ছাত্র রাজনীতির সুফল পেতে করণীয়
সম্প্রতি কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ঘটনা ছাত্র এবং শিক্ষক রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ অবস্থায় ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কিংবা শৃঙ্খলার মধ্য নিয়ে আসার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে যথাযথ সুফল পেতে ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একাডেমিক ইন্সটিটিউটে একটি প্রশাসনিক পদ। বিষয়টি এমন নয়, দেশের সবচেয়ে বিদ্বান ব্যক্তি বা সফল গবেষকই কেবল উপাচার্য হবেন। বাস্তবতা হচ্ছে সরকারের সাথে সঙ্গতি রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালাতে হয়।
এক্ষেত্রে সরকার তার নিজের পছন্দের লোকদেরকেই এ পদে বসান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি সেই দলের মতাদর্শের সাথে সমমনা না হন কিংবা রাজনৈতিকভাবে বিরোধী থাকেন তাহলে তাকে সরকার ভালোভাবে মেনে নিতে পারে না। বলা যেতে পারে, যারা উপাচার্য হন, তারা মূলত রাজনীতির বাইরের। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে আমাদের মাঝে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। ঢাকা, রাজশাহী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ আছে। এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনেকগুলো কমিটি রয়েছে, যেগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে পুরণ করতে হয়। যেমন ডিন, সিন্ডিকেট, সিনেট সদস্যসহ বিভিন্ন ফোরাম। এ পদ্ধতি তথা নির্বাচন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে এবং আমাদের দেশেও রয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের এই অধ্যাদেশ জারি করেন। এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী নির্বাচন হলে রাজনৈতিক প্যানেলের বিষয়টি অবশ্যই আসবে। বলা হয়ে থাকে, এই প্যানেলসমূহ আওয়ামীপন্থী অথবা বিএনপিপন্থী। বিভিন্ন গ্রুপ যখন নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন তারা একটি ইশতেহার দেয়। এতে তাদের যাবতীয় করণীয়সমূহ উল্লেখ থাকে। আর এগুলো একটি কাগজে মুদ্রণ করে বিলি করতে হয়। এক্ষেত্রে যারা সাদা কাগজ ব্যবহার করে, তাদেরকে বলা হয় সাদা দল। আরেক দল নীল কাগজ ব্যবহার করে, এজন্য সে দলকে নীল দল বলা হয়। যেভাবে বিভাজন দেখানো হয়, আসলে ততটা নয়।
জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের মত দলাদলি এবং অনাকাঙ্খিত ঘটনা এ নির্বাচনে ঘটে না। কারণ শিক্ষকদের রাজনীতি আসলে ওই পর্যায়ের রাজনীতি নয়। দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকা, রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচন হয়নি। বলা যেতে পারে আমরা করতে পারিনি। যেখানে গণতান্ত্রিক নির্বাচন করার সুযোগ রয়েছে, সে নির্বাচনে শিক্ষকরা অংশ নেন। শিক্ষকদের নির্বাচনের সময় কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটে না। দলাদলি এবং ক্ষোভের বিষয় প্রকাশ দেখা যায় না। গণমাধ্যমে যেমনটি স্থান পায়, আসলে তেমন গুরুতর নয়। সুষ্ঠু সুন্দর এবং গণতান্ত্রিকভাবেই শিক্ষকদের নির্বাচন হয়।
অনেকে মনে করেন, শিক্ষকরা রাজনীতি এবং শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্ষমতার পথ খোঁজেন। যেমন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতার আলোতে এসব ধারণা সঠিক নয়। ছাত্র নেতারা এবং নেতৃত্ব কাউকে উপাচার্য বানাবে এসব ধারণা অতি সরলীকরণ। এ রকম কখনো হয় না। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন- গবেষণা করলেও এর সত্যতা মিলবে না। শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ভাবাদর্শগত মিল পাওয়া যাবে। ইদানীং আমাদের ক্যাম্পাসগুলো অশান্ত হয়ে উঠছে। আমরা অনেক সময় মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা কোনো দ্বীপের মত। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় একটি আদর্শের জায়গা এবং ইউটোপিয়ান সমাজ। আমাদের দেশে রাজনীতিসহ সর্বত্র দাঙ্গাহাঙ্গামা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নানা বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। এসব বিষয়ের বিস্তৃতি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আছে। যারা শিক্ষক রাজনীতি করেন, তারা যদি নৈতিক জায়গা থেকে বলিষ্ঠ সাহস দেখিয়ে ছাত্র রাজনীতির সব অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে পারতেন বা প্র্রতিরোধে ভূমিকা রাখতেন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন অস্থির হওয়ার প্রবণতা কমে যেত। নেতিবাচক সমালোচনা স্থান পেত না। শিক্ষকরা রাজনীতি করেন বলেই এসব ঘটনা ঘটছে -এ মন্তব্য সঠিক নয়।
ছাত্র রাজনীতি অনেক জায়গায় বন্ধ রয়েছে। ঢাকা শহরের নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নেই। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ বলতে সেখানে কোনো ছাত্রলীগ নেই, ছাত্রদল কিংবা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট নেই। তাহলে সেখানে আছে কী? আছে ছাত্রশিবির এবং হিযবুত তাহরীর। ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার ১২ আসামি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আইন করে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে পারে। কিন্তু এর পরিণতি হবে ছাত্রশিবির, হিযবুত তাহরীর তথা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে জোড়ালো অবস্থান। আশির দশকে মাসের পর মাস বিশ্ববিদ্যালয় অনির্ধারিত বন্ধ থাকত। ক্যাম্পাসে গোলাগুলিসহ নানা প্রতিকূল অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ পেয়েছি। ষাট এবং সত্তর দশকে রাজনীতিতে আদর্শিক একটি বিষয় ছিল। সে সময় গোটা বিশ্ব দুইভাবে বিভক্ত ছিল। একটি ধনবাদী সমাজ ব্যবস্থা। শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণসহ নানা মতাদর্শ চর্চা হত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর থেকে শুরু করে ইরানের ইসলামী বিপ্লব, আফগানিস্তানের তালেবান উত্থান-পতন, আলকায়দা, আইএস ইত্যাদি ছাড়া আদর্শভিত্তিক কোনো আলোচনা আর নেই। ছাত্র রাজনীতিকে উদ্বুদ্ধ করার মত কোনো আদর্শ আমাদের সামনে নেই।
বলা হয়ে থাকে, ছাত্র রাজনীতি মূল রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে। বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ কায়েম হবে- এমন আদর্শ ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করা গেলে; ডিজিটাল, মধ্যম এবং ধনী রাষ্ট্রে বাংলাদেশকে পরিণত করার দিকে ছাত্র রাজনীতিকে ধাবিত করলে, তাদের সামনে এক ধরনের আদর্শ কাজ করত। কেবল ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে সেবিষয়ে আমরা সুনাগরিক, সুশীল সমাজ এবং রাজনীতিবিদরা এক হতে পারেনি। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। ২০০৭-০৮ সালে গোটা জাতিকে পুনঃপাকিস্তানিকরণ বা সামরিক যাঁতাকল থেকে ছাত্র-শিক্ষকরা বাঁচিয়েছে। এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে দোদ্দুল্যমানতা বা প্রত্যাশিত রায় না পাওয়ার অবস্থা দেখা দেয়, তখন কিন্তু এই ছাত্রসমাজই ‘গণজাগরণ মঞ্চে’র মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে দেশের দুর্দিনে এই ছাত্র সমাজই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করবে। তাদের উপরই আমাদের ভরসা রাখতে হবে।
’৯০ এর দশকের পর থেকে ছাত্র রাজনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে- এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি অনেক খারাপ পর্যায়ে রয়েছে এমনটি বলা যাবে না। ছাত্র রাজনীতিতে এখন যেসব ঘটনা ঘটছে তা অতীতের ধারাবাহিকতা মাত্র। তবে রাতের পর রাত গোলাগুলি, মাসের পর মাস ক্যাম্পাস বন্ধ থাকার মত ঘটনা এখন ঘটছে না। কোনো অবস্থাতেই ছাত্রদের রাজনীতিবিমুখ করা যাবে না। যদি ছাত্ররা নিজেরাই রাজনীতিবিমুখ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নেতৃত্ব সংকটে পড়বে। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। সুশীল সমাজ থেকে অনেক কথাই বলা হয়ে থাকে। এমনকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করা হয়। শেষ পর্যন্ত আমাদের এটা স্বীকার করতেই হবে, দেশের রাজনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিভাবেই সমাধান করতে হবে এবং রাজনীতিবিদরাই সমাধান করবেন। এজন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মদের রাজনৈতিক অনুশীলন বন্ধ করা যাবে না।
সঠিক ছাত্র রাজনীতি করার জায়গা তৈরি করে দিতে হবে। এব্যাপারে ছাত্র রাজনীতি সঠিক নিয়মনীতির মধ্যে আনয়ন করতে হবে। যেমন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, ২৯ বছরের বেশি কেউ ছাত্র রাজনীতি করতে পারবে না। এ বিধানটি অন্য সংগঠনগুলো অনুসরণ করলে আমরা গুণগত পরিবর্তন পেতাম। এক সংগঠনে ২৯ বছর এবং অন্য সংগঠনে ৪৯ বছরের কেউ সভাপতি- এমন হতে পারে না। কেবল প্রকৃত ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতিতে থাকলে বিশৃঙ্খলা কমত। ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাত্র সংসদ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে পারিনি। জাতীয়, স্থানীয় এবং শিক্ষক নির্বাচন হলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা হয়নি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে আমরা জাতীয় পর্যায়ে অনেক ভালো নেতৃত্ব পেতাম। এই নেতৃত্বের ফলে আমাদের জাতীয় সংসদের চেহারা পাল্টে যেত। এখন রাজনীতিতে শতকরা ৮০ ভাগ ব্যবসাসহ অন্যান্য পেশার লোক। বলা যেতে পারে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে।
ছাত্রদের বয়সসীমা নির্ধারণ, প্রকৃত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি গঠন, নিয়মিত কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি বদল হওয়াসহ শৃঙ্খলার মধ্যে ছাত্র রাজনীতিকে আনতে হবে। এখন যার দাপট বেশি সেই দাবি করেন তিনি সংগঠনের হর্তাকর্তা। নেতারা যদি সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটিতে আসতেন- তাহলে তিনি ভাবতেন, নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, এবছর খারাপ করলে পরের বছর কেউ ভোট দিবে না। তাহলে ছাত্র রাজনীতি ভারসাম্যের মধ্যে আসত। যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা রয়েছে- আমাদেরকে সেদিকে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। ছাত্ররাই আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করবে এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দিবে- কাজেই একথা চিন্তা করে ছাত্র রাজনীতি করার জায়গা আমাদেরকেই করে দিতে হবে। দলাদলির বিষয় শুধু শিক্ষক এবং ছাত্রদের মাঝে নয়, পেশাজীবী সংগঠন এমনকি সংসদেও আছে। শুধু ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা ফেরেস্তার মত হবেন- বাকিরা যার যার মত থাকবেন এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী আমরা অনেক কিছু দিতে পারছি না। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
ছাত্র রাজনীতি অস্থিতিশীল হওয়ার পিছনে শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার কথা সামনে আনতে হয়। শিক্ষার্থীদের বড় সমস্যা থাকার জায়গা নিয়ে দলাদলি-মারামারিসহ নানা বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত থাকার জায়গা নেই। ছাত্রদের ক্যান্টিনে খাবারের নিন্মমান, লাইব্রেরিতে বইয়ের অপর্যাপ্ততা, ইন্টারনেট ব্যবহারসহ বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। সুস্থ ছাত্র রাজনীতির জন্য এসব সমস্যার সমাধান এবং শিক্ষার্থীদেরকে সামাজিক কর্মকাণ্ড যেমন খেলাধুলা, চিত্তবিনোদন,সাংস্কৃতিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট দরকার। সারা বছরব্যাপী শিক্ষার্থীদের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য কর্মকাণ্ডে জড়িত রাখতে হবে। সব শিক্ষার্থী আবাসিক হলে আসন পাচ্ছে; থাকার জায়গার জন্য কারো লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি বা কোনো নেতার পিছনে ছুটতে হচ্ছে না- এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে ছাত্র রাজনীতিতে অনাকাঙ্খিত ঘটনা হ্রাস পাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০০ সালে একুশে হল হওয়ার পরবর্তী ১০ বছরে কোনো হল নির্মাণ হয়নি। অথচ ছাত্রসংখ্যা বেড়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি যেখানে আবাসনের কোনো ব্যবস্থাই নেই। এমন শূন্য আবাসন ব্যবস্থার বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীতে কম আছে।
শিক্ষাখাতে আমাদের জিডিপির বরাদ্দ সর্বনিন্ম। আফ্রিকার অনেক দেশ এমনকি নেপাল-ভুটানের চেয়েও বরাদ্দ অনেক কম। ইউনেস্কোর ন্যূনতম স্টান্ডার্ড অনুযায়ী শিক্ষাখাতে আমাদের বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। প্রতিবছর সামান্য করে বাড়ালেও শিক্ষাখাতের বড় চাহিদাগুলো পূরণ হত। বরাদ্দ বাড়াতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও আবাসিক সমস্যার সমাধান হত। আমি মনে করি, আবাসিক সমস্যার সমাধান হলে ছাত্র রাজনীতি সহনীয় পর্যায়ে আসবে এবং বিশৃঙ্খল ঘটনাবলি অনেকাংশে লাঘব হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দলের সহ-অবস্থান নেই একথাটি সঠিক নয়। ক্ষমতার পালাবদলে ছাত্ররা অন্য দলের হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর থেকে আদর্শভিত্তিক আলোচনা এবং দেশ ও বিশ্বের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে যথাযথ স্বপ্ন শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেই। নেহাত আবাসিক হলে থাকার বিষয়টি ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রে থাকে। ধরে নেওয়া হয় হলে থাকতে হলে সরকারি দলের সাথে থাকতে হবে। ২০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি দেখেছি, যে ছাত্র দুদিন আগে ছাত্রলীগে ছিল, পরে ছাত্রদলে যায়, ফের ছাত্রলীগ থেকে ছাত্রদলে যায়। এক ধরনের পরম্পরা দেখা যায়। তাদের সামনে-পিছনে কোনো আদর্শ নেই। জাতীয় রাজনীতিতেও তেমন কোনো আদর্শ নেই- যা শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করবে। কাজেই অভ্যন্তরীণ কোনো আদর্শ থাকলেও যেহেতু আবাসিক হলে অবস্থান করতে হবে, সেকারণে ক্ষমতাসীন দলের সাথে থাকাটাই শ্রেয়। এক্ষেত্রে কেউ সুবিধা বঞ্চিত হয়ে আবাসিক হল থেকে মেসে অবস্থান করতে চায় না।
কেবল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা সরকারের পক্ষে ছাত্র রাজনীতিতে দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বিরোধী দলকেও ভূমিকা পালন করতে হবে। যখন ছাত্রলীগ করার বয়সসীমা ২৯, অবিবাহিতসহ নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তখন সব রাজনৈতিক দল একই সিদ্ধান্ত নিলে ছাত্র রাজনীতির চেহারা পাল্টে যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকার চাইলেই পারবে না, এক্ষেত্রে সর্বস্তর থেকে সমর্থন থাকতে হবে।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/এমএস