্রেডিট শেখ হাসিনা বাধ্য হতেন বিএনপি’র সঙ্গেও ভাগ করে নিতে। কিন্তু সেটাতো হয়ইনি, বরং প্রথমে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার দোহাই দিয়ে, তারপর কেবল বিরোধিতার নামে বিরোধিতা করে বিএনপি এই সুযোগটি হাতছাড়া করেই খান্ত হয়নি, উল্টো সেই পদ্মা সেতুতে কত খরচ হয়েছে, কত টাকার দুর্নীতি হয়েছে তার মনগড়া সব তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরতে গিয়ে উল্টো জনগণের বিরাগভাজন হয়েছে।
দেশে যখন কোনো বড় জোয়ার আসে তা দ্রুত সকল মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, পদ্মা সেতু এমনই এক জোয়ার যা সাধারণ জনগণের ভেতর বিপুল সাড়া ফেলেছে। এক্ষেত্রে কে কোন্ দলের সমর্থক সেটা কেউ মানেনি, ‘আমার টাকায় বাংলাদেশের সেতু’ হিসেবে পদ্মা সেতুকে দলমত নির্বিশেষে সকলেই সাড়া দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি এই ট্রেনটিও ‘মিস’ করেছে, কেবল তাই-ই নয়, যখন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর টিকটক-এর মতো সস্তা যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খোলার দৃশ্যকে দলীয় ওয়েবসাইট থেকে বাহবা দেওয়া হয়েছে।
বোঝাই যায় এটা এ কারণে করা হয়েছে যে, তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এ সেতু হলেও হবে জোড়াতালি দিয়ে এবং দেখুন সেটাই হয়েছে, এই মানসিকতা থেকে। একটি জাতীয় স্থাপনা, এতো বিরাট খরচ করে যা নির্মাণ করা হয়েছে, যা এখন জাতীয় সম্পদের অংশ তাকে এভাবে খেলো করাটা যে জনগণ ভালো চোখে দেখছে না তাতো সামাজিক মাধ্যমে জনগণের প্রতিরোধ থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
ওদিকে সরকারও এসব ঘটনায় একটু কঠোর হওয়ার চেষ্টা করছে। উচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পদ্মা সেতুর বিরোধিতার বিষয়টিকে। আমরা দেখতে পাবো যে, অবিলম্বেই দেশের ভেতর পদ্মা সেতুর বিরোধিতাকারীদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের দাবি তোলা হবে। ফলে যে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ তৈরি হয়েছিল তা যেনো আরো উস্কে দিলো এই পদ্মার সেতুর উদ্বোধন। অথচ, দেশের ২১টি জেলার কোটি কোটি জনগণ এই পদ্মা সেতু থেকে সরাসরি উপকৃত হবে এবং দেশের উন্নয়নের চাকা নতুন গতি লাভ করবে সার্বিকভাবে সেটা বাংলাদেশের শত্রুরাও স্বীকার করছে।
এমতাবস্থায় দেশের অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দল যদি এই সত্যকে অস্বীকার করে তাহলে তাদের পিছিয়ে পড়াকে ঠেকাবে কে? সামনেতো আরও কঠিন দিন আসছে, একে একে কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেলসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের সময় এরা কী করবে, কীভাবে জনগণের আনন্দকে ঠেকিয়ে রাখবে সেটা ভেবে এখনই ভয় লাগছে যে, এই উপলক্ষে না দেশে নতুন করে নাশকতা শুরু হয়!
লক্ষ্য করে দেখবেন যে, এক পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করেই কয়েকজন চিহ্নিত সরকার-বিরোধী রাজনীতিবিদের কোনো বক্তব্য গণমাধ্যমে আসেনি গত কয়েক সপ্তাহ, তারা কোথাওই নেই। নাম বললেও আমরা জানি তারা কারা। এমনকি কয়েকজন বিশিষ্ট অধ্যাপক বা বিশ্লেষকের কোনো লেখাও প্রকাশিত হয়নি, তারা ফেসবুকে পর্যন্ত কোনো স্ট্যাটাস দেননি এ ক’দিন। কিন্তু চুপ থাকলেই কি আর মানুষ পদ্মা সেতুর আনন্দ-ঢোল পেটানো বন্ধ রাখবে?
মনে হয় না। মানুষ এখনও উচ্ছ্বসিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে। পরবর্তী উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা এসব মানুষের রাজনৈতিক চিন্তাটি না ধরতে পারলে এই বিরোধী পক্ষের রাজনীতিকে গণ-বিরোধী আখ্যা দিতে কেউ দেরি করবে বলেও মনে হয় না। যদিও আমরা জানি যে, এদেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি ‘জিন্দা’ থাকবেই, কিন্তু একথা হলপ করে বলা যায় যে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন সেই চিরাচরিত আওয়ামী-বিরোধী রাজনীতিতে বিরাট এক ঝাঁকুনি দিয়েছে। দ্যাখা যাক এ পক্ষের ঝাঁকুনি সইবার ক্ষমতা কতটুকু আছে।
ঢাকা ২৮ জুন, মঙ্গলবার ২০২২
লেখক: সিনিয়র, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস