ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পোস্টমর্টেম

প্রকাশিত: ০৩:৫২ এএম, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬

টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের দুই বছর পূর্তিতে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে ৩০ মিনিট ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সকল টেলিভিশন চ্যানেল তাঁর ভাষণটি বিটিভির সৌজন্যে সরাসরি সম্প্রচার করেছে।

সরকারের বর্ষপূর্তিতে দেয়া ভাষণে সাধারণত সরকারের নেয়া নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেরই বিস্তারিত ফিরিস্তি থাকে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভাষণটি তারচেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। তাঁর পুরো ভাষণটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনি নিজ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বয়ান দেয়ার পাশাপাশি বিএনপির নেতিবাচক রাজনীতির নানাদিক তুলে ধরেছেন। বিএনপির আমলের সাথে তাঁর আমলের তুলনা করেছেন। আর এসব তুলনায় সূচকের দিক থেকে যে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক এগিয়ে সেটি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এ চেষ্টা তিনি করবেন সেটাও অস্বাভাবিক নয়।

তাঁর ভাষণের অন্যতম প্রধান একটি দিক হলো, তিনি “উন্নয়নের মহাসড়কে" উঠে আসা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াসে দল-মত নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। বলেছেন, “বাংলাদেশ আজ  উন্নয়নের এক ঐতিহাসিক দিকসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আসুন, দল-মত ও বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখি।”

এ ধরনের আহ্বান শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও রেখেছিলেন। তখন বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত এবং নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো মৌলিক প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশাজীবী সংগঠন এবং সিভিল সমাজসহ দলমত নির্বিশেষে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

গত দুই বছরে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ আমরা লক্ষ করিনি। দুই বছর পূর্তিতে তিনি উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে একই রকম আহ্বান জানিয়েছেন। দল-মত নির্বিশেষের মধ্যে শেখ হাসিনা, বিএনপি জামায়াতকে রেখেছেন বলেই আমরা ধরে নিতে পারি। আর তাই যদি হয় তাহলে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বিএনপি নেত্রী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য না করাই শ্রেয় ছিল। বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি জামায়াতের অবরোধের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, ‘জনগণকে ভোগান্তিতে রেখে, অমানবিক কষ্ট দিয়ে তাদের জীবন বিপন্ন করে বিএনপি নেত্রী নাটক করে ৬৮ জনকে নিয়ে আরাম আয়েশে ৯২ দিন অফিসে থাকেন। হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডবের হুকুম দেন। তার এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জনসমর্থন পায়নি। ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে আদালতে হাজিরা দিয়ে নাকে খত দিয়ে বাড়ি ফিরে যান।`

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি বিএনপি নেত্রীকে এভাবে “নাটক করেন, নাকে খত দেন-এরকম খোঁচা দিয়ে কথা বলেন তাহলে আপনার উন্নয়নের মহাসড়কে তিনি কেন হাঁটবেন? আপনিইতো বললেন, ‘…কিন্তু গণতন্ত্র ও উন্নয়ন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্ব সহ্য করতে পারে না। মানুষ শান্তিতে থাকবে, হাসি মুখে জীবনযাপন করবে তা ওদের সহ্য হয় না।‘ একথা বলার পর তাদের নিয়ে কিভাবে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলবেন?

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ ছিল বাক-স্বাধীনতা হরণের দেশ, সাংবাদিক নির্যাতনের দেশ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের মিডিয়া এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে সরকারের সমালোচনা করতে পারছে। নির্বাচনী ইশতেহারেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সকল প্রকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং অবাধ-তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার নীতি অবিচলিতভাবে অব্যাহত রাখা হবে। জনগণের তথ্য জানা এবং সরকারের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রণীত তথ্য অধিকার আইন এবং তথ্য কমিশনকে অধিকতর কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হবে। সবিনয়ে বলতে চাই, মিডিয়া এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন-এমন মন্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ একমত হতে পারছি না।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সবার বিচার নিশ্চিত করতে সরকারের অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি, রায় কার্যকর করা হচ্ছে, কেউই বিচার বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।” আপনার এই বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণই একমত। কেউই যেন এই বিচার ঠেকাতে না পারে সে লক্ষ্যে আপনি এগিয়ে যাবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। ভারতের সঙ্গে স্থলসীমানা চুক্তি বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “আলোচনার মাধ্যমে আমরা ভারতের সাথে স্থলসীমানা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেছি। ছিটমহল বিনিময়ে ১০ হাজার ৫০ একর জমি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যোগ হয়েছে।”  আপনার এই মন্তব্যও সঠিক, এবং অভিনন্দনযোগ্য। তবে সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হাতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে গত কবছরে সবচে বেশি বাংলাদেশি মানুষ মারা গেছে। সেব্যাপারে সরকারের আরো কার্যকর ভূমিকা আশা করি।

আপনি আরো বলেছেন, জাতীয় সংসদকে সকল কর্মকাণ্ডের  কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছি। বিরোধীদলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, তারা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অভিমত দিচ্ছেন, আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনী ইশতেহারেও বলেছিলেন, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা হবে। সংসদকে কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে সংসদ সদস্যদের সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনানুগ বিধি-বিধান করা হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সত্যি কথা বলতে কী সংসদে যে একটি বিরোধী দল আছে সেটি ওই দলের প্রধানই বিশ্বাস করেন না। আর নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী বা সংসদকে কার্যকর করার কোনো উদ্যোগই গত দুই বছরে নেয়া হয়নি।

জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী, গত সপ্তাহে শান্তিপূর্ণভাবে ২২৩টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার উদাহরণ এনেছেন। বলেছেন, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এই নির্বাচন ছিল অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ।  আপনি আরো বলেছেন জনগণ  তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছে। নির্বাচনী ইশতেহারেও বলেছিলেন, ইতোমধ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য স্থায়ী নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার যে সূচনা হয়েছে তা সংহত এবং শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হবে। নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী, দক্ষ এবং স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী করা হবে। যুগের প্রয়োজনে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার অব্যাহত থাকবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পৌর নির্বাচনে দেখেছি নির্বাচন কমিশন যেন আরো দুর্বল হয়েছে। তারা সরকারি দলের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস দেখায়নি। নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগও চোখে পড়েনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সামরিক-অসামরিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন ১২৩ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পদমর্যাদা বৃদ্ধি ও ব্যাপক পদোন্নতির সুযোগ করে দিয়েছি। এটা ঠিক বেতন এতো বাড়ানোর পরেও আন্দোলনে আপনি বিরক্ত হয়েছেন। পুলিশ আর প্রশাসন ক্যডার ছাড়া আর সব সরকারি কর্মকর্তা কেন কর্মবিরতি পালন করছেন? আপনার সমর্থক শিক্ষকেরা কেন আন্দোলন করছেন, সেই খোঁজ নিচ্ছেন না। মনে করছেন বেতন বেড়েছে এত কথা কিসের? আন্দোলনকারীদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করা না হলে এর পরিণামে যে সরকারের উন্নয়নের মহাসড়কে ব্যারিকেড পড়বে-এটা আপনাকে বোঝাবে কে?

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, “আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।"

এটা হাস্যকর বটে। এটা এখন সর্বজনবিদিত যে দুর্নীতি দমন কমিশন একটা ঠুঁটো জগন্নাথ। যতটুকু স্বাধীনতা ছিল সেটাও কেড়ে নেয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের নামে মামলা করতে গেলে অনুমতির দরকার হবে বলে আইন সংশোধন করে কমিশনকে বরং আরো দুর্বল করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রীর নাম শুধু এক জায়গায় উচ্চারণ করেননি। তিনি বলেছেন, ‘একটি দলের নেত্রী ও তার নেতারা মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দানকারী ৩০ লাখ শহীদের প্রতি কটাক্ষ করেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অপমান করেছে। আমি এই ঘৃণ্য বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এদেশের জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। যারা দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করবে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কারও কোনো কটাক্ষ সহ্য করা হবে না।`

শেখ হাসিনা কেন এখানে বিএনপি চেয়ারপারসনের নাম নিলেন না তা বুঝলাম না। সুযোগ পেলেই তিনি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের ফিরিস্তি দিয়েছেন। এ জায়গায় তিনি বললেন একটি দলের নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী নাম না বললেও তাঁর কথার সাথে আমি একমত। আমি মনে করি যারা এদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এমন কেউই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ সহ্য করবে না।

শেখ হাসিনা ভাষণ শেষ করেছেন এ বলে যে , ‘মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি আমরা। কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমরা বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবই।` মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই আশাবাদ প্রতিটি বাঙালিরই মনের কথা। আমরা দেখতে চাই দেশের সবচে প্রাচীন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ উন্নয়নের মহাসড়ক পাড়ি দিতে সত্যি সত্যিই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবে, তাহলে কেউই আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। এর জন্য দরকার জনগণকে শ্রদ্ধা করা। যার অভাব খুব বেশি বোধ করছি।

pintu

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন