ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাঙালির সংকট

ইয়াসির আরাফাত তূর্য | প্রকাশিত: ০৯:২৯ এএম, ১১ মার্চ ২০২২

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কালজয়ী অমর নৈবেদ্য ‘সভ্যতার সংকট’ শীর্ষক অভিভাষণে উল্লেখ করেন, ‘অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি (১)…’ অর্থাৎ অধর্মের দ্বারা মানুষ বাড়িয়া ওঠে, অধর্ম হইতে সে আপন কল্যাণ দেখে, অধর্মের দ্বারা সে শত্রুদিগকেও জয় করে। কিন্তু পরিশেষে একেবারে মূল হইতে বিনাশ পায় (২)।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির মুক্তির বার্তাবাহী কালজয়ী ভাষণে,
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম(৩)’’
পঙক্তি উচ্চারণের সাথে সাথে খসে পড়েছে বাঙালির হাজার বছরের দাসত্ব শৃঙ্খল, চুকে গেলো বঞ্চনা গ্লানির করুণ বেদনার্ত ইতিহাস। ভাষণের সমাপ্তিতে 'জয় বাংলা' ওঙ্কার ধ্বনিতে বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক জাতিসত্তার শুভ উদ্বোধন করলেন।

বাঙালির অমিত সম্ভাবনার প্রকাশ ঘটানোর পাশাপাশি তার সফল রাজনৈতিক বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন যে মহান কালজয়ী পুরুষ, সেই বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে বাঙালির চিরায়ত সামাজিক সাংস্কৃতিক সংকটগুলোও ধরা পড়েছে অনিবার্য ভাবেই। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বাঙালির সংকট ও অসঙ্গতিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির প্রয়াস পেয়েছেন ।

বঙ্গবন্ধু'র ভাষায়, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুটি দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আরেকটা হলো আমরা বাঙালি। পরস্ত্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধয় দুনিয়ার কোন ভাষায়-ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরস্ত্রীকাতরতা! পরের স্ত্রী দেখে কাতর হওয়াকে পরস্ত্রীকাতরতা বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সব ভাষায়-ই পাবেন। সব জাতির মধ্যেই কিছু না কিছু আছে। কিন্তু বাঙালির মধ্যে আছে পরস্ত্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সব গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা (বাঙালি) গরিব। কারণ যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না। আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না (৪)।’

জাতির পিতার উল্লেখ্য আত্মভোলা পরস্ত্রীকাতর বাঙালির চিরায়ত সবিরোধী চিন্তার বাস্তব অবয়ব দেখা গেছে এ বছর অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সুদীর্ঘকালের আন্দোলন সংগ্রামে মহান শহীদের রক্তস্নাত বর্ণমালায় নির্মিত বাংলা ভাষার এই মহান মাসে রাজধানীর তথাকথিত এক স্কুলের শিক্ষকরা তাদের স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দ্বারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালি ও পশ্চিমা বিশ্বের পদলেহন করতে গিয়ে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। যা বাঙালির চিরায়ত 'পরস্ত্রীকাতর' আত্মভোলা চরিত্রকেই যেনো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত আবহমান বাংলার শিল্প সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে ভীনদেশী ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে তার আত্মোপলব্ধি ঘটে। তার বঙ্গভাষা কবিতায় বাণীবহ হয়ে ওঠে চিরন্তন আক্ষেপ,
‘কেলিনু শৈবালে ভুলি কমল কানন’
বাঙালির আবহমান আত্মঘাতী চিন্তাভাবনা, সবিরোধী বিশ্বাসঘাতকতাসুলভ আচার-আচরণকে দেখেই হয়তো মধ্যযুগীয় শক্তিমান কবি আবদুল হাকীম তার বঙ্গবাণী কবিতাটি রচনার প্রয়াস পেয়েছিলেন।
কবির ভাষায়,

‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি(৫)।।’

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু ২য় বিপ্লবের রূপরেখা হিসেবে বাকশাল শাসন ব্যবস্থার মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এদেশীয় দালালগোষ্ঠী বাঙালির সার্বিক মুক্তির অন্তরায় স্বাধীনতাবিরোধী রক্তপিপাসুর দল অব্যাহতভাবে অপপ্রচার চালিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল। করোনাকালে ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশবিরোধী শক্তি বিএনপি নেতাদের বানোয়াট গালগল্প ছড়ানোর মতোই জঘন্য কদর্যতার চিত্র ফুটে ওঠে তদানীন্তন রাজনৈতিক বাস্তবতায়।

বঙ্গবন্ধু সরকারের ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে এদেশের মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯.৬ শতাংশ। যে রেকর্ড আজ পর্যন্ত অতিক্রম দূরের কথা স্পর্শও করতে পারেনি কোনো সরকার । প্রবৃদ্ধির এ ধারা যদি অব্যাহত থাকতো তাহলে এদেশ ১৯৯৬-৯৭ সালেই মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে অবস্থান করতো। এখন আমাদের অবস্থান থাকতো অনেকটা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। দেশি-বিদেশি অজস্র ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যখন অপ্রতিরোধ্য তখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্মিত গণমুখী আর্থসামাজিক অগ্রগতির অপ্রতিরোধ্য ধারাকে অকস্মাৎ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।

যার খেসারত আজ পর্যন্ত দিয়ে যাচ্ছে এ জাতি। আমলাতান্ত্রিক অর্থনীতিতে আজ দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার আজ অল্প কিছু অতি মুনাফাখোর শিল্পপতি, মজুদদার, আমদানিকারকের হাতে জিম্মি। মজুদদারদের অতিমুনাফার লালায়িত হীনবাসনা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বছরে বিশেষ করে রমজান পূর্ববর্তী এক মাস কয়েক দফা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এদেশের এক নষ্ট অপসংস্কৃতি।

অথচ বাকশালে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা গণমানুষের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায়ে সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পদের সুষম বণ্টনের রূপরেখা দিয়েছিলেন জাতির পিতা! অথচ বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে এখনো অনেকেই বাকশাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জেনেই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে, যা বাঙালির সংকটকে আরও ঘোলাটে করে চলেছে।

এমন চিলের পেছনে ছোটার স্বভাবের কারণেই এ দেশের শত্রুরা বসন্তের কোকিলের মতো কাকের বাসা থেকে কাকের ডিম ফেলে দিয়ে সেখানে নিজের ডিম প্রতিস্থাপনের মতোই সুকৌশলে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বাঙালির স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বোধকে ধ্বংস করতে সদা তৎপর। তাদের এই হীন কায়েমী ফ্যাসিবাদী স্বভাবে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ ও জাতি।

যে বঙ্গবন্ধু বাঙালির জন্য সমগ্র জীবন উৎসর্গ করে গেছেন যাকে পাকিস্তানের জল্লাদবাহিনী হত্যা করার স্পর্ধা দেখায়নি, সেই বঙ্গবন্ধুকে তারই প্রতিষ্ঠিত দেশের মাটিতে কতিপয় দুর্বৃত্ত ও তাদের ঊর্ধ্বতন কুশীলব নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে বিদেশি প্রভুদের বাংলাদেশবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘৃণ্যতম ষড়যন্ত্রের নৃশংতম বাস্তবায়ন ঘটায়!

তাই তো এ ঘটনায় প্রখ্যাত নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট, বাঙালি হয়েও বাঙালির সাথে বিশ্বাসঘাতকতাসুলভ বোধবুদ্ধির মানবতাবিরোধী কদর্য প্রকাশ দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’

বঙ্গবন্ধু বাঙালির নিজের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব ও সাংস্কৃতিক বোধের প্রতি উদাসীন হওয়ার প্রবণতা উপলব্ধি করে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘যেকোনো জাতির সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ব্যতীত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন।’ অথচ সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের শীর্ষ পর্যায়ের লোকদের মাঝে অব্যাহতভাবে গ্রাম্য ক্ষ্যাপাটে ঝগড়াঝাটির মতো ঘটনা প্রত্যক্ষ করে পুরো জাতি আজ হতবাক। সামান্য একটি চেয়ারের জন্য শিল্পীরা উদ্ভট চুলোচুলিতে লিপ্ত হয়ে একটি দেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বোধকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চলছেন ক্রমাগত। নিজেদের মাঝে সভ্যতার ন্যূনতম অস্তিত্ব থাকলে এমন অশালীন কাদা ছোঁড়াছুড়ির মাতম জারি থাকতো বলে মনে করি না।

পশ্চিমা আর আরবীয় সংস্কৃতিকে আমদানি করে নিজ সংস্কৃতিকে ক্রমাগত বিসর্জন দিয়ে চলেছে । কথায় বলে, ‘আগে ঘর তবে তো পর’। কিন্তু বিশ্বের ব্যতিক্রম জাতি হিসেবে বাঙালি যেনো এর ব্যতিক্রম। আমরা নিজেদের গৌরবদীপ্ত রক্তস্নাত ভাষা ও সংস্কৃতিকে পদদলিত করে পশ্চিমা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আদিক্ষেতা প্রদর্শন করছি।

শালিক যেমন ময়ূর হতে পারবে না তেমনি একজন বাঙালি সন্তান তার নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে যতই উপেক্ষা করুক নিজস্ব অস্তিত্ব থেকে তার ব্যবচ্ছেদ করতে পারবে না। আমাদের মাঝে আজ জাতিগত ঐক্য ঠুনকো রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে আপস করে নিয়েছে। জাতিসত্তার প্রদীপ্ত বীজমন্ত্র তূর্যধ্বনি ‘জয়বাংলা'কে তাদের প্রভু দেশের আদলে জিন্দাবাদ দ্বারা চাপা দিয়ে স্তব্ধ করে দিতে প্রবৃত্ত হয়েছে। অথচ তারা বোধহয় ভুলে গেছে যে, ‘বাঙালি জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয় (৬)!’

রেফারেন্স সমূহ:
১. উপনিষদ,
২. সভ্যতার সংকট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
৪. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান
৫. বঙ্গবাণী, আবদুল হাকীম
৬. দুর্মর, সুকান্ত ভট্টাচার্য।

লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন