গণমাধ্যম ক্যাপসুলে শিশুরা
মা তার ছোট শিশুপুত্রকে প্রশ্ন করে-বাবা বড় হয়ে তুমি আমির খান হবে নাকি সালমান খান হবে? শিশুপুত্রের সপ্রতিভ উত্তর শের-ই –খান হবো। মা-ছেলের এই কথপোকথন এক সুষ্পষ্ট বক্তব্যের অবতারণা করে-মা বলিউড আসক্ত সিনেমাপ্রেমী, যে কিনা তার ছেলেকে নিজ পছন্দের সুদর্শন নায়ক হিসেবে দেখতে চায়। আর অন্যদিকে শিশুপুত্র হতে চাচ্ছে তার পছন্দের ‘মঙ্গলী-এ জাঙ্গল বয়’-এর বাঘ চরিত্র। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক বা শিশু, নারী কিংবা পুরুষ সকলের বাস্তব জগতে অবাস্তব স্বপ্নের বিচরণ, আর গণমাধ্যমের প্রভাবের প্রতিফলন।
শিশুদের ওপর গণমাধ্যমের প্রভাব- পুনঃ পুনঃ এ আলোচনার চর্বিত চর্বনে বিষয়টি কারো কারো কাছে একদিকে যেমন হয়ে গেছে গৎবাধা কিছু কথা তেমনি অন্যদিকে আন্দোলিত হচ্ছে সমাজের কোন অংশ, উৎসুক হচ্ছে প্রভাবের ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক উৎঘাটনে, সচেতন হচ্ছে শিশুদের জন্য গণমাধ্যমের আধেয় নির্বাচনে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, গণমাধ্যমের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি নেই শিশু সমাজের। এর প্রভাবন ক্ষমতা জিলাপী নয় বরং আমিত্তির মতো জটিল-কোথা থেকে শুরু আর কোথায় শেষ তা বুঝে ওঠার আগেই সুস্বাদু মিষ্টি স্বাদ গ্রাস করে রুচিবোধকে।
আজকের যুগে গণমাধ্যমের এই প্রভাব প্রতিপত্তি এতোই বিস্তার লাভ করেছে যে, আমরা যেন গণমাধ্যমেরই এক ক্যাপসুলের বাসিন্দা। ক্যাপসুলের মতো আমাদের চারপাশে সৃষ্টি হয়েছে বলয়। এ বলয় হরেক রকম হরেক মাধ্যমের। যেমন-রেডিও- টেলিভিশন-সংবাদপত্র, অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক ও মুদ্রণ মাধ্যম এবং বলয়ের অনন্য আরেক উপাদান আউটডোর মাধ্যম যা মূলত পুঁজিবাজারের অনন্য প্রচারণা বিজ্ঞাপনের ধারক ও বাহক। এই যখন বাস্তবতা তখন একটি শিশু প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠছে গণমাধ্যম নির্ভর সামাজিকীরণের মধ্য দিয়ে।
এবার দেখা যাক শিশুর সামাজিকীকরণ তথা সামাজিকতায় শিশুর ওপর কার্যকরী প্রভাবগুলোর অস্তিত্ব বা অবস্থান কোথায় এবং কেমন? জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের শিক্ষার প্রয়োজন। এই শিক্ষা শিশু তার পরিবার এবং সমাজের কাছ থেকে গ্রহণ করে। সমাজবিজ্ঞানীর মতে, শিশুরা হল সাদা কাগজের মত। এই কাগজে সমাজ যেভাবে আঁচড় কাটে, পরবর্তীসময়ে তারই মত করে শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশ লাভ করে। সমাজ চাইলে তাকে বিশাল বৃক্ষ বানাতে পারে আবার বনসাইও বানিয়ে রাখতে পারে। শিশু বিকশিত হয় সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে। সামাজিকীকরণ ছাড়া মানুষ তার জীবনে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না।
অন্যদিকে সামাজিকীকরণের মূল্য বোঝাতে বলা হয়, সামাজিকীকরণ না থাকলে মানব সমাজ এক পুরুষের বেশি টিকত না। সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ায় তিনটি স্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ- জীবনের প্রাপ্তি-ব্যক্তির ধারণ ও গ্রহণের ক্ষমতা, পারিবারিক পটভূমি-প্রাথমিক শিক্ষাকাল ও চলমান সামাজিকীকরণ-আমৃত্যু ক্রিয়াশীল।
শিশুর বেড়ে উঠার পরিবেশ ও শৈশবের অভিঙ্গতা তার পরবর্তী জীবনকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। ফ্রয়েডের মতে চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই আমাদের ব্যক্তিত্বের কাঠামো তৈরি হয়ে যায়। এবং সারাজীবন তা সে আদলেই চলে। এ সময়টা শিশু তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটায় বলে শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। ফ্রয়েড সামাজিকীকরণকে সমাজের জন্য ব্যক্তিগত আনন্দকে বিসর্জন দেবার প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন। সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে তিনি মানুষের মনকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, সামাজিকীকরণ অবদমনের মাধ্যমে ত্বরান্বিত হতে পারে।
শিশুর ওপর গণমাধ্যমের প্রভাব বিষয়ক আলোচনায় সামাজিকীকরণের প্রভাবকের উপর আলোকপাত করা বিশেষ প্রয়োজন। আর সামাজিকীকরণের পথে প্রধান নিয়ামকই যদি গণমাধ্যম তবে তাতে শিশুর সামাজিকীকরণ অপেক্ষা মাধ্যমীকরণই বেশি ঘটে।
আজকের শিশুরা শুনতে চায় না ঠাকুরমার ঝুলির গল্প বরং চায় সিডি-ডিভিডি থেকে তা উপভোগ করতে। যথার্থই বলেছেন-হাঁটবে চলবে কথা বলবে, ঠাকুরমার ঝুলি খুলবে। আমাদের শৈশবের হামদো আর মামদো ভূত গেছে হারিয়ে। আজ সেখানে স্থান করে নিয়েছে ব্রাক্ষ্ম ভূত আর শাকচুন্নী। আজকের শিশুটি বিজ্ঞাপনের দারুণ পোকা আর বিজ্ঞাপিত পণ্যের ভোক্তা।
কোমলমতি শিশুরা বাস্তবজগৎ থেকে গণমাধ্যমের জগৎকে পৃথক করতে পারছে না বলেই পরিণত হয় মাধ্যম প্রভাবকের দাসে। অন্যদিকে গণমাধ্যম আজ শিশুর জ্ঞান বা তথ্য জগতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কখনো কখনো সামাজিকীকরণের প্রথম ও প্রধান প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকেও বেশি শক্তিধর প্রতিষ্ঠান এই গণমাধ্যম। শিশুদের বর্ণমালার সাথে আজ পরিচয় ঘটে গণমাধ্যমের বদৌলতে। আয় আয় চাঁদ মামা আজ মায়ের চেয়ে বেশি ক্যাসেটে গেয়ে চলে। শিশু তার জগৎকে দেখে অভিভাবকের চোখে নয় বরং টেলিভিশনের স্ক্রিনে।
কোনো শহর কিংবা গ্রামে, ধনী কিংবা দরিদ্র সকল শিশু তার নিজের অজান্তেই আচরণ করে চলেছে গণমাধ্যমের কোনো বিশেষ পছন্দের চরিত্রের মতো। সমাজ-পরিস্থিতি-বাস্তবতা তার কাছে প্রায়শই ফ্যান্টাসিতে ভরা। আজ নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেটিও স্বপ্ন দেখে কোটিপতি হওয়ার। এমনকি আমার ছেলেটি রেগে গিয়ে বলে ঘাড় মটকে দেব। (যা কিনা ঠাকুরমার ঝুলির ডায়ালগ) এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, গণমাধ্যম কিভাবে এবং কি মাত্রায় গিলে খেয়েছে এবং খাচ্ছে শিশুর মনকে; কখনো বা বাধাগ্রস্থ করছে শিশুর সুকুমার বৃত্তির পরিস্ফূটনে।
গণমাধ্যম কেবলমাত্র আমাদের বিদ্যমান ধারণা বা বিশ্বাসগুলোকেই আরো জোরালো করতে সক্ষম। অর্থাৎ গণমাধ্যম প্রদর্শিত সহিংসতা একজন অহিংস শিশুকে সহিংস করে তুলবে বিষয়টি তা নয়। তবে যদি কোনো শিশুর পরিবেশ-পরিস্থিতি সহিংস আচরণের অনুকূলে থাকে অথবা সহিংস হওয়া সত্ত্বেও শাস্তির পরিবর্তে ক্ষমা অথবা কোনোরুপ বাহবা পাওয়ার সুযোগ তাকে, তবে সে শিশুর সহিংস মনোভাব উস্কে উঠতে পারে।
তাই গণমাধ্যম যদি ক্রমাগত সহিংসতা প্রদর্শন করে তবে শিশুর পৃথিবী হয়ে ওঠে অপরাধ সহিংসতায় ভরপুর আর গণমাধ্যম যদি তাকে দিতে পারে সহমর্মিতা, সহনশীলতা এবং সহযোগিতার ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মাধ্যম জগৎ, তবে শিশুর মানসপটেও তা আঁচড় কাটবে ভালোবাসার রঙে। শিশুর পৃথিবী হয়ে উঠবে সুন্দর, রঙিন, মানুষের প্রতি আস্থা ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/এমএস