এই ফুটবল দল লইয়া আমরা কী করিব!
ফুটবল বিষয়ক বিখ্যাত ওয়েসব সাইট গোলডটকম সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের কাছে ৩-০ গোলে বাংলাদেশের পরাজয়ের পরপরই তাদের রিপোর্টের শিরোনাম যা দিয়েছিল, সেটা দেখেই গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শিরোনামের বাংলা করলে যা দাঁড়ায়, ‘মিনোজদের হারিয়ে সাফের সেমিতে মালদ্বীপ’ (যদিও গোলডটকম পরে ওই শিরোনামের কথাগুলো পরিবর্তন করে দিয়েছিল)। মিনোজ (ছোট দল) শব্দটা ইংরেজি হলেও সরাসরি লিখলাম এর মারাত্মক নেতিবাচকতা বোঝাতে। মালদ্বীপের কাছেও বাংলাদেশ এখন মিনোজ! অথচ এই মালদ্বীপ দেশটাকে ১৯৮৫’র সাফে কিভাবে ফুটবল খেলতে হয় সেটা শিখিয়েছিল বাংলাদেশ। ৮-০ গোলের জয়ের সেই গল্প আজ যেন বুড়োদের মুখে শোনা একটি রূপকথা!
রূপকথাই তো। আজকের অবস্থার সঙ্গে ৩০ বছর আগের তুলনা করলে রূপকথাই মনে হয়। কিভাবে ঠিক ৩০ বছর পর সম্পূর্ণ পরিস্থিতি উল্টে গেলো! ১৯৮৫ সালে আমরা যে জায়গায় ছিলাম, এখন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মালদ্বীপ। এখন তারা আমাদের শেখায় কিভাবে ফুটবল খেলতে হয়! সেই একই টুর্নামেন্ট। সাফ গেমস থেকে আলাদা হয়ে যদিও তা রূপ নিয়েছে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এবার নাম সাফ সুজুকি কাপ। দীর্ঘ এই সময়ে মালদ্বীপ তরতর করে এগিয়েছে, আর আমরা তরতর করে পিছিয়েছি। গোলডটকম তো আর এমনি এমনি মালদ্বীপের সামনে আমাদেরকে ‘মিনোজ’ আখ্যা দেয়নি!
এটা তাদের দোষ না। দোষটা আমাদের। আমাদের ফুটবল কর্মকর্তাদের। কোচ মারুফুল হক বেশ কয়েকবার বলেছেন, আমাদের ফুটবলারদের সমস্যা মানসিকতায়। মারুফুলের কথার সঙ্গে দ্বিমত করবো না। তবে, কথাটাকে একটু বাড়িয়ে বলতে চাই। আসলে শুধু ফুটবলারদেরই নয়, মানসিকতায় সমস্যা রয়েছে আমাদের দেশের ফুটবল সংশ্লিষ্ট সবার। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে যারা এ দেশের ফুটবল নিয়ে ন্যূনতম চিন্তাও করেন- তাদের সবার। কর্মকর্তাদের মানসিকতায় সমস্যা না হয় বোঝা গেলো, যারা ফুটবল নিয়ে চিন্তা করেন অর্থ্যাৎ দর্শকদের মানসিক সমস্যাটা আসলে কোথায়? ওই যে, ফুটবল দলের কাছে তারা যা নয় তার প্রত্যাশা করা!
বাংলাদেশ ফুটবলে কোচ যেন এক একজন অতিথি পাখি। হঠাৎ করেই কারও মাথায় উদয় হলো- এই কোচ ভালো নয়, একে পরিবর্তন করা দরকার। অমুককে ভালো লাগে কিংবা অমুক বিদেশি বাংলাদেশে এসে ঘুর ঘুর করছে কোচিং করানোর জন্য, তাকে নিলেই ভালো হয়। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত। পুরনোকে বাদ দিয়ে নতুনের হাতে তুলে দেয়া হলো ফুটবলারদের। নতুন কোচ মানেই নতুন ফর্মুলা, নতুন ফরমেশন, নতুন চিন্তাধারা। এতদিন ফুটবলাররা যা শিখে এসেছে তার পূর্ণাঙ্গ বিপরীত একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে হাঁস-ফাঁস করা ছাড়া ফুটবলারদের কীই বা করার থাকে (তাই বলে কাঠগড়া থেকে ফুটবলারদের নামিয়ে দিচ্ছি না)।
এই যেমন বর্তমান দলটার কথাই যদি বলি, খুব অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনজন কোচের অধীনে খেলতে হয়েছে। অনুশীলন করতে হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের লোডভিক ডি ক্রুইফ, ইতালির ফ্যাবিও লোপেজ এবং বাংলাদেশের মারুফুল হক। ডি ক্রুইফের সঙ্গে নানা টানা-পড়েন সত্ত্বেও বেশ কিছুদিন সম্পর্কটা টিকেছিল। তাকে বাদ দিয়ে হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতে ঢাকায় চলে আসা ইতালিয়ান ফ্যাবিও লোপেজকে আনা হলো বাংলাদেশের ফুটবলে। ফুটবলারদের মান যা ছিল তা আরও তলানিতে নামিয়ে আনলেন এই ইতালিয়ান। তার সঙ্গে বাফুফের মধুচন্দ্রিমা শেষ হতে সময় লাগলো না। সাফের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি টুর্নামেন্টের ঠিক আগ মুহূর্তে আবারও কোচের পরিবর্তন। এবার ঘরের ছেলের দিকেই মুখ ফেরালো বাফুফে। এক সময় যাকে নিষিদ্ধ করেছিল (ক্লাব ফুটবলে) সেই মারুফুল হকের হাতেই তুলে দেয়া হলো মামুনুলদের দায়িত্ব।
এও যেন এক অতিথি পাখির গল্প। হঠাৎ এলেন, দেখলেন আর খেলতে নেমে পড়লেন মাঠে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। নিজেদের মান কতটা তলানিতে নেমেছে তার উৎকৃষ্ট প্রদর্শনী করে সাফের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় বাংলাদেশের। মারুফুল প্রস্তুতির জন্য সময় পেয়েছিলেন মাত্র ২০দিন। মাত্র এই ক’দিনে একটি দলকে কিভাবে গড়ে তোলা যায়! ফুটবলবোদ্ধারা সন্দিহান হবেন নিশ্চিত। তবুও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যাওয়ার আগে অনেক আশার বাণী কোচ, অধিনায়ক এবং কর্মকর্তাদের মুখ থেকে শোনা গিয়েছিল।
সম্ভবত, আমাদের দেশের ফুটবলার, কোচ কিংবা কর্মকর্তা- তারা কেউই অন্যদের এগিয়ে যাওয়ার খবর রাখেন না। রাখলে নিজেদের দিকে তাকিয়ে এভাবে আশার বেলুন ফোলাতেন না। যেটা ফোলানোর আগেই ফুস করে ফেটে যায়। অধিনায়ক মামুনুল জানিয়েছিলেন, তারা নাকি কোচের কাছে কমিটমেন্ট করেছেন, ‘এবার ভালো কিছু করবেনই। নিজেদের সেরা সামর্থ্য দিয়ে।’
কেরালার ত্রিবান্দ্রাম স্টেডিয়ামে যা দেখালো মামুনুলরা, তা যদি বাংলাদেশের ফুটবলারদের সেরা সামর্থ্য হয়ে থাকে, তাহলে আক্ষেপের সঙ্গে বলতে হয়, এই ফুটবল দল লইয়া আমরা কী করিব! এমন অসাধারণ সামর্থ্য নিয়ে তারা একের পর এক ম্যাচে খেলতে নামবে আর বাংলাদেশকে লজ্জায় ডোবাবে তা হতে পারে না। মালদ্বীপের সামনেও যখন আমরা ‘মিনোজ’ হয়ে যাই, তখন লজ্জার বাকি আর কিছু কি থাকে?
আফগানদের বিপক্ষে এর আগে কোনোদিন হারেনি বাংলাদেশ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি নানা প্রতিকূলতা আর ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার অভাবের মধ্য দিয়েই আজ তরতর করে কিভাবে উঠে আসছে ফুটবলে, সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ৪-০ গোলে বাংলাদেশের পরাজয় শুধুই নিছক একটি খেলার ফলাফল নয়, এটা এ দেশের ফুটবল কর্তাদের কাছে একটা বার্তাও। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে অস্ট্রেলিয়া কিংবা জর্ডানের কাছে ৪-০, ৫-০ গোলে পরাজয় মেনে নেয়া যায়। কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনায় তারা যোজন যোজন এগিয়ে; কিন্তু আফগানিস্তানের কাছে ৪-০ গোলের পরাজয়, বুঝিয়ে দিল আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। এরপর মালদ্বীপও ৩-১ গোলে হারিয়ে বার্তা দিল, আমাদের ফুটবল নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসে গেছে।
যতই আক্ষেপ করে বলি, এই ফুটবল দল লইয়া আমরা কী করিব! কিন্তু, ওই যে প্রথমে বললাম, সমস্যা মানসিকতায়। সেটাই উপলব্ধি করা প্রয়োজন। মালদ্বীপের কাছে হারের পর কোচ মারুফুল বলেছিলেন, ‘সত্যি বলতে, এটাই আমাদের (ফুটবলের) মান; যেটা দিনকে দিন নিচের দিকে নামছে। আমাদের পাইপলাইনে মানসম্পন্ন খেলোয়াড়ও নেই। তৃণমূল পর্যায়ে অনেক কাজ করার দরকার।’
সাফে ব্যর্থতা খুঁজতে বাফুফে তড়িগড়ি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে । এই ব্যর্থতার কারণ খোঁজার জন্য তো তদন্ত কমিটির প্রয়োজন হয় না। মাঠের খেলায় ফুটবলাররা প্রমাণ করেছে, তাদের সামর্থ্যের লেভেল কোন পর্যায়ে। একে তো সামর্থ্য নেই, তারওপর দলীয় কোন্দলও না কি এমন বিপর্যয়ের মূল কারণ। দলের মধ্যে গ্রুপিং, একে অপরের সঙ্গে শীতল সম্পর্কের খবর ইতোমধ্যে মিডিয়ায় এসে গেছে। ফুটবলারদের মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়, নেই কোনো দেশপ্রেম। নইলে ক্লাব ফুটবলে প্রতিটি খেলোয়াড় নিজেদের উজাড় করে দেন; কিন্তু জাতীয় দলের বেলায় একেবারেই বেমানান হয়ে যান তারা কিভাবে?
দলীয় ম্যানেজার বলে একজন আছেন বাংলাদেশের ফুটবলে। একসময় বাফুফের কমিটি থেকে এই ম্যানেজারের কারণে পদত্যাগ করেছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট কাজী সালাউদ্দিন। অথচ, তার আমলেই বহাল তবিয়তে জাতীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে সরকারি টাকায় বিদেশ সফর করে যাচ্ছেন তিনি। দল যায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে, আর ম্যানেজার থাকেন ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত। তার ফেসবুক পেজ ঘাঁটলেই এর ঢের প্রমাণ পাওয়া যায়। অথচ, দলে সমন্বয়, শৃঙ্খলার বিষয়টি তার নজরেই নেই। অভিযোগ রয়েছে, জাতীয় দলে খেলার চেয়ে এই ম্যানেজারের কারণেই দলবদলের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন ফুটবলাররা। কারণ, তিনিই ঘরোয়া ফুটবলে খেলোয়াড় বেচা-কেনার মূল কারিগর। ফুটবলারদের এমন কুশীলবের হাত থেকে বের করতে না পারলে ফুটবলের উন্নতি কতোটা সম্ভব সেটা ভেবে দেখতে হবে।
ক্লাব ফুটবলে এক একজন ফুটবলার ক্রিকেটারদের চেয়েও বেশি টাকা পেয়ে থাকেন। কয়েকদিন আগেই খবরের শিরোনাম, এবারের দলবদলে নাকি মামুনুলকে ৬০ লাখ টাকা দিচ্ছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। এমিলি, জাহিদরা ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে দাবি করেন; কিন্তু কোন পর্যায়ের ফুটবল খেলেন যে, এতটাকা তাদের দিতে হবে! এ বিষয়টা যতদিন উপলব্ধিতে না আসবে, ততদিন টাকার পেছনেই দৌড়াবে ফুটবলাররা; তাতে এ দেশের ফুটবলের কোনো উন্নতি হবে না।
ঘরোয়া ফুটবলে পরিবর্তন প্রয়োজন। মাসের পর মাস ধরে একটা লিগ চলে। এক রাউন্ডের খেলা শেষ হতে কয়েক সপ্তাহও লেগে যায়। ফলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের যে আশঙ্কা তৈরি হয়, তা থেকে কিভাবে বেরুবে বাফুফে! ফিক্সিং চলে এলে তো আর খেলার দরকার নেই, মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলেই টাকা আর টাকা। এরই করুণ পরিণতি দেখা গেলো, সপ্তাহখানেক আগে বাফুফে ভবনে আরামবাগের ক্ষুব্ধ সমর্থকদের হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায়।
ফুটবল উন্নয়নে বাংলাদেশের রোল মডেল হতে পারে মালদ্বীপই। ফুটবলে একটি বড় স্বপ্ন সামনে রেখেই এগিয়ে যাচ্ছে তারা। শক্ত ফুটবল সংস্কৃতির কল্যাণে ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্রে এখন প্রতিভাবান ফুটবলারের ছড়াছড়ি। তৃণমূল থেকে ফুটবলার তৈরি করে নিয়ে আসার ব্যাপারে মালদ্বীপ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্নমুখি কার্যক্রমের সুফল এখন ভোগ করছে তাদের জাতীয় দল। আলী আশফাক, আহমেদ তরিকের মতো উঁচুমানের খেলোয়াড়েরা ফুটবলে মালদ্বীপকে নিয়ে গেছেন অনেক দূর।
বাংলাদেশের ফুটবলকে যদি টেবিল থেকে বের করে আনা না যায়, তাহলে অবনতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবেই। দেশের মধ্যেই ক্রিকেট যেভাবে এগিয়েছে, সেই মডেল সামনে ধরে এগোনোর চেষ্টা করলে- সালাউদ্দিন, কায়সার, সাব্বির, আসলামদের মত খেলোয়াড় বের করে আনা কঠিন কিছু নয়। তাহলে ৩০ বছর আগের ঐতিহ্য আবারও ফিরবে মাঠে।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, জাগোনিউজ
এইচআর/পিআর