এড়িয়ে যাওয়া শিশু-কষ্ট
১৯৯৯ সালে লরেল হলিডে-র লেখা বই ‘চিলড্রেন অব ইজরায়েল অর প্যালেস্টাইন’ প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি খুব করুণ ভাষায় লিখেছিলেন, নৃতাত্ত্বিকভাবে একই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ফিলিস্তিন এবং ইজরায়েলের ইহুদিরা, যারা একই বালুতট, পাথর কণা, নদীর ঢেউ, সবুজ শ্যামলিমা, সমুদ্রতট আর পর্বতমালার অধিকারী; তবুও ইজরায়েলি এবং ফিলিস্তিন শিশুরা এই ধারণা নিয়ে বড় হয়, যে তারা একে অপরের বিবাদময় প্রতিবেশি। কেনই বা হবে না? আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে বিবেচ্য ইজরায়েলের শিশুরা। কিন্তু ফিলিস্তিনী শিশুদের ক্ষেত্রে ইজরায়েলের এই বয়স সীমার ব্যাখ্যা নিজস্ব। এর প্রমাণ একটি খবর। গত বছরের নভেম্বর মাসে খবরটি প্রকাশিত হয়ে পাঠকের নীরবতায় কুণ্ঠিত হয়ে হারিয়ে গেছে। ইজরায়েল একটি আইন প্রণয়ন করছে, যাতে ১২ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী শিশুদেরকে বিনা বাক্যব্যয়ে জেলে ঢোকানো যাবে। এর আগে বয়সের এই সীমা ছিল ১৪ বছর।
আমরা খুব নীরবে এড়িয়ে গেলাম, যেন কিছু আসে যায় না বা করার নেই টাইপের কারণে হারিয়ে যেতে দিলাম খবরটা। নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার উপর ভরসা যতটা, তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হই মানুষের সমাজের প্রাজ্ঞদের বিজ্ঞ সিদ্ধান্তে। কিন্তু কোনো তরফেই সাড়া না পেয়ে ভাবছিলাম, বুঝি এড়িয়ে যাওয়াটাই ভালো, বুঝি খবরটা আদতেই কোনো খবর নয়। তাই বা কী ভাবে হয়, মনের ভেতরকার খোঁচাখুচি স্বস্থিতে থাকতে দিচ্ছে না, কেন না খবরটা শিশু-কষ্ট বিষয়ক। ফিলিস্তিনী শিশু বা ইজরায়েলি শিশু, আমেরিকান না অ-আমেরিকান, প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, শিশুদের প্রতি অন্যায় হবে আর কেউ কোনো কথা বলবে না, এটা কি সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য?
ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং ফিলিস্তিনের সামরিক গোত্রগুলো শিশু অধিকার লংঘন করছে, শিশুদের আহত-নিহত করছে, ঠেলে দিচ্ছে বীভৎস জীবনের মাঝে। কিন্তু মিডিয়ার এক চোখ কানা, তাই ইজরায়েলি নির্যাতনকে দেখতে পায় না। ইজরায়েলি বাধ্যতামূলক প্রতিরক্ষা-হামলায় যে কোনো মুহূর্তে বন্ধ হবে স্কুল, হাসপাতালেও চিকিৎসা সেবা নিরাপদ হবে না, শিশুরা হামলা পরবর্তী ট্রমা নিয়ে দিন কাটাবে- এ হচ্ছে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তবুও তো বিবেকের দংশন বলে কিছু আছে। আর তাই ২০১২ সালে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ত্রিশজন সাবেক কর্মকর্তা ‘পাপ স্বীকার’ করে একটি বুকলেট প্রকাশ করেন, যাতে স্বীকারোক্তি এসেছে, কিভাবে ফিলিস্তিন শিশুদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ সন্দেহে ‘পেটানো, ভয় দেখানো, অপমান করা, গালাগালি আর আহত করা হ’ত। ইরান ইফ্রাতি নামের এরকম সাবেক কর্মকর্তা বন্দী শিশুদের উপর ‘বাজে ব্যবহার’ করাকে ‘রুটিন’ কাজের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ইফ্রাতি এগার বছর উর্ধ্ব কিশোরদের বন্দী করতেন, তখন পূর্ণবয়স্ক অপরাধীদের মতোই সেই কিশোরদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে, চোখ বেঁধে টেনে নিয়ে যেতেন বলে স্বীকারোক্তি প্রদান করেছেন। নিজের মুখেই বলেছেন,‘শিবিরে হাতকড়া পরা, চোখ বাঁধা কেউ বসে থাকলে, তাকে কেউ শিশু হিসেবে বিবেচনা করত না, মনে হ’ত সে যা করেছে, তা সত্যিই খুব খারাপ। কাজেই তাকে চড়-থাপ্পড় মারা ঠিক, তার মুখে থুতু ছিটানো ঠিক, তাকে লাথি মারাও ঠিক। আসলে সেসব কোনো ব্যাপার বলে মনে হ’ত না।’
২০১৩ সালে ৯,০০০ ফিলিস্তিনীকে বন্দী করা হয়, যাদের ৭০০জন ছিল শিশু। ফিলিস্তিনী আত্মঘাতি বোমা হামলায় ইজরায়েলি শিশুরা মারা পড়ছে, তবে এ সংখ্যা সড়ক দুর্ঘটনা-সামাজিক সংঘাত-অপহরণ-ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভুত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। এর পরও, প্রতিশোধের আগুনটা এরকমই- ফিলিস্তিনী হামলায় প্রতি একজন ইজরায়েলি শিশুমৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে ইজরায়েলি সেনারা ১৫.৮জন ফিলিস্তিনী শিশুকে হত্যা করছে, প্রতি তিন দিনে নিহত হচ্ছে একজন ফিলিস্তিনী শিশু (তথ্যসূত্র-ইজরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জেরুজালেম মিডিয়া এন্ড কম্যুনিকেশন সেন্টার)।
১৯৬৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনী শিশুদের পাশে দাঁড়ানো আন্তর্জাতিক সংস্থা ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল প্যালেস্টাইন (ডিসিআই) ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী কমপক্ষে ৯৮টি শিশুর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করে ২০১৩ সালে রিপোর্ট আকারে জাতিসংঘে দাখিল করে। ইজরায়েলের কারাগার কর্তৃপক্ষ আইপিএস-এর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ডিসিআই জানায়, প্রতি মাসে গড়পড়তা ১৯৯টি ফিলিস্তিনি শিশুকে ইজরায়েলের কারাগারে বন্দী হিসেবে যায়। পেতাহ্ তিকভা ডেটেনশন সেন্টার, কিশোন ডেটেনশন সেন্টার এবং আশকেলনের শিকমা কারাগার শিশুদের উপর নিমর্মতার জন্য কুখ্যাত। এসব জায়গার নিয়ম অনুসারে শিশু বন্দীদেরকে মাসে গড়ে ১০ দিন নিঃসঙ্গ রাখা হয়, কখনো কখনো তা বেড়ে এক নাগাড়ে ২৮ দিনও হয়। নিঃসঙ্গ শিশুদেরকে আতঙ্কিত করার জন্য সেলের বাইরে মধ্য রাতে সশস্ত্র সৈন্যরা ভারি বুটের আওয়াজ তুলে পাঁয়চারি করে। ফিলিস্তিনী শিশুদের ইজরায়েলের সৈন্যরা ব্যবহার করছে ‘মানবঢাল’ হিসেবে। অভিযানের একদম সামনে বন্দী শিশুদেরকে দাঁড় করানো হয়, যাতে ফিলিস্তিনী পাথরের আঘাত ফিলিস্তিনী শিশুর শরীরেই লাগে।
বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে না শিশু না শিশুর অভিভাবক নিশ্চিত হন, ঠিক কোন্ অপরাধের জন্য শিশুকে বন্দী করা হচ্ছে। অথচ নির্যাতনের মাধ্যমে শিশুদের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়। একাকী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ভোগ করার সময় চরম আতঙ্ক গেঁথে যায় ওদের ছোট্ট মনের পর্দায়, যা থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব হয়ে ওঠে না। শিশুকে একা রাখা, খালি ঘরে আটকে রাখা, খালি ঘরে একাকী শিশুকে আতঙ্কিত করা, নির্যাতন করা কি শিশু অধিকারের আন্তর্জাতিক আইনকে অমান্য করছে না?
ডিএসআই-এর কাছে স্বাক্ষ্য দিয়েছিল ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বন্দী হওয়া ১৫ বছরের এস হুসাম। বলেছিল,‘দুজন জিজ্ঞাসাকারী আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেছিল, চেয়ারে বসতেই দেয়নি। আমাকে অনবরত থাপ্পড় মারছিল, কিন্তু আমি স্বীকারোক্তি দেইনি। দুই ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ চলল। এর পর ওরা হিব্রুতে লেখা কিছু কাগজ এনে আমাকে বাধ্য করল স্বাক্ষর করতে। আমি স্বাক্ষর করেছি স্বীকারোক্তিতে, যে আমি পাথর ছুঁড়েছি। এ কথা কোর্টে আমার উকিল আমাকে বলেছিল।’
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইজরায়েলি পুলিশের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারার কারণে বন্দী হতে হয় ফিলিস্তিনী শিশুকে, যার শাস্তি কখনো কখনো বিশ বছরের কারাবাস। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর সামরিক আদেশে এমনটিই বলা আছে। শাস্তিপ্রাপ্ত ৫০ থেকে ৬০ ভাগ শিশুকে ফিলিস্তিন থেকে নিয়ে ইজরায়েলের কারাগারে আটকে রাখা হয়, যা ৪র্থ জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল ৭৬-এর সরাসরি লংঘন। ডিসিআই এই নির্জন কারাবাসে শিশুদের বাধ্য করাকে অপরাধ হিসেবে ব্যাখ্যা করে দ্রুত বন্ধের তাগিদ দিয়েছে ২০১৩-এর ঐ রিপোর্টে। কাজ কিস্যু হয়নি। ইজরায়েলি মিত্র দেশগুলো তোতা পাখির মতো শিশু-নির্যাতনকে সমর্থন করে বলেছে, প্রতিটি ফিলিস্তিনী শিশু নাকি সম্ভাব্য সন্ত্রাসী!
আয়েলেত শাকেদ নামের এক সংসদ সদস্যা, ইজরায়েলের অতি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল জিইশ হোমের প্রতিনিধি তো বলেই বসলেন, সব ফিলিস্তিনী মা-কে মেরে ফেলা উচিত, যাতে তারা ‘ক্ষুদে সাপ’ জন্ম দিতে না পারেন। তিনি ঠিক এভাবেই বলেছিলেন, ‘তাদের মরে যাওয়া উচিত এবং তাদের ঘরবাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া উচিত, যাতে তারা আর কোন সন্ত্রাসীকে লাল করতে না পারে। এরা সবাই আমাদের শত্রু এবং এদের রক্তে আমাদের হাত রাঙানো উচিত। মৃত সন্ত্রাসীদের মায়েদের সাথেও একই কাজ করা উচিত।’
সারা বিশ্বে শিশুদের আহাজারি ছড়িয়ে পড়েছে, সিরিয়া-ইরাক-মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র- নাইজেরিয়া-দক্ষিণ সুদান-পাকিস্তানের পেশোয়ার-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলো, কোথায় নেই কচিকণ্ঠের আর্তনাদ! শুনতে শুনতে সহ্য হয়ে গেছে কি? আর তাই ফিলিস্তিন-বিদ্বেষী আয়েলেত শাকেদের মতো গণহত্যাপ্রেমীদেরকেও টেনে ধরার চেষ্টায় মুঠোবদ্ধ হয় না বিশ্ববিবেকের হাত। কী আর করা!
লেখক : শিশুসাহিত্যিক
এইচআর/আরআইপি