ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আসুন ভালো রাখি, ভালো থাকি

ইমরান হুসাইন | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

কোটি মানুষের স্বপ্নের শহর, সংগ্রাম ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শহর রাজধানী ঢাকা। সব সুযোগ সুবিধা, ব্যবসা, কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এবং গ্রামাঞ্চলে বেকারত্ব ও দারিদ্রতা বাড়তে থাকায় সব শ্রেণির মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। ফলে এই ঢাকা শহরেই কোটি মানুষের বসবাস। যে নগরীতে কোটি প্রাণের বেঁচে থাকার ভরসা, যেই নগরী বাংলাদেশের প্রাণ, সেই নগরীই আজ নানামুখী হুমকির মুখে। রাজধানী ঢাকা সেই বসবাসের অযোগ্য নগরী হিসেবে গণ্য হয়েছে। নানা সমীক্ষণে বারবার খারাপ দিকগুলোর শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে, যা ঢাকায় অবস্থানরত মানুষদের জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ।

সম্প্রতি দেখা যায় যে, রাজধানী ঢাকা প্রায়ই দূষিত শহরের তালিকায় এক নম্বরে আসছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, গাজীপুর বিমানবন্দরের প্রকল্পের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি নানা ভবন নির্মাণও চলছে। ফলে বাতাসে ভাসছে বালি আর মাটির কণা। শীতে বৃষ্টি না হওয়ায় ধূলিকণা বাতাসেই থেকে যাচ্ছে। ঢুকে পড়ছে ঘরে, এমনকি মানুষের ফুসফুসেও।

আমাদেরই অব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকায় বায়ুদূষণ বাড়ছে দ্রুতগতিতে। আমাদের কর্মের ফল আমরাই ভোগ করছি। এই বায়ুদূষণের ফলে রাজধানীবাসী নানারকম কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাতেও আমাদের কোনো খেয়াল নেই। আমরা আমাদের ইচ্ছা মতোই চলছি। পরিবেশ দূষণ করছি অবলীলায়।

ঢাকার পরিবেশের দূষণ রোধে সব পক্ষকে দ্রুত চিন্তা-ভাবনার অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়নকাজ বন্ধ রাখা যাবে না। আবার বায়ুদূষণও করা যাবে না। বেছে নিতে হবে বিকল্প সমাধান। বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ধুলা নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আসলেই তাই। রাজধানীর যে সব জায়গায় নিয়মিত কাজ চলছে সেই সব জায়গায় নিয়মিত পানি ছিটানোও সম্ভব নয়। এভাবে পানি ছিটানো যায় কতক্ষণ এটাও ভাবার বিষয়। আমাদের সেই সক্ষমতাও নেই।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’র বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী গত সোমবার ঢাকা আবার উঠে এসেছে বায়ুদূষণের শীর্ষ অবস্থানে। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে কিছুটা দূষণ কমলে আবার বেড়েছে। গত ২১ থেকে ২৬ জানুয়ারি টানা দিনের কোনো না কোনো সময় ঢাকা উঠে এসেছে একেবারে শীর্ষ অবস্থানে। সোমবার অবস্থানের পাশাপাশি মাত্রাও বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। এর আগের ক’দিন মাত্রা ছিল ৩০০-এর নিচে, যাকে বিশেষজ্ঞরা অস্বাস্থ্যকর মাত্রা বলেন, সেই মাত্রা গত সোমবার ছিল ৪১৯। যার অর্থ দুর্যোগপূর্ণ, জরুরি অবস্থা জারির মতো অবস্থা।

রাজধানীর এরূপ দূষণ অবস্থার জন্য আমরা নির্দিষ্ট কাউকে দায়ী করতে পারি না; আমরা সবাই সমানভাবে দায়ী। যে কারণে আমরা কাউকেই নির্দিষ্ট করে দোষারোপ করতে পারি না। কারণ আমরা সবাই মিলেই অপরাধ করি নানাভাবে। আমাদের সামনে কেউ অপরাধ করলেও আমরা মানা করি না। কারণ আমরা উদাসীন, আমরা মনে করি না যে এ সমাজ আমাদের এই দেশ আমাদের। যে কারণে আমরা অবাধে দূষণ করেই চলেছি। আমরা একটাবার ভাবি না যে নিজেরাই নিজেদের বসবাসের জায়গাকে অযোগ্য করে তুলছি।

রাজধানীর বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় উঠে এসেছে, গত ছয় বছরের মধ্যে (২০১৬ থেকে ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত) ঢাকার মানুষ মাত্র ৩৮ দিন সময় স্বাস্থ্যকর বায়ু গ্রহণ করতে পেরেছে। এর মধ্যে মানুষ ৫১০ দিন চলনসই মানের বায়ু, ৫৭৭ দিন সংবেদনশীল, ৪৪৩ দিন অস্বাস্থ্যকর, ৩৮৫ দিন খুব বিষবাষ্প গ্রহণ করে। এবং ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের চেয়েও ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৭ শতাংশ। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সূচক ২১৯ দশমিক ৫৯ এসে দাঁড়িয়েছে, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর।

নগর ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন পানি দিচ্ছি। বায়ুদূষণ অ্যাপ একিউএসের মাধ্যমে কোন এলাকায় বেশি দূষণ হচ্ছে সেটা দেখে পানি দিচ্ছি। মেট্রোরেল, বিমাবন্দর, গাবতলী, রোকেয়া সরণিতে বেশি পানি দিতে হচ্ছে। ছোট গলিতে পানি দেওয়া সমস্যা। সেখানেও ছোট গাড়িতে করে পানি দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে পানি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মানুষকে সচেতন হতে হবে। নির্মাণকারী সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির উদ্যোগও থাকতে হবে। আরও গাড়ির প্রয়োজন। আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। কিন্তু কি উদ্যোগ নিচ্ছি এবং তা কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে তা কেউ বলতে পারি না।

নগর পরিকল্পনা কীভাবে হয়, কোন দিকটায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় তা আমরা জানি না। এবং পরিকল্পনা কি হচ্ছে এবং বাস্তবায়ন কতটুকু সেদিকে আমরা তাকাই না। আমরা শুধু শুনি যে অমুক পরিকল্পনা করা হয়েছে তমুক পরিকল্পনা করা হয়েছে। দিনশেষে আমাদের প্রাপ্তির খাতা শূন্য। সেই সাথে আছে আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা। বায়ুদূষণ রোধে বাংলাদেশে যতগুলো আইন আছে তার বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে, যা ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। যেখানে আইনের সুষ্ঠু ব্যবহার নেই সেখানে অনিয়ম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এবং তাই হচ্ছে।

নগর পরিকল্পনাকারীরা পানি দিয়ে ধুলা নিবারণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু শুধু পানি ছিটিয়ে ধুলা নিবারণ করে বায়ুদূষণের প্রতিকার কতটুকু সম্ভব! ঢাকা শহরে প্রতিদিন কত জায়গায় পানি দিয়ে ধুলা নিবারণ করা যায়? আর কতটুকু সময় তা স্থায়ী হবে? আমাদের পরিকল্পনাগুলো স্বল্প মেয়াদি বা ক্ষণস্থায়ী হিসেবেই রূপ নিচ্ছে আমরা স্থায়ী বা দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করছি না। বরং দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ীভাবে সমাধানের পথে আমরাই বাধা হিসেবে কাজ করে চলেছি প্রতিনিয়ত।

যদি বলেন আমরাই কীভাবে সুষ্ঠু সমাজ মির্মাণে বাধাপ্রদান করছি তাহলে চোখে আঙুল দিয়ে কয়েকটি কারণ দেখানো যাবে। এগুলো কখনও আমরা বেখেয়ালি বা ইচ্ছাকৃত ভাবেই করে চলেছি। অসচেতনার সাথে হয়তো ময়লা-আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলছি। নিজেদের পরিবেশ নিজেরাই নষ্ট করে বায়ুদূষণ করছি। কিন্তু সব থেকে বড় ক্ষতিটা করছি খুবই সচেতনতার সাথে। এবং খুবই সহজভাবে যেন আমরা এর কুফল সম্পর্কে জানিই না!

যে গুরুতর অপরাধের কথা বলছি তা হলো শহরের গাছপালা কাটা, বনভূমি উজাড় করা। বলা হয় গাছ মানুষের পরম বন্ধু। মানুষের উপকারে সব সময় নিয়োজিত গাছ। জীবনে নানামুখী কাজে গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। এবং পরিবেশকে সুন্দর ও সাচ্ছন্দ্যময় হিসেবে গড়ে তুলতে গাছের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু আমরা এই গাছের গুরুত্বের কথা ভুলে যাই ক্ষুদ্র স্বার্থে। একটাবার চিন্তা করি না আমাদের পরিবেশের কথা, আমাদের দেশের কথা। ব্যক্তিস্বার্থের কারণেই আমরা সবাই আজ বলি হচ্ছি।

রাজধানীতে কয়েকটা জায়গায় গাছপালা নিধন চলেছে উন্নয়নমূলক কাজের অজুহাত দিয়ে। শত শত গাছ মারা পড়েছে। এতে সাময়িকভাবে আমাদের লাভ হলেও মূলত ক্ষতি আমাদেরই। কারণ আমরা বিশুদ্ধ বাতাস পাবো না। পরিবেশে যদি গাছাপালার পরিমাণ বেশি হয় তবে বায়ুর সংযোজন বিয়োজনের মাধ্যমে এত বেশি পরিমাণে বায়ুদূষণ হতো না।

সর্বোপরি এই ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করে তুলতে প্রথমেই আমাদের সচেতন হতে হবে, আমাদের চার পাশের মানুষকে সচেতন করতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষের মধ্যে আরও বেশি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে চাইলে রাজধানীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সবাইকে অবগত করতে হবে এই বায়ু আমাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা বোঝাতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই বিশাল সমস্যাটা ধীরে ধীরে সমাধান হবে। নতুবা রাজধানীর রাস্তায় পানি ছিটিয়ে ধুলা নিধন করা যাবে না। বায়ুদূষণ রোধ করা যাবে না।

ঢাকার বাতাসকে বিষমুক্ত করতে অধিক পরিমাণে গাছ লাগাতে হবে। গাছ লাগানো এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ব্যতীত কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনে নিজ উদ্যোগে প্রতি বাড়ির ছাদে ছাদ বাগান করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে এই নগরী আমাদের, এটাই আমাদের বসবাসের স্থান, আমাদের কর্মস্থান। এই নগরীকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার আপনার, সবার। তাই আসুন এই রাজধানী ঢাকাকে আমরা ভালো রাখি, ভালো থাকি।

লেখক: শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন