মহামানবের প্রত্যাবর্তন এবং স্বাধীনতার পরিপূর্ণতা
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। কারণ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার পর লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে দেশের পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন এই দিনে। বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে, তিনি পাকিস্তানের কারাগারে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, যেখানে তিনি হাস্যকর বিচারের মাধ্যমে প্রদত্ত তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দুঃসহ মুহূর্ত গণনা করেছিলেন।
বিশ্বের মানচিত্রে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের মূল্যায়ন করা আমাদের জন্য একটি কঠিন কাজ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা বঙ্গবন্ধুর চোখে সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার বিচক্ষণ, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং রূপান্তরকারী নেতৃত্বের গুণের কারণে, তিনি এই পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
এভাবে তিনি দেশের নাগরিকদের পাকিস্তানি জান্তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ভয়ে, পাকিস্তানি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য একটি প্রতারণামূলক মামলা পরিচালনা করে। তবে বিশ্বনেতাদের বিরোধিতা ও চাপের কারণে তারা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পাকিস্তান সরকারের ধারণা ছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিলে তারা হয়তো যুদ্ধে জয়ী হতে পারত। তবে তারা তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ করার সাহস শেষ পর্যন্ত দেখায়নি।
বঙ্গবন্ধুকে একটি প্রতারণামূলক বিচারে ফাঁসি দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের ব্যাপক অভিপ্রায়ের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা অনেকেই করতে পারেন। সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হলো, তারা ভীত ছিল এজন্য যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার কূটনৈতিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সংগ্রামের ইতিহাসের পুরো গতিপথ পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ভাষণ যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে একত্রিত করেছিল দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে। পাকিস্তানি জান্তা সরকার জনগণকে প্রভাবিত করায় শেখ মুজিবের ক্ষমতার জন্য বেশ উদ্বিগ্ন ছিল।
এরপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানি শাসক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে ভয় পান এবং তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে রাজি হন। পাকিস্তানের কারাগারে ৯ মাসের যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার পরে বঙ্গবন্ধু একদিনও বিদেশে কাটাতে চাননি। তিনি তার প্রেমময় জন্মভূমিতে ফিরে আসার জন্য খুব আকুল ছিলেন। এরপর ১৯৭২ সালেরর ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের খবর শুনে, ১৯৭১ সালের মার্চের পরে প্রথমবারের মতো ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির শীতের সন্ধ্যায় রেডকোর্স ময়দানে প্রায় ৫ লাখের বেশি মানুষ তাদের বীরের কণ্ঠ শোনার জন্য মিলিত হয়েছিল। তিনি এতটাই আবেগাপ্লুত ছিলেন যে, তিনি যখন দেশবাসীর সামনে কথা বলতে শুরু করেন তখন তার চোখ অশ্রুতে ভরে গিয়েছিল।
তিনি বক্তৃতা শুরু করলে সমগ্র দেশবাসী ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির তাৎপর্য বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এর মতোই অপরিসীম। যদি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হিসেবে দেখা হয় তবে উপসংহার ছিল ১০ জানুয়ারি। ইতিহাসের দুটি ঘটনার সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু জড়িত ছিলেন, যা ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুবই আনন্দের একটি বিষয়। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেছিলেন।
অন্যদিকে তিনি ১০ জানুয়ারির ভাষণের মাধ্যমে দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়ন, জাতীয়তাবাদ ও বীরত্বের চেতনা সমুন্নত রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনের ব্যাপকতা অসাধারণ। কারণ স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ তার অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হতে পারত। তাই অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে তার অনুপস্থিতি পুঁজি করে রাজনৈতিকভাবে উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিরা দেশকে আরও সমস্যায় ঠেলে দিতে পারতো। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত অনুসারীদের-(তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম) যারা তার দর্শনকে সমুন্নত রেখে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছিলেন- কারণে এ দলগুলো তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কিন্তু একই সঙ্গে নির্মম বাস্তবতা হলো, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে না ফিরলে এই নেতারা হয়তো দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারতেন না।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সাড়ে তিন বছর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পদে আসীন ছিলেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন এবং দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দিকে মনোযোগ দেন। তাছাড়া খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু অন্যান্য সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের তুলনায় স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান চূড়ান্ত করতে সফল হয়েছিলেন। অনেকের মতে, এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বল্প সময়ের ক্ষমতা কালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর একটি।
বঙ্গবন্ধু খুব কৌশলে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীনতার তিন মাসের মধ্যে মিত্র বাহিনীর সদস্যদের ভারতে ফিরিয়ে নিতে রাজি করাতে পেরেছিলেন। একটিও ছিল নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের প্রেক্ষাপটে একটি বিরল ঘটনা কারণ আমরা অদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বিভিন্ন দেশে মিত্রবাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান লক্ষ্য করেছি। এ কথা ঠিক যে এই কাজটি সম্পন্ন করা সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল। যারা ভারত সরকারের সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে চলতে পারবে না বলে মনে করেছিল তাদের জন্য এটি ছিল একটি স্পষ্ট সতর্কবাণী।
বঙ্গবন্ধুর পরিপক্ব কূটনীতির-যার প্রধান ভিত্তি ছিল ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব’- কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং আরও কয়েকটি দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিশ্বের ১৪০টি দেশ খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সংবিধানের চারটি স্তম্ভের একটি হিসাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে স্বীকৃতি দিয়ে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু যেটি ছিল তার পক্ষে একটি সাহসী সিদ্ধান্ত।
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তার ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার গভীরতা ফুটে উঠেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি, তিনি সংবিধানের অন্য তিনটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রকে (সবার জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার বোঝাতে) বেছে নিয়েছিলেন। তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে সবার জন্য স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে, সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণ তাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পরম স্বাদ অনুভব করে এই দিনে। ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে না ফিরলে দেশের স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি বিপর্যস্ত হতে পারত। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য শক্ত ভিত্তি রচনা করলেও দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি।
পাকিস্তানের দালালরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে তার অবদান এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসকে গুরুত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, তাদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে কারণ বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে দেখে আমরা খুবই আনন্দিত। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আমাদের উচিত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন করার শপথ নেওয়া।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস