ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাবির নতুন প্রক্টর কী শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারবেন?

গোলাম সারওয়ার | প্রকাশিত: ০২:০২ পিএম, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরদের নিয়ে গল্পের শেষ নেই। অনেক ন্যক্কারজনক কাহিনীর জন্ম দিয়েছে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং তার বডির সদস্যরা। এ বদনাম থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও পিছিয়ে নেই। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই জন্ম হয়েছিল দেশের, এমনকি বিশ্বের নজিরবিহীন একজন প্রক্টরের। যিনি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। হাজার হাজার ছাত্রর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। তিনি হচ্ছেন ড. শামসুজ্জোহা। দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। তিনি বলেছিলেন,"কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে, সে গুলি যেন আমার গায়ে লাগে।”

ড. জোহা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই মাটিতে। তাঁর সেই অক্ষয় বাণী তাঁরই সহকর্মীরা ভুলে গেছে। তাঁর কবরের পাশ দিয়েই তাঁর সহকর্মীরা সবসময় যাতায়াত করেন, অথচ একটিবারও তাঁরা ড. জোহার সেই ত্যাগের কথা, শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠার কথা ভাবেন না। প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি এলে লোক দেখানো ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে, বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে মুখ মুছে চলে যান। এইসব স্বার্থান্ধ শিক্ষকদের অশিক্ষকসুলভ কর্মকাণ্ডে তাঁর অতৃপ্ত আত্মা মাথা কুটে কুটে মরে।

স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা, রেজিস্ট্রার, বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ, ইনস্টিটিউটের পরিচালকসহ আরো কয়েকটি লাভজনক প্রশাসনিক পদের নিয়োগ দেন স্বয়ং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। বহুকাল ধরেই এসব পদে দলীয় বিবেচনায় এবং ভিসি গ্রুপের শিক্ষকদেরকেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যোগ্যতা, দক্ষতা দেখার বালাই নেই। এই নিয়োগ পেতে শিক্ষকদের মধ্যে চলে জোর তদ্বির। যা অনেক সময় নোংরা পর্যায়ে চলে যায়।

এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কার্যকলাপের উপর বহুলাংশে নির্ভর করে ভিসি তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম-বদনাম। তাই এসব পদে নিয়োগ দিতে ভিসিকে বিচক্ষণতা এবং নিরপেক্ষতা দেখানোটা বাঞ্ছনীয়। শুধু তাঁর ব্যক্তিগত লাভের দিক, দলীয় কিংবা গ্রুপের অনুগত শিক্ষকদের দিক চিন্তা করেই নয়, তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবেই এসব পদে যোগ্য নিয়োগ দেয়া তাঁর নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেরকম হয়না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠছে না। অবতীর্ণ হচ্ছে নির্জলা দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায়।

সাম্প্রতিককালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের একটি ঘটনা পত্র-পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এটাই যদি হয় একজন শিক্ষকের ভূমিকা, তবে সহাবস্থানের বিশ্ববিদ্যালয় আমরা কীভাবে আশা করতে পারি! প্রসঙ্গতঃ পূর্বের সোবহান প্রশাসনের সময় এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে দলীয় অযোগ্য, অথর্ব, নৈতিক স্খলনকারি, পদলেহনকারীদের নিয়োগ দেয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ভিসিকেও তারা আরো ডুবিয়েছে। তাই ইতিহাস থেকে সবাইকে শিক্ষা নেয়া উচিত।

কথা উঠেছে, নতুন প্রক্টর ড. আসাবুল হককে নিয়ে। তিনি কী শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারবেন? তাঁর পরিচয়ও রয়েছে গ্রুপভিত্তিক। তবে মনে রাখা উচিত,সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি এখন প্রক্টর। সঠিক দায়িত্বপালনে তিনি যদি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন,তবে তাঁকে পোশাক পরিবর্তন করতে হবে। বদমেজাজী কিংবা অস্থির চিত্তের শিক্ষকদের দ্বারা এই বিশাল কর্মযজ্ঞের ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যায় না। যার পরিণতি ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি। এটা একটা চ্যালেঞ্জিং পদ। একজন প্রক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। শিক্ষার্থীদের নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাঁকে ব্যবস্থা নিতে হয়।

বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যকার হামলা,মারামারি, দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে সরাসরি তাঁকে হ্যান্ডেলিং করতে হয়। বর্তমান অস্থির রাজনীতির প্রাক্কালে এবং অসহিষ্ণু ছাত্রদের নিয়ে প্রক্টরের কাজ মোটেও সহজসাধ্য নয়। প্রায় সময় শিক্ষার্থীদের সাথে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামে উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের প্রশমিত করতে হয়।

তাঁকে সবসময় তোপের মুখেই থাকতে হয়। তাই ধীর, স্থির, ধৈর্যশীল, বিচক্ষণ, বিজ্ঞ, সাহসী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের অধিকারী একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষককে বিচার বিবেচনা করে প্রক্টর নিয়োগ দেয়া উচিত বলে সিনিয়র শিক্ষকগণ অভিমত ব্যক্ত করেন। আমরা আশা করি, নতুন প্রক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে শাণিত করার চেষ্টা করবেন।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যতিক্রমধর্মী অহিংস আন্দোলন অনেকের জন্য সতর্ক বার্তা এবং এটি একটি মডেল আন্দোলন বলে পরিগণিত হয়েছে। এই আন্দোলনের ইতিবাচক প্রভাব প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। শাবি'র আন্দোলনের কিছুদিন পরই ১ ফেব্রুয়ারি রাতে আকস্মিকভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে গেল ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ট্রাক চাপায় ছাত্র হিমেল নিহতের ঘটনা।

অনেকের চোখ খুলে দিয়েছে এই মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহ। আমরা কী দেখলাম? দুর্ঘটনা ঘটার পর পরই শিক্ষার্থীদের বার বার অনুরোধ সত্বেও হিমেলের লাশ দেখতে আসেননি পূর্বের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর লিয়াকত আলী। এমতাবস্থায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রক্টরের পদত্যাগ চাইলেন। এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি শাহজালালের ভিসির মত ভুল করলেন না। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি দ্রুত মেনে নিলেন। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের সহানুভূতি জানানোর ক্ষেত্রে তাদের অন্যান্য দাবিও মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলেন।

এদিকে হিমেল নিহতের পরবর্তী সমস্ত কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেক নজির স্থাপন করলেন ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক তারেক নূর। তিনি শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছেন বলে অনেকে মনে করছেন শিক্ষার্থীদের বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাঁর আন্তরিক সহানুভূতিশীল অংশগ্রহণ অনেকের মনে দাগ কেটেছে-যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী আবেগতাড়িত হয়ে ড. শামসুজ্জোহার সাথে তাঁকে তুলনা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন।

তবে গুরুত্বপূর্ণ ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক পদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান ভিসি বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছেন বলে অনেকে মনে করেন। যেমন, জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক পদে নিয়োগ দিয়েছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার পান্ডেকে। তিনি সৎ, নীতিবান, গবেষক, দক্ষ এবং অমায়িক একজন শিক্ষক বলে ক্যাম্পাসে পরিচিত। জনসংযোগ দপ্তরের প্রকৃত কাজের মাধ্যমে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল করবেন বলে আমরা মনে করি।

অতি নিকটতম সময়ের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, ইনস্টিটিউট পরিচালক, প্রশাসকসহ আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতে হবে বলে প্রশাসন ভবন সূত্রে জানা গেছে। আশা করি, ভিসি মহোদয় সার্বিক দিক বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে এসব পদে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে দক্ষ এবং যোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ দিবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে হিমেল নিহতের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং ভিসি ও তাঁর পারিষদবর্গের মনোভাবকে যে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন,আমরা বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। ভিসি প্রফেসর গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু পরিস্থিতিকে যেভাবে স্বচ্ছতার সাথে পরিচালনা করেছেন,তা অনুকরণীয়। তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে আন্তরিকভাবে উন্মুক্ত আলোচনা বা মতবিনিময়ের মাধ্যমে তাদের বক্তব্য ধৈর্য সহকারে শুনে যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন,বহু বছর পর দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করলো।

আগামী দিনগুলোয় আমরা এভাবেই ভিসি মহোদয়ের প্রশংসনীয় ভূমিকা দেখতে চাই। পাশাপাশি তাঁর প্রধানতম সহযোগী প্রক্টরের প্রতি আমরা আস্থা রাখতে চাই, তাঁর বিচক্ষণ এবং দৃঢ় ভূমিকায় শিক্ষার্থীরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে সহাবস্থান করতে পারে।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার (অব.) রাবি।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন