ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সম্প্রীতির খোঁজে সম্প্রীতি বাংলাদেশের আর একটি প্রয়াস

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল | প্রকাশিত: ০২:৪৭ পিএম, ২৬ নভেম্বর ২০২১

নভেম্বরের ২৬, এই তারিখটি আমার পরিবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দিনটি আমার সহধর্মিণী অধ্যাপক নুজহাত চৌধুরীর জন্মদিন। কিন্তু বৈশ্বিক আর বিশেষ করে আমাদের এই অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে এই দিনটির অন্য রকমের একটা গুরুত্ব আছে, যদিও সেটা নেগেটিভ সেন্সে। ২০০৮ সালের এই দিনটিতেই পাকিস্তান সমর্থিত একদল সন্ত্রাসীর তাণ্ডবে প্রকম্পিত হয়েছিল মুম্বাইয়ের ঐতিহ্যবাহী তাজ হোটেল আর আশপাশের এলাকা। ভারতীয়সহ ২২টি দেশের কয়েকশ মানুষের রক্তে লাল হয়েছিল ভারতের বাণিজ্যিক এই রাজধানীটি। আজ মুম্বাই হামলার ১৩ বছর পূর্তিতে ভারত তথা গোটা বিশ্ব শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে সেদিনের নিরপরাধ ভিক্টিমদের।

বাংলাদেশেও একাধিক সংগঠন এই দিনটির স্মরণে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে যার মধ্যে আছে আলোচনা অনুষ্ঠান আর স্থির চিত্র প্রদর্শনী। এর কারণ একটাই। মুম্বাই হামলাটি নিছক কোন সন্ত্রাসী হামলা ছিল না। এর পেছনে ছিল রাষ্ট্রীয় মদদ, একটি রাষ্ট্রের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতা। বলাইবাহুল্য রাষ্ট্রটির নাম পাকিস্তান এবং এই ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতায় তাদের সংশ্লিষ্টতা জন্মগত এবং মজ্জাগত।

১৯৪৭-এর দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক একটি অদ্ভুতুরে কনসেপ্টের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত লাখো মানুষের রক্তস্নাত জন্ম পাকিস্তানের। জন্মের অব্যবহিত পরেই তারা অপারেশন গুলমার্গ নামে আগ্রাসন চালায় প্রতিবেশী স্বাধীন রাষ্ট্র কাশ্মীরে। মাত্র পাঁচ দিনে সেখানে গণহত্যার শিকার হন প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ। কাশ্মীরের শাসক বাধ্য হয়ে নিজের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে স্বেচ্ছায় যোগ দেন ভারতের সাথে। এতে কাশ্মীর রক্ষা পেলেও, রক্ষা পায়নি এই উপমহাদেশ। এই উপমহাদেশে রাষ্ট্রীয় মদদে গণহত্যা আর সন্ত্রাসের প্রথম উদাহরন অপারেশন গুলমার্গ এবং সেই থেকে অব্যাহত আছে সেই ধারাটি। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে একাত্তরের ২৫ মার্চ শুরু হয়ে ডিসেম্বরের ১৬ পর্যন্ত আজকের বাংলাদেশে যে নজিরবিহীন মানবতাবিরোধী অপরাধ, কিংবা মুম্বাই হামলা অথবা ঢাকার হলি আর্টিজান আর এসবের ফাঁকে-ফাঁকে যে অসংখ্য-অজস্র সন্ত্রাসী হামলায় সন্ত্রস্ত হয়েছে এই উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশ আর ভারত, এর প্রতিটির পিছনে পাকিস্তান সরকার আর তাদের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ফুট প্রিন্ট স্পষ্ট।

একাত্তরে বাংলাদেশের জন্ম প্রকৃতপক্ষে ছিল দ্বি-জাতি তত্ত্বের পরাজয়। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র যে কতটা অসাঢ় আর অচল তা প্রমাণ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ আবির্ভুত হয়েছিল একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে। আর এই রাষ্ট্রের মূল এসেন্স ছিল বাঙালি সংস্কৃতি আর বাঙালিয়ানা, অন্য কথায় ধর্মনিরপেক্ষতা আর অসাম্প্রদায়িকতা। বাহাত্তরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে যে অনন্য সাধারণ একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন সেটিরও মূল স্তম্ভগুলোর অন্যতম ছিল এই দুটি বিষয়। সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পাকিস্তান ও আইএসআই সমর্থিত বাংলাদেশি শাসকগোষ্ঠি সংবিধানকে কেটে-ছেটে শুধু ক্ষত-বিক্ষতই করেনি, সবার আগে তাদের রোষানলে পরে সংবিধান থেকে বাদ পরেছে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের রক্ষাকবচ, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ আর বেগম জিয়ার পাকিস্তান সমর্থিত সরকারগুলো শুধু আমাদের সংবিধান আর রাজনীতিকেই ক্রমাগত ধর্ষন করেনি, তাদের অশুভ থাবা থেকে রক্ষা পায়নি আমাদের একের পর এক প্রজন্ম। বিভ্রান্ত এই প্রজন্মের কাছে তাই খেলা আগে, দেশ পরে। মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আধুনা পোশাকে যে বঙ্গললনা পাকিস্তানের পতাকা হাতে নেচে-গেয়ে দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের বিজয় উদযাপন করলো, সে একবার ভেবেও দেখলোনা যে একাত্তরে সে যদি এই সময়টায় সে এই বয়সী হতো, তাহলে পরিসংখ্যানগতভাবে পাকিস্তানী সেনাসদস্য কিংবা তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে তার ধর্ষিতা হওয়ার আশংকাটা ছিল কমপক্ষে ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ।

এই পচে যাওয়া প্রজন্মকে শোধরানোটা যে কতটা জরুরি তা বোধ করি ব্যাখ্যার প্রয়োজন রাখে না। আজ বাংলাদেশের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের গ্র্যাজুয়েশনে উল্লসিত আমরা যখন ২০৪১-এর উন্নত বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছি, তখন মিরপুরের গ্যালারি আর ঢাকার রাজপথে ‘আমি রাজাকার’ ব্যানার আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই জায়গাটা মেরামত করা না গেলে ঐ উন্নয়ন হবে ঠুনকো আর ক্ষণস্থায়ী। পূজা করার অপরাধে যে দেশে পূজারীর জীবন যায়, সেদেশে দুঃস্বপ্নহীন প্রতিটি ঘুম স্বপ্নের মত!

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশটাকে তার স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছে দেয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে অক্লেশ প্রয়াস তার সহযাত্রী হতেই ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশের’ পথ চলার শুরু আজ থেকে চারটি বছর আগে। শুরু থেকেই আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে আর সমমনা সতীর্থদের সঙ্গী করে আমাদের আশার বাতিঘর, আমাদের প্রিয় বড় আপার দেখানো পথে হেঁটে যেতে। এই ক’দিন আগেও যখন সাম্প্রদায়িক চক্রান্তে কলংকিত হয়েছিল এদেশের শারদীয় দুর্গোৎসব, তখন আমরা পথে নেমেছিলাম। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশের’ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৫ অক্টোবরের স্নিগ্ণ অপরাহ্নে যোগ দিয়েছিলেন ৯৩টি সমমনা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আর সাথে দশ হাজারেরও বেশি মানুষ, যাদের প্রত্যেকের ধ্যানে ও জ্ঞ্যানে বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ। সেদিনের সেই সমাবেশের আহ্বানের অনুরণন আমরা দেখেছি বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সেই সম্প্রীতি সমাবেশের ধারাবাহিকতায় সাড়া দেশে নানা ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয়েছে আরো অসংখ্য সম্প্রীতি সমাবেশ। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার টকশোতে কিংবা পত্রিকার কলামে আর অনলাইনের মতামতে কিংবা ব্যাক্তিগত ব্লগে সর্বত্রই বয়ে গেছে সম্প্রীতির ফল্গুধারা।

সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের এবারের উদ্যোগ সমমনা এই সবাইকে নিয়ে এক সাথে এগিয়ে চলা। আমাদের লক্ষ্য একটি ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার তাগিদে স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষগুলোকে একটা জায়গায় জড়ো করে, এদেশে এবং আমাদের এই অঞ্চলে আগামী দিনে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার চেতনায় বিশ্বাসীদের কর্তৃত্বের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করায় সহযাত্রী হওয়া। সেই প্রয়াসে সম্প্রীতি বাংলাদেশ সমমনা শতাধিক সংগঠনের সাথে এক সাথে বসে, এক হয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে যাচ্ছে। আর সংগত কারণেই আমরা বেছে নিয়েছি নভেম্বরের ২৬ কে, কারণ আমরা মনে করেছি সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির চলমান চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের যে পাল্টা জবাব, একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আমাদের যে দৃঢ় প্রত্যয় তা চিৎকার করে জানিয়ে দেয়ার জন্য আজকের দিনটিই উপযুক্ত। মুহুর্মুহু বোমা হামলার যে বিকট শব্দে আজ থেকে ১৩ বছর আগে প্রকম্পিত হয়েছিল মুম্বাই, আমরা বিশ্বাস করি একটি গুলিও না ছুড়ে আর একটি বোমাও না ফাটিয়ে, তার চেয়েও যে উচ্চকিত পাল্টা জবাব দেয়া সম্ভব সেটাই আজ আরো একবার প্রমাণিত হবে সম্প্রীতি বাংলাদেশের নেতৃত্বে শতাধিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকের অপরাহ্নের উপস্থিতিতে।

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন