ওসি না ডিসি?
সকালবেলা মেজাজ খারাপ করতে ভালো লাগে? মনে হচ্ছে, এখন এ কাজটাই করতে হবে। আফিয়া কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। রায়লা বানু বললেন-
: আফি, তুই কিন্তু আমার সঙ্গে একদম রাগারাগি করবি না।
: কী করব?
: হেসে হেসে কথা বলবি।
: হাসি না আসলে কী করব?
: হাসি না এলেও হাসবি। মানুষ মায়ের জন্য কতকিছু করে, আর তুই ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাঁচমিনিট হাসতে পারবি না?
হাসতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা অন্য জায়গায়। কিছুদিন ধরে ডা. রাফির সঙ্গে আফিয়ার একধরনের নীরব বোঝাপড়া চলছে। আজ তা একটা রূপ পাওয়ার কথা। প্রস্তাবটা গতকাল রাফিই দিয়েছে। বলেছে-
: আফি, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
: কী কথা?
: এই মুহূর্তে বলতে চাচ্ছি না।
: নতুন কিছু?
: অবশ্যই নতুন। আগামীকাল ক্যান্টিনে বসে চা খেতে খেতে বলব। ঠিক আছে?
নতুন সেই কথাগুলো কী? রাফি কি তাকে প্রপোজ করবে? বিয়ের কথা বলবে? আফিয়া শিহরিত হলো। নাস্তা শেষ করে আফিয়া চায়ের কাপে চুমুক দিতেই রায়লা বানু বললেন-
: তোর মামা ঠিক সাড়ে ন’টায় ফোন করবে। আমি বলেছি, তুই এসময় বাসায় থাকবি।
: মা, আজ আমার হাতে একদম সময় নেই। মামার সঙ্গে আমি পরে কথা বলব।
: পরে কবে? তারা আর কতদিন অপেক্ষা করবে?
: অনন্তকাল।
: কী বললি?
: মা, আজকে এসব বিষয় থাক। প্লিজ মা, প্লিজ।
এ মুহূর্তে ডক্টরস কেন্টিনে ঢুকলে মনে হবে, এখানে কোনো নাটকের মহড়া চলছে। আফিয়া দেখল, ক্যান্টিনের এক কোণায় পঞ্চমীর চাঁদের আকার নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাঝখানে ডা. রাফি। দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে রাফি বলল-
: নামাস্তে, মেরা পেয়ার ভারা নমস্কার।
নমস্কারের উত্তর এলো তুমুল করতালির মাধ্যমে। আফিয়া বিভ্রান্ত হলো। রাফি কি তাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো উচ্চারণ করল? এর মানে কী? রাফি কি ঠিক করে রেখেছে, সবার সামনে প্রকাশ্যে আফিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে? এ প্রশ্নের মীমাংসা না হতেই রাফির মুখে শোনা গেল-
: চলে সাথ সাথ...
সাথ-সাথ চলার অঙ্গীকার করার সময় আশেপাশে একজনকে থাকতে হয়। তার হাতে হাত রাখতে হয়। ডা. রাফির পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আফিয়া আবারও বিভ্রান্ত হলো। রাফি কি চাচ্ছে, আফিয়া তার পাশে গিয়ে দাঁড়াক! আফিয়া উঠে দাঁড়াবে কিনা ভাবছে, এসময় ডা. শিমূলকে দৌড়াতে দেখা গেল। সে রাফির সামনে গিয়ে বামহাতের কনিষ্ঠ আঙুল প্রদর্শন করতেই রাফি ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল-
: মাইনাস করতে গেছিলি, না ফোন?
: আজকের মতো মাফ কইরা দেও বস।
রাফির পাশে শিমূল দাঁড়াতেই সে পুনরায় আগের সেই সংলাপ উচ্চারণ করে বলল-
: বাড়ে বাড়ে দেশোমে ছোটে ছোটে বাতে হোতে রাহেতে হ্যায়। কেন আমি এই কথা কইলাম, সেইটা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝবার পারছেন।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল-
: পারছি-পারছি।
কলরব থামতেই ডা. সিফাত কাচমাচু ভঙ্গিতে রাফির দিকে তাকিয়ে বলল-
: হুজুর। গরীব বইলা অবহেলা করলেন! বড়র সঙ্গে বড়র প্রেম হয়- এইটা জানি। কিন্তু ঘরের পাশে ঘর। একবার পায়ের ধূলা দিলে কী এমন ক্ষতি হইত!
ডা. মবিনকে এবার দৃশ্যপটে অবির্ভূত হতে দেখা গেল। যাত্রাপালায় বিবেক বলে এক ধরনের একটা চরিত্র থাকে। মবিন এই চরিত্রে অভিনয় করছে। সে আবেগ থরথর কণ্ঠে বলল-
: আমার প্রিয় সহযোদ্ধা ভাই ও বন্ধুরা...
ভাই-বন্ধু ছাড়াও ক্যান্টিনে এক দল মামা আছে। সামনে দাঁড়িয়ে একজন সে কথা মনে করিয়ে দিতে মবিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল-
: মবি, ছোট্ট একটা সংশোধনী আছে।
: কী?
: সম্বোধন পর্ব থেকে মামারা বাদ পইড়া গেছে!
: থ্যাংক ইউ ফর ইয়োর সংশোধনী। সহযোদ্ধা ভাই-বন্ধু ও মামারা। আপনারা এতক্ষণ যা দেখলেন, তা নাটকের সামান্য অংশ মাত্র। ট্রাম্প জমানায় ভারতে পুরো নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। আপনারা জানেন, সাম্রাজ্যবাদের দোসর আমেরিকার সাবেক এক নম্বর ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতে ছুটে এসেছিলেন। কারণ, সেখানে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ তৈরি হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র হচ্ছে, যেখানে সে স্বার্থের গন্ধ পায়, সেখানেই ছুটে যায়।
দর্শক-সারি থেকে উচ্চারিত হলো-
: শেইম। শেইম।
মবিন আগের কথা সূত্র ধরে বলল-
: আমরা সেসময় দেখেছিলাম, সাবেক আমেরিকাপ্রধান হিন্দি ভাষায় কথা বলে ভারতবাসীকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। আমি মনে করি, তখন যদি বাংলাদেশে কোনো স্বার্থ হাসিল করার প্রয়োজন দেখা দিত, তাহলে তার মুখে বাংলাও শোনা যেত।
দর্শকদের পক্ষ থেকে উচ্চারিত হলো-
: সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক। নিপাত যাক।
নিপাত করতে করতে রাউন্ডে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। একদল ইন্টার্নি ডাক্তারের সঙ্গে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যেতেই মৃত্যুর গন্ধ পেল আফিয়া। কিছুক্ষণ আগে জাকির হোসেন নামে ১১ বছরের একটি ছেলে মারা গেছে। তার লাশের পাশে কাউকে না দেখে অবাক হলো আফিয়া। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, শরীরের ৪৭ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় মৃত্যুর শিকার হওয়া হতভাগ্য এ কিশোরকে অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে ভর্তি করা হয়েছিল। জাকিরের মারা যাওয়ার বিষয়টি আফিয়ার মধ্যে একটা ঘোর তৈরি করে।
এ ঘোর না কাটতেই পাশ থেকে কচিকণ্ঠে আর্তচিৎকার ভেসে এলো। আফিয়া দেখল, ছোট্ট একটা মেয়ে পোড়া শরীরের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদছে। মেয়েটির নাম মরিয়ম। পিতৃহীন মরিয়মের পরিবারে সেই একমাত্র সন্তান। আগুনের লেলিহান শিখায় দগ্ধ সন্তানের শরীর চোখের জলে সিক্ত করে তার দরিদ্র মা একটু পর পর শুধু বলছে-
: তোমার কিছু হবে না মা। আম্মু আছে...
এ দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। আফিয়া হাসপাতালের বারান্দায় চলে এলো। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এ সময়ের বৃষ্টি নিয়ে খনার একটা বচন আছে- যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পূণ্য দেশ। আজ মাঘ মাসের কত তারিখ? ১৫, না ২৫? মাঘের বৃষ্টি কি এটা প্রমাণ করার জন্যই ঝরছে- এই পূণ্য দেশে এখন ধন্য রাজার শাসন চলছে; নাকি পরিচয়হীন জাকির হোসেনের পাশে কান্না করার কেউ নেই দেখে সে আকাশ থেকে নেমে এসেছে! আফিয়া দিশেহারা বোধ করল। পরে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর সে ফোন হাতে নিল। ফোন করে মাকে জিজ্ঞেস করল-
: মা, তোমাদের আমেরিকার ওই ছেলের পদবি কী! ওসি না ডিসি?
: মানে?
: ওসি মানে হল, ওনিয়ন কাটার। আর ডিসি হল, ডিস ক্লিনার। ডিভি লটারি জিতে আমেরিকায় যাওয়ার পর হোটেল-রেস্তোরাঁয় যারা পেঁয়াজ কাটে, থালা-বাসন পরিষ্কার করে, তাদের এসব নামে ডাকা হয়।
রায়লা বানু কঠিন স্বরে বললেন-
: আফিয়া! তোর মামা যে ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ের প্রস্তাব এনেছে, সে ডিভি পেয়ে আমেরিকা যায়নি। আগের জেনারেশন থেকেই তারা আমেরিকা প্রবাসী।
: তাহলে তো পাত্র হিসেবে সে আরও ডেঞ্জারাস মা। দেখা যাবে, এরই মধ্যে কমপক্ষে একশ’ মেয়ের সঙ্গে ডেটিং করে ফেলেছে।
: আফি, ফাজলামি করবি না। তোর মামা বলেছে, ছেলে খুব পরহেজগার। ধর্মে-কর্মে খুব মনোযোগ।
: ওকে মা। তুমি মামাকে বলে দাও, আমি ওই আমেরিকান ধার্মিককেই বিয়ে করব।
রায়লা বানুর মনে হল, তার বুকের উপর থেকে দশমণ ওজনের পাথর নেমে গেল। তিনি লম্বা শ্বাস নিলেন। বললেন-
: আমরা সবাই তোর মুখ থেকে এ কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। থ্যাংকস।
ফোনের ওপাশ থেকে হঠাৎ কান্নার আওয়াজ শোনা যেতেই রায়লা বানু বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন-
: কী হয়েছে আফি! কাঁদছিস কেন?
কোনো উত্তর না পেয়ে রায়লা বানু এবার ব্যাকুলকণ্ঠে বললেন-
: মা-মনি! কী হয়েছে তোমার! কথা বলো। কথা না বললে বুঝব কিভাবে!
: মা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
: কেন?
: আমি জানি না। মা, আমার সামনের নিষ্পাপ, সুন্দর ফুলের মতো কিছু মুখ। সুন্দর সেই মুখগুলো আগুনের লেলিহান শিখায় বীভৎস হয়ে আছে। মা, এদের মধ্যে আমি আমার অনাগত সন্তানের মুখও দেখতে পাচ্ছি। আমার সন্তানের মন খারাপ হলে, ব্যাথা পেলে মায়ের মমতা নিয়ে আমি পাশে দাঁড়াতে পারব।
অসুস্থ হলে একজন চিকিৎসক হিসেবে সেবা দিতে পারব। কিন্তু মা, এ দেশের বিবেকহীন লোভী মানুষের বদমায়েশিতে গভীর রাতে যাত্রীবোঝাই কোনো লঞ্চকে যদি আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে, তাহলে সেই আগুনের থাবা থেকে ওদের কিভাবে রক্ষা করতে হবে, সেটা তো আমার জানা নেই মা! বলো মা, ওদের আমি কিভাবে রক্ষা করব? তারচেয়ে ওরা আমেরিকান পরিচয়েই পৃথিবীতে আসুক। আমেরিকাই ওদের জন্য নিরাপদ।
রায়লা বানু স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ফোনের ওপাশে তখনও ডা. আফিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে...
লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক।
এইচআর/জিকেএস