রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনই শেখ হাসিনার বৈশিষ্ট্য
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিন বছর চলে গেছে। আর বাকি দুই বছর। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, কতটুকু হয়নি, সে হিসাব করার সময় সম্ভবত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং সরকারের পক্ষ থেকে এই হিসাব করার কোনো উদ্যোগ কি আছে?
এটা মনে রাখতে হবে যে, গত নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতির অঙ্গনে বড় ধরনের কোনো অশান্তি দেখা যায়নি। সরকারবিরোধী রাজনীতি মাঠে নেই। রাজনৈতিক কারণে বা বিরোধী দলের বিশৃঙ্খলার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে এই সময়ে রাজনীতির বাইরের এক অচেনা শক্তি আকস্মিক আঘাত হেনে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড – সবকিছু উলটপালট করে দিয়েছে।
এই শক্তির নাম করোনাভাইরাস এবং এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে এসে গোটা বিশ্বের সামনেই এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশকেও করোনার আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে করোনা তার দাপট দেখাতে শুরু করেছে। এখনো চলছে। এই সময়ে করোনার ধরন বদল হয়েছে একাধিক বার, কিন্তু এটাকে বশে আনা সম্ভব হয়নি। এখন চলছে ওমিক্রনের ভয়। কতদিন করোনা এভাবে তার উল্লাসনৃত্য অব্যাহত রাখবে, তা নিয়ে কেউ আগাম কিছু বলতে পারছে না। এক নিয়ন্ত্রণহীন অনিশ্চয়তা নিয়েই চলতে হচ্ছে সবাইকে।
সরকারের আগামী পরিকল্পনা, কর্মকৌশল, নির্বাচনী অঙ্গীকারের যা যা বাস্তবায়ন হয়নি, সেগুলোর বাস্তবায়নের ব্যবস্থা – সবই করতে হবে করোনাকে হিসাবে রেখেই। যারা বাস্তববোধ সম্পন্ন তারা এটা স্বীকার করবেন যে, সরকারের গত সময়ের অর্জন কম নয়। উন্নয়ন যাত্রা বন্ধ হয়নি। করোনা মোকাবিলায় প্রাথমিকভাবে কিছু সমস্যা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতির ঘটনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের ঘাড়ে ব্যর্থতার দায় বড় আকারে চাপানো যায়নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকে গত ১৩ বছরে অর্জনের তালিকা ছোট নয়। ২০০৯ সালে আমাদের মাথাপিছু গর আয় ছিল ৭০৯ মার্কিন ডলার। এখন তা ২ হাজার ৫৫৪ ডলার।
২০০৯ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখন তা ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের যে ঘাটতি ছিল, এখন তা নেই। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি হয়েছে। পদ্মা সেতুসহ বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পথে। এগুলো চালু হলে সত্যিকার অর্থেই নতুন এক বাংলাদেশ সবার সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।
তবে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ নেই, তা কিন্তু নয়। অনেক অর্জনের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় আছে যেগুলো সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়েই আছে। জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের সাফল্যের কথা স্বীকার করে এটাও বলতে হবে যে, দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান রোধ করা সম্ভব হয়নি।
ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে স্পর্শকাতর মনোভাবের সুযোগ নিয়ে এক ধরনের বাড়াবাড়ি করার প্রবণতা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সামনে মাঝে মাঝেই হুমকি তৈরি করছে। বিদায়ী বছরের শেষ দিকে শারদীয় দুর্গাপূজার সময় ও তারপর দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের ব্যর্থতার বিষয়টি সামনে এসেছে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকট হয়ে সামনে এসেছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে সমস্যা দলের মধ্যে যত সংখ্যক ‘বিদ্রোহী’ তৈরি করেছে তা দলের জন্য স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা যায় না।
সরকারের জন্য বিব্রতকর হয়েছে কিছু মন্ত্রী-এমপি-নেতার হঠকারী কর্মকাণ্ডও। একজন প্রতিমন্ত্রীকে নিয়েও সরকারের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগে এখন শেখ হাসিনা-নির্ভরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে গত নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সক্ষম না হলে পরের নির্বাচনের সময় সমস্যা হতে পারে।
তবে সরকারের জন্য ভালো খবর হলো, দেশে বিরোধী দলের অবস্থান খুবই দুর্বল। সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ব্যস্ত আছে দলের নেতৃত্ব নিয়ে। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তার মুক্তি ও বিদেশে গিয়ে চিকিৎসার সুযোগ পেতে বিএনপি নানা উপায়ে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি।
শেখ হাসিনার কাছ থেকে দাবি আদায় করার মতো সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির আছে বলে মনে হয় না। গত নভেম্বর মাস থেকে বেগম জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন বলে ক্রমাগত প্রচার এবং আন্দোলনের হুমকি দিয়েও বাস্তবে সরকারের ওপর বড় চাপ তৈরি করতে পারেনি বিএনপি। শেখ হাসিনা বেগম জিয়ার মুক্তির বিষয়ে নতুন করে উদারতা দেখাবেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন না।
জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ১১ জানুয়ারি বিকেলে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকেও এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বিএনপি-জামায়াতের ব্যাপারে তার অবস্থান বলায়নি। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ভালো কাজ করলেই তার বিরুদ্ধে লেগে থাকাটা একশ্রেণির মানুষের অভ্যাস। যারা এ দেশের স্বাধীনতা চায়নি এবং খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, যারা দেশের উন্নয়নকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তাদের কিছু প্রেতাত্মা এখনো সমাজে আছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে আছে এবং তারাই এগুলো করে বেড়াচ্ছে। বিদেশের কাছে নালিশ করে বেড়াচ্ছে’।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধী, জাতির পিতার খুনি ও তাদের আত্মীয়স্বজন এবং বিদেশে পলাতক আসামি, এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করে কারাগারে থাকা এবং ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও দুর্নীতির মামলায় পলাতক ফেরারি আসামিরাই এসব দেশবিরোধী অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রে যুক্ত রয়েছে’।
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আজকে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি আর সেই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে বদনাম করে বেড়াচ্ছে দেশে-বিদেশে। বাংলাদেশের উন্নয়নটা যারা সহ্য করতে পারে না, তাদের মুখেই কেবল কিছুই হলো না, এই কথা’।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলার তা স্পষ্ট করেই বলেন। পেটে কিছু, মুখে কিছু, এমনটা তার স্বভাবে নেই। স্পষ্ট কথা অপ্রিয় হলেও তিনি খোলাখুলি বলেন। এতে অনেকে অখুশি হন। আবার মন জুগিয়ে কথা বলার অভ্যাসও অনেকের অপছন্দ।
শেখ হাসিনা যে স্পষ্ট কথা বলেন, এটাকে তার গুণ হিসেবেই দেখা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের যে অংশটুকু উদ্ধৃত হয়েছে, তা তিনি ওই সভায়ই প্রথম বলেছেন, তা নয়। এমন কথা তিনি আগেও বলেছেন। এই কথাগুলোর মধ্যে তার একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি এবং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান সম্পর্কে শেখ হাসিনার মনোভাব স্পষ্ট।
আমাদের দেশে আজকাল গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুষ্ঠু নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার লোকের অভাব নেই। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সরকার পরিবর্তন হয়েছিল কোন প্রতিক্রিয়ায়?
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা যে জঘন্য অপরাধ ছিল, হত্যার বিচার বন্ধ করা যে একটি অপরাধ ছিল, সেটা খুব কি নিন্দিত বা সমালোচিত হয়েছে? শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাবেন বলে মনে হয় না।
লেখাটি শেষ করতে চাই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এম এম আকাশের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাকে একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তার বাবা-মা-ভাইদের হত্যা করা হয়েছে। তারপর তাকেও হত্যা করার একাধিক চেষ্টা হয়েছে, এসব বিষয় তাকে কুরে কুরে খায়। কিন্তু তিনি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী।
একজন স্টেটসম্যানের কোয়ালিটি শুধু এটা নয় যে তিনি কেবল শত্রু চেনেন, একজন স্টেটসম্যানের দায়িত্ব হলো, সমগ্র নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করা। একজন স্টেটসম্যান হিসেবে তার নিজস্ব দল. তাঁর শত্রু, তাঁর মিত্র এসবের ঊর্ধ্বে উঠে যেটুকু উদারতা ও পক্ষপাতহীন বিবেচনা থাকলে ভালো হতো, সেটা হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নিষ্ঠুর-করুণ ইতিহাসের কারণে হচ্ছে না। সেটা হলে আমাদের রাষ্ট্রের লাভ হতো। আমরা জানি রাষ্ট্রনেতাকে নিজের ব্যক্তিসত্তা, শ্রেণি ও দলের ঊর্ধ্বে উঠে ‘নিরপেক্ষ দর্শকের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। যদিও তা খুবই কঠিন’।
শেখ হাসিনা রাজনীতিতে নিরপেক্ষ দর্শক হবেন এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনই তার বৈশিষ্ট্য।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/জিকেএস