পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের প্রয়োজন কী?
আগেও এ নিয়ে লিখে ছিলাম, আবারো লিখতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক রাখবে কি রাখবে না, রাখলে তার ধরন কী হবে, এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে নতুন করে।
পাকিস্তানে বাংলাদেশের কূটনীতিক মৌসুমি রহমানকে ফিরিয়ে নিতে বলার পর বুধবার তাকে পর্তুগালে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সিলর মৌসুমী রহমানকে মৌখিকভাবে বৃহষ্পতিবারের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে নিতে বলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে তাকে ফিরিয়ে নিতে বলার কারণ ব্যাখ্যা করেনি পাকিস্তান।
পাকিস্তান কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি, কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। এতেই পরিষ্কার হয়, এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল কাজ, কারণ জঙ্গি ও জাল টাকার সাথে যুক্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হলে বাংলাদেশ থেকে নিজেদের দুই কূটনীতিককে প্রত্যাহার করে নেয় পাকিস্তান।
ঢাকা-ইসলামাবাদ কূটনৈতিক সম্পর্কের এই অবস্থার কারণ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তার জনগণের রায় নিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার করছে। এখন পর্যন্ত যাদের বিচার শেষ করা হয়েছে, এবং যাদের বিচার প্রক্রিয়াধীন আছে, এরা এদেশের নাগরিক। কিন্তু পাকিস্তান সরকার, সংসদ এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ নিয়ে কথা বলছে। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সাধারণ কূটনৈতিক শিষ্টাচারের কোনো লেশমাত্র নেই।
বাংলাদেশে পাকিস্তান হাই কমিশনের কিছু কিছু কর্মকর্তার জঙ্গি তৎপরতা ও জাল মুদ্রা ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামাবাদ তার দিকে দৃষ্টিপাত না করে, সংশোধনের পদক্ষেপ না নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করছে। তারই নজির মৌসুমি রহমানের সাথে এই আচরণ।
আগামী সার্ক সম্মেলন পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। প্রশ্ন করা যায় বাংলাদেশ সেই সম্মেলনে যোগ দিবে কিনা? না দেয়াটাই উত্তম হবে বলে মনে করছি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম পাকিস্তানের পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড আরেকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে না। কিন্তু আমরা কি পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন চাই? চাইলে আমাদের তৈরি থাকতে হবে বাংলাদেশে আরো জঙ্গি হানা, আরো জাল মুদ্রার ব্যবসা, আরো আইএসআই তৎপরতার জন্য।
বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের সচেতন মহল পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলছে। সরকার হয়তো এখনই এমন পদক্ষেপে যাবে না। কিন্তু সম্পর্ক কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতেই হবে এই বিপদজনক দেশটির সাথে।
পাকিস্তান এখন সবদিক থেকেই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। তাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মানব উন্নয়ন সূচক, স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস, কোনো কিছুতেই বাংলাদেশের ধারে কাছে নেই। এমন একটি পিছিয়ে পরা দেশ কি করে আমাদের দেশে জঙ্গি তৎপরতা চালায়? জঙ্গিদের প্রতিপালন করে? আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা, রাজনীতি নিয়ে কথা বলে? কারণ হলো তারা জানে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার, কুকর্ম করার ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশের বিপদটা এখানেই। এদেশে বেশ কিছু দল আছে যারা এখনো দেশটিকে পাকিস্তান বানানোর স্বপ্ন দেখে, সেই অনুযায়ী তারা শিয়া, আহমদিয়া সম্প্রদায় খুঁজে খুঁজে হামলা করে, রাজনীতির নামে পেট্রল বোমার সংস্কৃতি চালু করে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন অবশ্য নতুন কিছু নয়। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার ইরফান রাজাকে বহিষ্কার করেছিল বাংলাদেশ। তখন অবশ্য পাকিস্তান কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি। ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করতে বলার আগে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের আরও একজন কর্মকর্তা মাযহার খানের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ ওঠে। তখন তাকেও প্রত্যাহার করতে বলার পর তাকে ফিরিয়ে নেয় পাকিস্তান। যুদ্ধাপরাধের বিচার ঘিরে পাকিস্তানের প্রকাশ্য সমালোচনায় ক্ষুব্ধ বাংলাদেশের মানুষ। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু।
পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যা এবং ব্যাপক নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে চলেছে। বাংলাদেশে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার হলে পাকিস্তানের আঁতে ঘা লাগে যেহেতু, বাংলাদেশ সরকারের কাজ হবে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কাজ শুরু করা।
পাকিস্তান এখনো ১৯৭১ সালের পরাজয়ের গ্লানিতে ভুগছে বলেই বাংলাদেশে যখনই কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামির বিরুদ্ধে আদালতের রায় দেয়া হচ্ছে বা তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হচ্ছে তখনই পাকিস্তানের সরকারি দল-বিরোধীদল নির্বিশেষে শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বেলাগাম প্রচার-প্রোপাগান্ডায় মেতে উঠছে। পাকিস্তান এখনো ১৯৭১ সালের জন্য অনুশোচনা না করার অর্থ হলো বাংলাদেশের শত্রুতা থেকে একচুলও নড়ছে না দেশটি।
নিজেরা কথা দিয়ে নিজ দেশের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেনি। গত ৪৪টি বছর ধরে দেশটি বাংলাদেশের ন্যায্য দাবিগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে। তারা বাংলাদেশের প্রাপ্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পদের ন্যায্য হিস্যা দেয়ার আলোচনা এগিয়ে নিতে দেয়নি। বাংলাদেশে যেসব অবাঙালি পাকিস্তানি নাগরিক আছে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের ফেরত নিচ্ছে না। মাত্র কয়েক হাজারকে নিয়ে যাওয়ার পর পুরো প্রক্রিয়াটাই থামিয়ে রেখেছে।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে যেসব পাকিস্তানপ্রেমী রাজনৈতিক দল আর ব্যক্তি ক্ষমতায় এসেছে এদেশটিকে পাকিস্তানি অপরাধী আর জঙ্গিগোষ্ঠির অভয়ারণ্য বানিয়ে রেখেছিল। এমনকি ভারত বিরোধী দর্শন লালন করতে গিয়ে বাংলাদেশকে আইএসআই’র ঘাঁটি বানিয়ে রেখেছিল ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদি গোষ্ঠিগুলোকে মদদ দেয়ার জন্য।
দেরিতে হলেও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন প্রকাশ্য বৈরিতায় পর্যবসিত হয়েছে। বিএনপি জামায়াত জোট যা করেছিল, সে অনুয়ায়ী বাংলাদেশ আর কখনো পাকিস্তান-ভারত প্রক্সি যুদ্ধের মদদদাতা হবে না, এটা পাকিস্তান বুঝে নিয়েছে। আর তাই তার আচরণ এখন বেপরোয়া। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করা হোক, আর নতুন বছরের শপথ হোক বাংলাদেশে থাকা পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন দল আর ব্যক্তিদের সমূলে উৎখাত করা। আমাদের ভাবনার জগতে একটি কথা বেশি করে বাজতে থাকুক, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক না রাখলে কি হয়?
এইচআর/এমএস