শ্রীলংকার সাম্প্রতিক সংকট ও খাস দিলে বাংলাস্তানিদের প্রসঙ্গ
(পর্ব-২)
নয়.
দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকার পর সম্ভবত পাকিস্তানও একই পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। আমি ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান বিরোধী। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি কোনোদিনও ভেঙে গেলে কিংবা শ্রীলংকার মতো পরিণতি বরণ করলে আমি দাওয়াত দিয়ে মানুষ খাওয়াবো। তবে সেই কারণে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমি অমন মন্তব্য করছি না। কোন দেশের জিডিপি আর ঋণের রেশিও যদি ৪০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হয় তখন অর্থনীতির বিবেচনায় ধরে নেওয়া হয় যে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার পথে এগোচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রেশিওটি ২২ শতাংশ আর শ্রীলংকার ১০৪। পাকিস্তানের বেলায় কিন্তু রেশিওটি বিপৎসীমা ছাপিয়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৪১ শতাংশে। চীনের সহায়তায় পাকিস্তান যে পাকিস্তান চায়না ইকোনমিক করিডোরটি নির্মাণ করছে তা এরই মধ্যে তাদের জন্য গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে। তার ওপর যোগ হয়েছে আরও একদফা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মেয়াদের মাঝপথে এসে গদিচ্যুত হয়েছে পাকপ্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজি। চীনের ডেবট ট্র্যাপে পা দিয়ে ডেথ ট্র্যাপের অন্ধকারে ডুবতে বসা এ দুটো দক্ষিণ এশীয় দেশই এই অঞ্চলে চীনের সবচাইতে বড় বন্ধু।
পাকিস্তানের সাথে চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। একাত্তরে পাকিস্তানের সমর্থনে চীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের ভেটো প্রয়োগ করেছিল। আর শ্রীলংকার বিষয়টি যারা জানেন না, তাদের অবগতির জন্য মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারত তার আকাশপথ পাকিস্তানি বিমানের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও, চীনের মিত্র পাকিস্তানিদের বিমান চলাচলের জন্য নিজ আকাশসীমা উন্মুক্ত রেখেছিল শ্রীলংকা। সে কারণেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আকাশপথে ঢাকায় নিয়মিত সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে। অথচ চীনের ঘনিষ্ঠতম এই দুই মিত্রই আজ চীনা মার্শাল আর্টের প্যাঁচে কুপোকাৎ। তারা বুঝতে পারেনি যে কখন সুই বেশে ঢুকে তাদের জন্য ফাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অমন বিশ্বস্ত বন্ধুটি।
দশ.
শ্রীলংকার এমন পরিণতিতে অবশ্য চোখ কান খুলে গেছে অনেকেরই। মালয়েশিয়া সরকার সম্প্রতি চীনের একটি বড় ঋণ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নেপাল সরকারও এই কদিন আগেই। কাঠমান্ডু সফররত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঋণ প্রস্তাবে সাফ না জানিয়ে দিয়েছেন সে দেশে তার কাউন্টার পার্ট।
এগার.
এত কিছু বলার আর লেখার মানে কিন্তু এই নয় যে এর মাধ্যমে চীন বা কোন বিশেষ দেশের পক্ষে বিপক্ষে কোন মতামত সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সময় থেকেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রনীতিতে কারও প্রতি বৈরিতা বর্জন করা হয়েছে। বর্তমান পুঁজিবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থায় চীনকে বাদ দিয়ে কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সফল হতে পারে না। এমনকি ভারতের সাথেও চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুবই দৃঢ়, তা লাদাখের পাহাড় চূড়ায় দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের মধ্যে যত হাতাহাতি আর ফাটাফাটিই চলুক না কেন। চীনকে দোষ দেওয়ারও কিছু নেই। বাণিজ্যে জিতলেই বণিকের বসতি লক্ষ্মী। আমি বোকার মতো বাণিজ্য করবো আর আমি হারলে বণিকের দোষ, এমন ঢালাও দোষ দেওয়াটাই কিন্তু দোষের।
বারো.
এত কিছুর পরও আমাদের শ্রীলংকা হওয়ার আশংকা কি একেবারেই নেই! অস্বীকার করার উপায় নেই যে তেমন একটি তাত্ত্বিক শংকা নিশ্চই আছে। যদি বাংলাদেশে এমন কোনো নেতৃত্ব আসে যারা শেখ হাসিনার মতো অমন প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পটিয়সী নন, তবে তেমনটি ঘটতেই পারে।
তেমনটা ঘটতেই পারে যদি দেশটার চালিকাশক্তির নেপথ্যে রাজনীতিবিদদের হাত থেকে ব্যবসায়ীদের হাতে হস্তান্তরিত হয়। আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের কথাই ধরা যাক। যে কোনো বিবেচনায়ই গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশের আজকের অবিশ্বাস্য সাফল্যগাথার নেপথ্যের অন্যতম শক্তি। পৃথিবীর কোথাও গার্মেন্টস শিল্প এত দীর্ঘদিন টিকে থাকেনি কিংবা দেশের অর্থনীতিতে এমন অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারেনি যেমনটি বাংলাদেশের বেলায় ঘটেছে।
পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নেও এদেশের গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। এজন্য গার্মেন্টস শিল্পোদ্যোক্তাদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে। তারা চাইলে বহু আগেই গার্মেন্টেসের মধুটুকু সাবাড় করে কানাডার বেগম পাড়ায় পাড়ি জমাতে পারতেন। তবে এও ঠিক যে পৃথিবীর কোথাও গার্মেন্টস শিল্পে মালিকরা ক্ষমতার এত কাছাকাছি আসতে পারেননি। বাংলাদেশে যে কজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এমপি, মেয়র বা মন্ত্রী আছেন পৃথিবীর অন্য কোথায় তেমনটি নেই।
এই কোভিডেও এই শিল্প যতটা সরকারি প্রণোদনা আদায় করে নিয়েছে, তার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেননি অন্য কোনো খাত। কোনো দেশীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যদি কখনো নিজেদের লাভের প্রত্যাশায় শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের মতো সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে প্রভাবিত করে বসতে পারে, তবে বাংলাদেশেরও শ্রীলংকা হতে দেরি হবে না। তবে আমার বিবেচনায় সেই শংকাটুকুও অমূলক। এর কারণ ‘একজন শেখ হাসিনা’ আর সাথে একাত্তরের প্রতি তার এবং তার পরিবারের আনুগত্য।
ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট না দেয়ার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, তিনি একাত্তরে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা ভুলে যাননি। এই একটি বক্তব্য থেকে তার চিন্তা আর চেতনার স্বচ্ছতা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।
তেরো.
এসব বিষয় আমরা যেমন বুঝি, বুঝে তারাও, যারা চায় বাংলাদেশের পরিণতি হোক শ্রীলংকার মতো। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আগে ছুটতে দেখে যাদের গাত্রদাহ হয়। মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ক্লাসে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে অথবা তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক লতা সমাদ্দারের টিপ পরাকে কেন্দ্র করে কিংবা নওগাঁর মহাদেব উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা অমোদিনী পালকে হিজাব বিতর্কে জড়িয়ে যারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতায়নটা বিনষ্ট করতে চায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের উদ্দেশ্যগুলো একেবারেই পরিষ্কার।
তাদের লক্ষ্য একটাই, তারা চায় সংখ্যালঘ্যু সম্প্রদায়কে চাপে ফেলে চাপে ফেলতে বাংলাদেশ ভারতের মৈত্রীময় সম্পর্ককে। তারা খুব ভালো করেই জানে যে এই বাংলাদেশ আর ভারত যখন পাশাপাশি দাঁড়ায় তখন তারা একে অপরের জন্য রক্ত ঝরাতে দ্বিধা করে না। এই মিলিত শক্তির শক্তি এতটাই যে এর সামনে বাংলার কাদাপানিতে নাকানি-চুবানি খেতে বাধ্য হয় পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনীটিও। কাজেই শ্রীলংকাকে টেনে এনে এরপর যদি আপনার সামনে কেউ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তাহলে বুঝে নেবেন হয় খুব বেশি বোকা, নচেৎ তার গোড়ায় ত্রুটি আছে। তিনি না বাংলাদেশি, না পাকিস্তানি। তিনি খাস দিলে একজন ‘বাংলাস্তানি’।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস