ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

লংকার শঙ্কা! যদি, তবে, কিন্তু!

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৯:৩৬ এএম, ১৩ মে ২০২২

আমিনুল মজলিশ

বর্তমানে ফেসবুক থেকে গণমাধ্যম, কি ভার্চুয়াল, কি অ্যাকচুয়াল, গলি থেকে রাজপথ, রাজনীতি অর্থনীতি, প্রায় সব ক্ষেত্রেই জোরেসোরে চলছে শ্রীলঙ্কার আলোচনা, সমালোচনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তুলনা। বিশ্লেষকদের মধ্যে ঠিক কতজন মোহমুক্ত বিশ্লেষণ করতে পারেন, আবার নির্মোহ আলোচনা হলেই বা রাষ্ট্র সবসময় সেগুলো কতটা আমলে নেয় এসব হয়তো বড় পরিসরে আরেকটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তবে আমজনতা যাদের বিশ্লেষণের সময় কম, নিশিদিন রুটি-রুজির চিন্তা তাদের মনেও কিন্তু এরই মধ্যে উঁকি দিচ্ছে লংকার শঙ্কা।

সংখ্যার বিচারে লঘু গুরু যাই হোক না কেন, হাটে-বাজারে, অন্দরে-বাহিরে, বিভিন্ন আড্ডায় একেবারে চায়ের কাপে ঝড় তোলার মতো না হলেও শ্রীলঙ্কার আলোচনা কিন্তু প্রায়শই জায়গা করে নিচ্ছে। এ যেন প্রচারেই প্রসার! ভেতরের বস্তু কতটা সাড় কিংবা অসাড়, তার ধার ধারে কজন।

এই যেমন- অতিকায় হস্তিসম প্রায় অর্ধনগ্ন এক ব্যক্তিকে ফেসবুকে রাজাপাকসের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো, আর তাতেই শুরু হলো মন্তব্যের ঝড়! পরে বিবিসি’র সাংবাদিক আকবর হোসেন তার ফেসবুক পোস্টে জানালেন, ব্যক্তিগত তাগিদে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেই বিশালাকার ব্যক্তির সাংবাদিক পরিচয়টি তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি।

যাই হোক, দেশটিতে জনরোষের যে চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে ফুটে উঠেছে তা তথ্য-প্রযুক্তির বাস্তবতায় বারবার চোখে দেখা গেলেও সবসময় মুখে আনা যায় না। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী অনেক ক্ষমতাসীনদের করুণদশা পৃথিবী দেখেছে কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতার দ্বারা মন্ত্রী, এমপি তথা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দিগম্বর, বস্ত্রহরণ কিংবা জলে নিক্ষেপ, বাসভবনে অগ্নি প্রজ্বলন করার দৃশ্য কে কবে দেখেছে তার জন্য হাতরাতে হবে স্মৃতি, ঘাটতে হবে নথি।

কেউ কেউ বলছেন শ্রীলঙ্কার ঘটনায় দেশে একদল কিছুটা পুলক অনুভব করছে! হতে পারে। রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন যাদের বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান তাদের ক্ষোভ প্রশমনে আলোর ইশারা অনুসন্ধান তো দোষের নয়, হয়তো খোশের, কিংবা জোশের। কিন্তু বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন কতটা সুখের কিংবা অসুখের?

নিত্যপণ্য অগ্নিমূল্য এসব পুরোনো কাসুন্দি সবাই ঘাটতে ঘাটতে ক্লান্ত তাই এখন গণমাধ্যমও বোধহয় শুধুই নিয়ম রক্ষার আলোচনায় ক্ষান্ত। দেশের আনাচে কানাচে হাজার হাজার লিটার সয়াবিন জব্দ হচ্ছে প্রতিদিন। ‘ব্যবসায়ীরা বিশ্বাসঘাতক’- বাণিজ্যমন্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তি, কিন্তু তাতে কতটা মিলছে মুক্তি।

শ্রীলঙ্কার করুণদশার পেছনে যে কয়টি কারণ বলা হচ্ছে তার অন্যতম হলো পর্যটনে অনটন, রেমিট্যান্সে ধীরগতি, শাসক দলের স্বজনপ্রীতি, ভুলনীতি, দুর্নীতি। মেগা প্রকল্পের সুফল ঘরে তুলতে না পারার পাশাপাশি অর্গানিক চাষের উচ্চাভিলাসী সিদ্ধান্তে যখন কমেছে কৃষির ফলন, তখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বাড়তি আমদানি ব্যয় হয়েছে ললাট লিখন। পরিণতিতে কমেছে রিজার্ভ, বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। ফলে উচ্চ মাথাপিছুর অর্থনীতির মাথা নিচু হতে খুব একটা সময় লাগেনি।

এবার দেখা যাক কি বলছে আমাদের অর্থনীতির হালনাগাদ। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ের লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৯১ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। এ সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। আর আমদানি বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।

অন্যদিকে, এই ৯ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৫৩০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের ৯ মাস শেষে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪০৭ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার (৯ মে ২০২২, দৈনিক সমকাল)। আসলে বাংলাদেশ বরাবরই বাণিজ্য ঘাটতিতে থাকে তবে ইতিপূর্বে সেই ঘাটতিতে স্বস্তি জুগিয়েছে প্রবাসী আয়। কিন্তু এবার কোভিড সেখানে সৃষ্টি করেছে অন্তরায়, তাই রেমিট্যান্সেও ভাটার টান।

আবার কোনোভাবেই ধরে রাখা যাচ্ছে না টাকার মূল্যমান। যদিও এখন পযর্ন্ত মেগা প্রকল্পের কুফল পরিলক্ষিত হচ্ছে না; তবে অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের ধীরগতি অর্থনীতিতে বাড়িয়েছে দুর্গতি। সঙ্গত কারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নতুন প্রকল্পের পরিবর্তে বিদ্যমান অবকাঠামোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করছেন।

এরই মধ্যে অনেক কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত, বর্তমানে প্রায় পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ রয়েছে। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ ও কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (১২ মে, দৈনিক প্রথম আলো)।

পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত- দামি গাড়ি ও নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার সময় এখন ৭৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম জমা দিতে হবে। এছাড়া শিশুখাদ্য, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, ওষুধ, কৃষি ও রপ্তানিমুখী শিল্প ছাড়া সব আমদানিতে ৫০ শতাংশ অর্থ আগে দিতে হবে। আগে ২৫ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েই এসব পণ্য আমদানি করা যেত।

তবে, করোনাভাইরাস সামলে ওঠার ক্ষেত্রে বিশ্বের যে দেশগুলো সবচেয়ে ভালো করছে, সেই তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে। এছাড়া আশাপ্রদ তথ্যের একটি হচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে।

জুলাই থেকে মার্চ সময়ে ১৬৮ নিট এফডিআই পেয়েছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৭ শতাংশ বেশি। আবার রপ্তানিতেও দৃশ্যমান হচ্ছে আলোর রেখা, চলতি অর্থবছর শেষ হতে এখনও বাকি দুই মাস। এর মধ্যেই অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছেছে রপ্তানি আয়। অর্থাৎ ১০ মাসেই গোটা অর্থবছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলো। গত জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে চার হাজার ৩৩৪ কোটি ডলারেরও বেশি। চলতি অর্থবছরের মোট রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ৩৫০ কোটি ডলার।

পড়শির ঘরে চুরি হলে নিজ গৃহে পাহারা জোরদার করা দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পেয়ে আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া দোষণীয় নয় বাঞ্ছনীয়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানাবিধ সমীকরণ থাকে, যুক্তি পাল্টা যুক্তি, কথার পিঠে কথা, সবটাই আবার কথা নয়, অনেক কিছু কেবলই কথার কথা। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাকামীদের মসনদে যেতে কিংবা মসনদ টিকিয়ে রাখতে অনেক কথাই বলতে হয়, সব কিছু ধর্তব্যও নয়। তবে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র উপস্থাপনে মনগড়া, মনকাড়া, মাঠগরম করা তথ্য-উপাত্তে বাড়ে বিপত্তি, আর তাতে মূল্য দেয় পুরো জাতি। যাদের অধিকাংশের মাথায় ধরে না কোন জিডিপি কিংবা মাথাপিছুর হিসাব আখেরে তাদের ভোগান্তি-ই বাড়ে হারে হারে। তাই প্রশ্ন উঠছে ঘুরে ফিরে, নীতিনির্ধারকদের উত্থাপিত পরিসংখ্যান প্রতিনিয়ত জ্যেতি ছড়াচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে কতটা গতি আসছে অর্থনীতির ঘটে।

বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা বলছে, শ্রীলঙ্কার উদভূত পরিস্থিতি আসলে কেবল সরকারের পতন নয় রাষ্ট্র পতন, সরকার পতন হলে বিকল্প সরকার এসে ক্ষমতা নেয় কিন্তু রাষ্ট্রের পতন হলে তা সহসাই ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। তাই প্রতিরোধ করতে হবে হুজুগের সুযোগ। সংকট সমাধানে সময়োপযোগী সমন্বিত উদ্যোগ নিলে একদিকে সব শঙ্কা অমূলক হবে। অন্যদিকে সবধরনের যদি, কিন্তু, তবে, মিথ্যা প্রমাণিত হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন