ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

গণহত্যা ১৯৭১: পঞ্চভাস্করের যাত্রা

মুনতাসীর মামুন | প্রকাশিত: ০২:১৩ পিএম, ২০ মে ২০২২

আজ ২০ মে জাতীয় জাদুঘরে গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে এক বিশেষ ভাস্কর্য প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হচ্ছে। গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ৩৮টি ভাস্কর্যের প্রদর্শনী এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। পাঁচজন ভাস্কর এগুলি নির্মাণ করেছেন। তারা হলেন রেহানা ইয়ামিন, রবিউল ইসলাম, ফারজানা ইসলাম মিলকি, মুক্তি ভৌমিক ও সিগমা হক অংকন।

পঞ্চভাস্কর মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। গণহত্যা-নির্যাতনের কথা শুনেছেন কিন্তু বিষয়টি অপরিচিত। গণহত্যার সঙ্গে তাদের পরিচয় গণহত্যা-নির্যাতনের ছবি দেখে। আর এই ছবিতে দেখা বিষয়গুলিই শিল্পরূপ দিতে চেয়েছেন ভাস্কর্যে। এ বিষয়টি লেখা যত সহজ কাজটি তার চেয়েও কঠিন। চিত্রকলায় আলোকচিত্র, একেবারে আলোকচিত্রের প্রতিরূপ সম্ভব। ভাস্কর্যে নয়। সেখানে বিন্যাস, গঠন আলাদা, ফিগারের রেখা আলাদা, পোড়ামাটির সঙ্গে তফাৎ ধাতু ব্যবহারের।

পঞ্চভাস্কর নির্বস্তুকতার পথে হাঁটেননি, দর্শকদের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ করা যায় তাই এমন বিন্যাস বা গঠন বেছে নিয়েছেন যা দর্শকদের কাছে অচেনা ঠেকবে না। আমার মনে হয়েছে প্রদর্শিত ৩০টি ভাস্কর্য দেখলে দর্শকরা ১৯৭১ সালের গণহত্যা-নির্যাতনের বেদনা মর্মে মর্মে অনুভব করবেন।

প্রদর্শনীতে আছে দু’ধরনের ভাস্কর্য- মাটি ও ধাতু। এছাড়াও হামিদুজ্জামান ও রোকেয়া সুলতানার দুটি ভাস্কর্যের ক্ষুদ্র সংস্করণ প্রদর্শিত হচ্ছে। এদুটির মূল সংস্করণ প্রদর্শিত হচ্ছে গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘরে।

প্রদর্শিত ভাস্কর্যগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য-সবগুলি আকারে ছোট। এক ধরনের সাযুজ্য আছে সবগুলির মধ্যে। ক্ষুদ্র পরিসরে বিন্যাস করা দুরূহ যদি সেখানে ডিটেইলস থাকে, যেটি প্রযোজ্য নয় হামিদুজ্জামানের ‘গণহত্যা’, রোকেয়া সুলতানার ‘শহীদ সন্তান কোলে মা’ বা রবিউল ইসলামের ‘নৌকা যাত্রা’র ক্ষেত্রে। সেগুলির স্পেস সীমিত আকারের নয়। শিল্পী সেখানে নিজের ইচ্ছেমতো বিন্যাস করতে পেরেছেন।

মাটি বা টেরাকোটার কাজ বাংলার এই অংশের ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য। এখানে পাথর বা ধাতু সহজলভা না থাকায় পুরণো আমলের ভাস্করদের অধিকাংশ কাজ করতে হয়েছে মাটি ব্যবহার করে। প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলিতে এর প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই প্রদর্শনীতে এ মাধ্যমে কাজ করেছেন রেহানা ইয়াসমিন ও রবিউল ইসলাম। বাকীরা ধাতুতে।

পঞ্চভাস্করের মধ্যে রেহানার কাজ খানিকটা ব্যতিক্রমী এ অর্থে যে, গণহত্যার চিত্র তার কাজের মূল ভিত্তি হলেও ঠিক অবিকল প্রতিরূপের কথা ভাবেন নি। কল্পনা যুক্ত হয়েছে যার উদাহরণ এতটুকু স্পেসে ডিটেলসের ব্যবহার। ধরা যাক ‘গণহত্যা যত্রতত্র’ অমিয় তরফদারের ফটোগ্রাফটি সবার অতি পরিচিত। এর প্রথম ভাস্কর্য রূপ দিয়েছিলেন হামিদুজ্জামান। রেহানা সেখানে পার্থক্য এনেছেন ঠেলাগাড়ি ব্যবহার করে। বিন্যাসটিও বদলে দিয়েছেন। গণহত্যার এরূপও ছিল যার কোনো আলোকচিত্র পাওয়া যায়নি- এমনটি মনে হতে পারে।

‘৭১-এর দুঃখ’ ভাস্কর্যটি দেখুন। মূল দুটি ফিগারের আদিরূপ পিয়েতা। কিন্তু, বিন্যাসটি অপূর্ব। তৃণমূল গণহত্যার একটি উদাহরণ। সাধারণ মানুষের সাধারণ বাড়ি, নোনাধরা দেয়াল, বন্ধ দরজা। হয়ত সন্তান বেরিয়েছিল বাইরে। গুলিতে শহিদ। অসহায় মা কী করবেন জানেন না। মা সিঁড়ির ওপর বসে। একটি ধাপে ছেলেটির দুটি স্যান্ডেল। গুলিতে বোধহয় একটি ইট খসে পড়েছে। গণহত্যার একটি স্থিরচিত্র যেন।

একই ধরনের কাজ ‘নারীর হাহাকার’। তৃণমূল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি পাঁচলক্ষের ওপর নারীকে ধর্ষণ করেছে। হয়ত মফস্বলের সাধারণ বাড়ির ভেতর ঢুকেছিল পাকিস্তানিরা, ধর্ষণ করেছে দু জনকে। একজন নির্যাতনে মৃত। আরেকজন মুমূর্ষ। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে ধর্ষণ করেছে তার প্রতীক হিসেবে আছে একটি বুট। ‘অনিশ্চিত যাত্রা’য় শরণার্থীরা যা আমরা তখন দেখেছি। প্রতিটি ফিগার আলাদাভাবে চিন্তা করে তৈরি করা হয়েছে যাতে তাদের বাস্তুত্যাগের যন্ত্রণা, অনিশ্চিত যাত্রার উদ্বেগ, আশঙ্কা সব ফুটে ওঠে। ডিটেলসে কাজ।

রবিউলও এ থিম নিয়ে বড় ধরনের কাজ করেছেন যা দেখে দর্শক মুগ্ধ হবেন। রায়ের বাজার বধ্যভূমি বা সাধারণ বধ্যভূমি নিয়েও ভাস্কর্য আছে একটি। রেহানার কাজের পেলবতা লক্ষ্যণীয়। মনে হতে পারে, গণহত্যার সঙ্গে পেলবতা সাংঘর্ষিক। কিন্তু টেরাকোটার কারণে হয়ত এসেছে তা এবং দেখতে তা ভালোই লাগে। বৈচিত্র্য এসেছে মাটি পোড়ানোয়। পোড়ানোতে রংয়ের বৈচিত্র্য আনা অনেক সময় দুরূহ। শিল্পী অনেক সময় তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। যে পেলবতার কথা উল্লেখ করেছি তা এসেছে বিন্যাস ও পোড়ানোর পর রংয়ের নানা শেডের জন্য।

টেরাকোটায় সাদা মাটি ব্যবহার করেছেন রবিউল যা রেহানার কাজের বিপরীত। গণহত্যা-নির্যাতনের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা রবিউলের উদ্দেশ্য। সে জন্য তিনি এমন সব ঘটনা বেছে নিয়েছেন যা এখন বিস্মৃত। আলোকচিত্রের মুখাপেক্ষী তিনি হননি। একটি মাত্র ভাস্কর্য চিত্রের অনুলিপি যেখানে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনির এক সৈন্য একজনের ধর্ম নির্ণয়ের জন্য গোপনাঙ্গ পরীক্ষা করছে। ভাস্কর্যের শিরোনাম ‘অস্তিত্বের পরীক্ষা’ মতান্তরে এটি ভারতীয় বাহিনির একজন দুস্কৃতিকারী সন্দেহে একজনকে পরীক্ষা করছে। কিন্তু, ঘটনা মিথ্যা নয়, হানাদার বাহিনির এ ধরণের পরীক্ষার সম্মুখীন অনেককে হতে হয়েছে। বাকি ভাস্কর্যগুলিতে ফুটে উঠেছে যা তিনি শুনেছেন তার ওপর ভিত্তি করে। তার ভাস্কর্যে মনে হতে পারে পরিপ্রেক্ষিত কি ঠিক আছে? রবিউল পরিপ্রেক্ষিত, নিখুঁত ফিগার নিয়ে ভাবেননি।

তিনি নির্মমতা ফুটিয়ে তোলার জন্য ঘটনাটা বিন্যাস করেছেন। ফিগারে ভয়াবহতা/অসহায়তা ফুটিয়ে তোলার জন্য সিলিন্ডিরিকাল গঠন ব্যবহার করেছেন। ধরা যাক ‘ভূলুণ্ঠিত মানবতা’ এর বিন্যাস সামঞ্জস্যবিহীন মনে হতে পারে কিন্তু তা ইচ্ছাকৃত। বুটজুতার লাথির অবমাননাকর পরিস্থিতি ফুটিয়ে তোলার জন্য যথেস্ট। সামনের ফিগারটি বাহুল্য মনে হতে পারে কিন্তু নির্যাতনের ব্যাপকতা ও বিন্যাস ভারসাম্য আনার জন্য তার সৃষ্টি।

‘বীভৎসতার’ ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। অবিকল চিত্ররূপ যাতে না হয় সে জন্য ফিগারের বিকৃতি ঘটিয়েছেন। ‘একাত্তরের বর্বরতা’ ও ‘নির্মমতা’ ৭১-এ গণহত্যার ভয়াবহতা সবাইকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ভাস্কর্যগুলিতে যাতে বলিষ্ঠতা আসে সে জন্য সাদা মাটি ও উচ্চমাত্রার চাপ ব্যবহার করেছেন।

মুক্তি, মিল্কি ও অংকন এর মাধ্যম ধাতু। ভাস্কর্যে কি রেখা খুব প্রয়োজনীয়? সেটি নির্ভর করে ভাস্করের ওপর, মুক্তি ভৌমিকের সাতটি কাজ দেখে মনে হয় রেখা ভাস্কর্যে গুরুত্বপূর্ণ। অ্যালুমনিয়ামে নির্মিত তাঁর ভাস্কর্যগুলি এর উদাহরণ। অনিশ্চিত যাত্রা বিখ্যাত একটি চিত্রের ভাস্কর্যরূপ, এক সারিতে চলছে পরিবার। পরিপাটি রেখা বোঝা যায় ফিগারগুলি দেখলে ইংরেজিতে যাকে বলা যেতে পারে ‘নিট’। হানাদার ‘পাকিস্তানি বাহিনিরা কেমন ছিল-২’ রবিউলের বিষয়ের সঙ্গে মিল থাকলেও বিন্যাস অন্যরকম, পরিপাটি, পরিপ্রেক্ষিতও সঠিক। সেদিক থেকে শরণার্থীর যন্ত্রণা খানিকটা জবরজং ঠেকতে পারে। সেটিও বিখ্যাত এক চিত্রের চিত্ররূপ। কিন্তু গণহত্যা ও বীরাঙ্গনা গণহত্যা-নির্যাতনের ধ্রুপদীরূপ। গণহত্যা বীরাঙ্গনা দুটিই বিখ্যাত আলোকচিত্রের ভাস্কর্যরূপ কিন্তু আলোকচিত্র থেকে ব্যঞ্জনাময়। বীরাঙ্গনার যে গঠন অনেক সময় তা ক্রশবিদ্ধ যীশুকে মনে করিয়ে দেয়। ধর্ষনের যন্ত্রণা তো তার থেকে কম নয়। গণহত্যার যে ভাস্কর্য তাও অভিব্যাক্তিময়। অন্যদিকে জয় বাংলা বিজয়ের যথার্থরূপ। মফস্বলের রাস্তায় ভ্যানটি দাঁড়িয়ে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। পতাকা সে কথা বলে দিচ্ছে। হয়ত এখনিই বাকি চারজন যুদ্ধশেষে জয় বাংলা বলে ঘরে ফিরবে।

মিল্কিও ভাস্কর্য গড়েছেন গণহত্যা ও শরণার্থী নিয়ে। তাঁর একটি কাজ যশোরের এস এম শৃফির একটি চিত্রের ভাস্কর্যরূপ। ‘একাত্তরের নারী’ বিষয় হিসেবে অন্যদের থেকে আলাদা। ফিগার তার রীতিবদ্ধ। শরণার্থী বা গণহত্যার যে কোনো ফিগার তার উদাহরণ। খানিকটা বড় আকারের ‘বীরাঙ্গনা’। দূর থেকে দেখলে মনে হবে ঘরে একটি পিণ্ড। কাছে থেকে বোঝা যায় ধর্ষিতা এক নারী অধোবদনে বসে আছে। মনে হচ্ছে, নিয়তিকে মেনে নিয়েছে। শরণার্থীর ভাস্কর্যটি অন্যান্যদের শরণার্থী বিষয়ক ভাস্কর্য থেকে আলাদা এ অর্থে যে, বিন্যাসে ফিগারগুলি ঘন সন্নিবিষ্ট।

অংকনও শরণার্থী হিসেবে যেটি নির্মাণ করেছেন সেখানে স্পেস নিয়ে কাজ করেছেন। ফিগার রীতিবদ্ধ নয় যেমনটি মিল্কির। তবে রিকশা ও ঠেলাগাড়ি নিয়ে গণহত্যার যে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন তা অনবদ্য। বিশেষ করে ঠেলাগাড়ি। অন্যদিকে, ঐ একই বীরাঙ্গনা [আলোকচিত্র যা আগে উল্লেখ করেছি] অংকনের উপস্থাপনা বেশি বাস্তবানুবাগ। মুক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত। আমার ভালো লেগেছে একই আলোকচিত্র নিয়ে তিনজন তিনভাবে বিন্যাসটিকে চিন্তা করেছেন কিন্তু তিনজনের বীরাঙ্গনাই বৈশিষ্ট্যময়। আমি চিত্রসমালোচক নই যে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রত্যেকের বিন্যাস, গঠন, রেখা, টেক্সচার প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করব। সাধারণ দর্শক হিসেবে বলব, এই প্রথম একই সঙ্গে গণহত্যা নিয়ে [দুটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক] ৩৮টি একই আকারের ভাস্কর্য প্রদর্শনী হচ্ছে। এর বৈশিষ্ট্য ভাস্কর্যবিদদের পাঁচজন নারী ও দু’জন পুরুষ। হামিদুজ্জামান ও রোকেয়া বাকিদের শিক্ষক। তাদের বাদ দিলে প্রায় সমপ্রয়াসীদের এমন প্রদর্শনী আগে হয়নি অন্তত গণহত্যা বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। একেতো ভাস্কর্যের ওপর এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে তারপর নারীরা ভাস্কর্য করছে এটি সাধারণ সমাজের পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। কিন্তু সম্মিলিতভাবে অলিখিত বাধা নিষেধ তারা ভেঙ্গেছেন চমৎকার সব কাজ নিয়ে। বাংলাদেশের ভাস্কর্যে এরা এক নতুন ধারার নবজোয়ার সৃষ্টি করলেন যে জোয়ার অনেককে ভাসিয়ে নেবে।

লেখক: ইতিহাসবিদ, বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর