নতুন বছরে নতুন প্রত্যাশা
কালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরও একটি বছর। শুরু হল ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। নানা দিক থেকেই ২০১৫ সালটি ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। ২০১৫ সালের সূচনাটি মোটেও সুখকর হয়নি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বাধ্যবাধকতায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয় তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিএনপি চেয়ারপারসন ৬ জানুয়ারি ‘আন্দোলন’ শুরু করেন। অবরোধ ও হরতাল, পেট্রোল বোমায় এক বিভীষিকাময় পরস্থিতি সৃষ্টি হয়। অবেশেষে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট হিংসাত্মক কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসে। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচন বর্জন করে।
২০১৫ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ৬৮ বছরের পুরনো ছিটমহল সমস্যার সমাধান। এরফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনমনে দারুণ আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এ বছর বেশকিছু পুরস্কারও পান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ’ এবং ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তা ছাড়া খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যে এফএও পুরস্কার প্রদান করা হয় প্রধানমন্ত্রীকে।
দুইজন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ায় জাতি অনেকটাই কলঙ্কমুক্ত হয়। গত বছর দুই জন বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডসহ বেশকিছু জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে শিশু রাজন এবং রাকিব হত্যাকাণ্ডের রায় প্রদান ও ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তিও ছিল স্বস্তির বিষয়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সাতখুন মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেনকে ভারতে থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা, উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর, নিখোঁজ বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমদের প্রকাশ্যে আসাও ছিল ব্যাপকভাবে আলোচিত।
সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতিও ছিল আলোচনার বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই সূচকের শীর্ষ অবস্থানে বাংলাদেশ। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১.১৩ শতাংশ, নারীর প্রজননপ্রবণতা ২, শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ৩৪, প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ, ঝরে পড়ার হার ৩০ শতাংশ এবং হ্রাসমান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রীর অনুপাত জনমিতির অনুরূপ, উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরতদের সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষাধিক এবং জন্মকালীন গড় আয়ু প্রায় ৭২। নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ প্রায় ৪০ শতাংশ। এসবই আশার দিক।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ আর জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির আরো বেশি অর্থবহ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম পর্যায়ে (এইচডিআই ভ্যালু ০.৫৭০) উঠে এসেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মূল কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার আয়। খাদ্য উৎপাদনেও সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনও। তথ্য-প্রযুক্তিতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। পে-স্কেল বাস্তবায়নও আর্থিক সক্ষমতার পরিচয় বহন করে। বছরের একে বারে শেষের দিকে ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বড় ধরনের কোনো অঘটন ছাড়াই।
সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও রাজনৈতিক অনৈক্য, সংঘাত, সহিংসতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস এক প্রধান সমস্যা হিসেবেই এখানে রয়ে গেছে। রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির সহাবস্থান সম্ভব নয় বলেই এই সংকট দূর হচ্ছে না-এমনটিই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এছাড়া জঙ্গিবাদও মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে বার বার। ঘটছে ব্লগার হত্যা, হুমকি আসছে প্রগতিশীল চিন্তার মানুষদের ওপর। এসব সমস্যা উজিয়ে একটি আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছাতেই হবে। তবেই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। ২০১৬ সাল সবার জন্য মঙ্গলময় হোক এটাই প্রত্যাশা।
এইচআর/পিআর