স্যার আমারে শুয়াইয়া দিয়া…
ডান পায়ে হাঁটুর নিচে হঠাৎ ছোট্ট একটা গেটিস (স্ফীত হওয়া/ফুলে ওঠা) দেখা দিল। কিছুদিন আগে গ্রামে যাওয়ার পর ভ্যানে চড়ে বাজারে যাচ্ছিলাম। এসময় বিপরীত দিক থেকে আসা এক মোটরসাইকেল আরোহী সড়কের মোড় ঘোরার সময় আমার ডান পায়ে নেকনজর নিক্ষেপ করল। ঘটনার পর বরফ ঘষাঘষি করে আর ব্যথানাশক বড়ি খেয়ে ভেবেছিলাম, নেকনজরের সেলামি পরিশোধ করা হয়েছে; কিন্তু তা যে হয়নি, তার প্রমাণ এই গেটিস।
গেটিস দেখে লবণ বেগম ভয় পেয়ে গেল। বলল,
: শিগগির ডাক্তারের কাছে যাও।
আমি বললাম,
: ধুরউ! এইটা অতি মামুলি বিষয়। ভয়ের কিছু নাই।
: ভয়ের কিছু নাই মানে? তুমি কী মরবার চাও?
: এই ধরনের রোগে কেউ মরে না। তবে ল্যাংড়া হওয়ার একটা চান্স আছে।
: ল্যাংড়া হইলে খুব ভালো হয়, না?
: অনেক ল্যাংড়া ফকিরের ঢাকা শহরে একাধিক বাড়ি আছে।
: তুমিও কী ভিক্ষা করবা নাকি?
: অসুবিধা কী? বিনা পুঁজি ও বিনা পরিশ্রমে বাড়ির মালিক হইতে পারলে জীবন ফুরফুরা। সবচেয়ে বড় কথা, ভিক্ষা হচ্ছে আমাদের জাতীয় পেশা। দেখ না, বিদেশিরা ভিক্ষা দিলে আমরা খুশি হয়ে সংবাদ সম্মেলন করি আর ভিক্ষা না দিলে বেজার হয়ে বলি, বেটারা পাঁজি হয়ে গেছে। আগের মতো সাহায্য দেয় না।
: আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়া ডাক্তারের কাছে যাও। আজই যাবা।
: আচ্ছা।
বাসার কাছেই জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান। তবে আম-জনতার কাছে এটি পরিচিত পঙ্গু হাসপাতাল নামে। হাসপাতালে পৌঁছে টিকিট কাউন্টার তালাস করছি। এসময় এক লোক জিজ্ঞেস করল,
: ছার! রোগী আছে নাকি?
: আমিই রোগী।
লোকটা সন্দেহের চোখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করতে লাগল। এ অবস্থা দেখে বললাম,
: হাঁটুভাঙ্গা ‘দ হয়ে না এলে এই হাসপাতালে কি রোগী হিসেবে কাউন্ট করা হয় না?
: না, তা না।
: আপনি কী করেন?
: আমি একজন সাহায্যকারী।
: বুঝলাম না।
: সাহায্যকারী মানে হইল দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যেসব রোগী এইখানে আসে, প্রয়োজন অনুসারে তাদের দিকে আমি সাহায্যের হাত প্রসারিত করি। এই যেমন ধরেন, এই হাসপাতালের চাইতে বাইরের ক্লিনিকে আরও উন্নত, আরও আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে; এটা রোগীর সাথে আসা লোকজনদের বলি। এরপর যারা রাজি হয়, তাদেরকে ক্লিনিকে পুনর্বাসন করি।
: তার মানে আপনে একজন দালাল।
: এইভাবে বলবেন না ছার। আমি হইলাম জনগণের খেদমতগার।
: ক্লিনিকে কী এই হাসপাতালের চেয়েও বড় ডাক্তাররা রোগী দেখেন?
: ডাক্তার একজনই। সকালবেলা হাসপাতালে বসে যারা চা-পান খায়, বিকেলবেলা তারাই ক্লিনিকে যাইয়া কল্কি সাজায়।
: একই ডাক্তার হলে হাসপাতালের চেয়ে ক্লিনিকে উন্নত চিকিৎসা কীভাবে হয়?
: এখানকার পরিবেশ তো নিজের চোখেই দেখতেছেন। এই পরিবেশে কি মন দিয়া চিকিৎসা করা যায়? মনোযোগ সহকারে চিকিৎসাসেবা দিতে হলে নিরিবিলি পরিবেশ দরকার।
হাসপাতালে যে মনোযোগ সহকারে চিকিৎসা করা যায় না, এর প্রমাণ একটু পরেই পেলাম। ১০ টাকার টিকিট কেটে দায়িত্ব পালনরত ডাক্তার মহোদয়ের রুমে প্রবেশ করলাম। ডাক্তার সাহেব চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে দু’হাত মাথার ওপর তুলে আড়মোড়া ভাঙলেন; হাই তুললেন। তারপর মুখে কোনো কথা না বলে মাছের মতো পানিতে ঢুশ মারার ভঙ্গিতে মাথা তুলে চোখের ইশারায় প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন। চেহারায় খুবই কাতর ও দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে বললাম,
: স্যার, পায়ে সমস্যা...
ডাক্তার সাহেব প্রেসক্রিপশন লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাতের ইশারায় পরের রোগীকে নিকটবর্তী হওয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রেসক্রিপশন নিয়ে পিয়নের শরণাপন্ন হলাম। বললাম,
: দেখেন তো ভাই, কী লিখছে; কিছুই বুঝতেছি না।
: আপনেরে নয় নম্বর রুমে যাইতে বলছে।
নয় নম্বর রুমে গিয়ে একজনের হাতে প্রেসক্রিপশন দিতেই তিনি বললেন,
: শুইয়া পড়েন।
: শুইয়া পড়ব মানে?
: আপনের পায়ে প্লাস্টার করতে হবে।
: এসবের মানে কী? আমার পা ভাঙেও নাই, মচকায়ও নাই। প্লাস্টার করতে হবে কীজন্য?
: ডাক্তার লেখছে।
: প্রেসক্রিপশনটা দেন তো; ডাকতরসাবরে জিজ্ঞাসা কইরা আসি, মনের ভুলে লিখল কিনা?
পুনরায় ডাক্তার মহোদয়ের রুমে যাওয়ার পর পিয়ন বলল,
: স্যার তো বাইরে চইলা গেছে।
: আমারে শুয়াইয়া দিয়া আপনের স্যার বাইরে চলে গেলেন; এইটা কী রকম কারবার হইল? কখন ফিরবেন তিনি?
: স্যারের ফিরতে দেরি হবে।
: কত দেরি?
: (চুপ)।
: বলেন না, কতক্ষণ ওয়েট করতে হবে?
: (নিশ্চুপ)
: আরে ভাই, বলেন না; আমরা আমরাই তো!
পিয়ন তবুও কাচুমাচু করে। এসময় করিডোর দিয়ে ফ্লাস্ক হাতে একজন চা বিক্রেতা যাচ্ছিল। চা বিক্রেতাকে ডেকে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। চায়ের কাপ ঠোঁটে ছোঁয়ানোর পর পিয়নের জবান ছুটল। সে জানাল, বাইরের একটা ক্লিনিক থে্ইকা জরুরি ‘কল' আসছে। স্যার গেছে সেইখানে। এইজন্য প্রথমেই আপনেরে বইলা দিছি, স্যারের ফিরতে দেরি হবে...
লেখক : সাংবাদিক।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জিকেএস