বিএনপি সরকার পতনের বিকল্প দেখছে না
দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগেরও প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। ২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে আছে। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্য থেকেই বিএনপির জন্ম দিয়েছিলেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভেবেছিলেন জিয়া না থাকলে বিএনপি থাকবে না। কিন্তু সেটা সত্য হয়নি।
জিয়াকে হত্যা করার পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার হাত ধরে বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তিন বার ক্ষমতায়ও গিয়েছে। দুই বার পূর্ণ মেয়াদেই, একবার অল্পসময়ের জন্য। তিন বারই খালেদা জিয়াই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তবে ২০০৬ সালের পর থেকে বিএনপির সময় ভালো যাচ্ছে না।
এক সময় এমন ধারণা হতে শুরু করেছিল যে, বাংলাদেশে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বুঝি চালু হচ্ছে। একবার বিএনপি ক্ষমতায় গেলে পরের বার ক্ষমতা যাবে আওয়ামী লীগের হাতে। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত জয় পেয়েছিল বিএনপি।
তারপর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও বিএনপি বিজয়ী হয়েও অল্পসময়ের মধ্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে প্রবল আন্দোলনের মুখে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয় পায় আওয়ামী লীগ।
তারপর ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার বিএনপি। তবে এই সময়ের মধ্যে দেশের রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তন ঘটতে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী না হয়ে দুর্বল হতে থাকে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও আসতে থাকে পরিবর্তন। বিরোধ ও বিদ্বেষ হয় রাজনীতির প্রধান অবলম্বন। যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা প্রবল হয়ে ওঠে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় যে জোট রাজনীতি শুরু হয়েছিল, সেই জোট প্রথার রাজনীতি কল্কে পেতে থাকে। বড় দুই দলের সঙ্গে ছোট দলগুলোর জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতার স্বাদ ভক্ষণে তৎপর হয়ে ওঠে। দেশে পাওয়া ও খাওয়ার ধারার রাজনীতি অপ্রতিরোধ্য হতে থাকে।
২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দহরমমহরম নতুন না হলেও তাদের ক্ষমতার অংশীদার বানিয়ে বিএনপি দেশের অসংখ্য মানুষের আবেগের সঙ্গে প্রতারণার খেলা খেলেছে।
একদিকে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্যে বিরোধিতাকারী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত দলটিকে ক্ষমতার ভাগীদার করা চরম শঠতাপূর্ণ আচরণ। তাছাড়া ক্ষমতায় এসে বিএনপি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে অত্যাচার নির্যাতন করেছিল, তা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সংঘাতময় করে তোলে।
এই সময়ে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সবচেয়ে বড় অঘটন হলো আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে হত্যার অপচেষ্টা চালানো।
সরকারের মদদ বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ওই অপরাধ সংঘটন সম্ভব ছিল না। ওই ঘটনা দেশের রাজনীতিতে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তি বসানোতে গিয়ে বিএনপি অনমনীয় মনোভাব নিয়ে রাজনীতিতে যে সংকট তৈরি করে তার পথ ধরেই দেশে সেনানিয়ন্ত্রিত জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব হয়।
তারপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট, শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর আর বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে জেতা সম্ভব হয়নি। সেই থেকে একবার আওয়ামী লীগ, আরেক বার বিএনপি – এই ধারাও অকার্যকর হয়ে আছে।
দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি এখন নানা সমস্যায় আছে দলের সাংগঠনিক অবস্থা ভেঙে পড়ার মতো। নেতৃত্বেরও সংকট আছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। সাজা স্থগিত রেখে সরকার তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিলেও তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ। হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে অধিকাংশ সময়।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে গত কয়েক বছর ধরেই দূরে আছেন। তার কারামুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবি বিএনপি জানালেও সরকার তাতে সাড়া দিচ্ছে না। আন্দোলনের হুমকি দিয়েও সরকারকে নরম করতে পারছে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিদেশ আছেন। তিনিও সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আইনের চোখে পলাতক। ভার্চুয়াল যোগাযোগে দল চালান। তার পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে দলের সিনিয়র নেতাদের মতপার্থক্যের কথা শোনা যায়। তবে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেন না পদ হারানোর ভয়ে। দেশে থেকেও সবাই সব ইস্যুতে একমত হয়ে কাজ করতে পারছেন, তা-ও নয়।
এই অবস্থায় দলের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা কি তা নিয়ে কিছু খবর সংবাদমাধ্যমে ছাপা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নির্বাচন নয়, বিএনপির ভাবনায় এখন নির্বাচনকালীন সরকার যা হবে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ। সেই ভাবনার বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের পতনের বিকল্প কিছু দেখছে না দলটি।
সে ক্ষেত্রে এককভাবে নিজেদের শক্তির ওপর ভরসা না করে রাজপথের আন্দোলনের জন্য সঙ্গী খুঁজছে বিএনপি। উপযুক্ত সঙ্গীদের নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ‘একমুখী’ একটি জোট করার পরিকল্পনা আছে তাদের। আগামী দিনের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে সন্দেহ-সংশয়ও আছে বলে জানা গেছে।
দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের চলমান প্রক্রিয়ায় ভ্রুক্ষেপ করছেন না তারা। যে ইসি গঠিত হতে যাচ্ছে, তারা আগামী নির্বাচনে বর্তমান সরকারের ইচ্ছার পক্ষেই কাজ করবে। সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির কোনো লাভ হবে না ।
এই অবস্থায় বড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতনের লক্ষ্যে বিএনপির চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম, এমন দলগুলোকে একটা নতুন প্ল্যাটফর্মে আনার চিন্তা করা হচ্ছে, যার নেতৃত্বে থাকবে বিএনপি। এই জোট থেকে আগামী দিনে সরকার পতনের বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
তবে সবই এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই আছে। বিএনপি যা ভাবছে তা মিত্রের কাছেও ঠিকমতো পৌঁছেনি। তাছাড়া ডাক দিলেই সবাই বিএনপির সঙ্গে একাত্ম হবে, তেমন বাস্তবতা নেই। বিএনপির রাজনীতি ও কৌশল নিয়ে পুরনো মিত্রদের সঙ্গেই ভুল বোঝাবুঝি আছে।
এর আগে যে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল তার কী হবে? জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে থাকা না-থাকার বিষয়টিরও কোনো ফয়সালা হয়নি। জামায়াতের সঙ্গে থাকা নিয়ে দলের ভেতরে বাইরে বিতর্ক ও অস্বস্তি আছে।
বিএনপি নেতাদেরও কেউ কেউ মনে করেন, নতুন জোট গঠন করার আগে বিএনপিকে অবশ্যই পুরোনো সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। বৃহত্তর স্বার্থে ছাড় দিয়ে হলেও আলোচনার মাধ্যমে শরিকদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে হবে। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ঝুলে থাকা সম্পর্কের বিষয়টিরও সুরাহা করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের এক নেতার বরাত দিয়ে একটি পত্রিকায় যে খবর বেরিয়ে তাতে বলা হয়েছে, নতুন জোট নিয়ে এর মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। জোট নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো সুসংবাদ নেই। যত দূর জানি শরিকদের সঙ্গে বিএনপির এখনো অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে। এই অবস্থায় বিএনপি ডাকলেই সবাই তাদের সঙ্গে নতুন আরেকটি জোটে যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
এই যখন বাস্তব অবস্থা তখন বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ আছে কি? তাছাড়া বিএনপি দড়ি পাকানো শুরু করলে আওয়ামী লীগও নিশ্চয়ই চেয়ে চেয়ে দেখবে না। উভয় পক্ষের প্রস্তুতি চূড়ান্ত হলেই না বলা যাবে লড়াইটা সত্যি কতটুকু জমবে!
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা ।
এইচআর/জিকেএস