ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

এক বছরে দু’জন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ০২:৫৭ এএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫

এক বছরে দু’জন। পাকিস্তান দূতাবাসের দুই কর্মকর্তা জড়িত হয়েছেন বাংলাদেশ বিরোধী গোয়েন্দা তৎপরতায়। এ বছর জানুয়ারিতে জানা গেল পাকিস্তান হাইকমিশনের সহকারী ভিসা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাযহার খান দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সমন্বয় ও অর্থায়ন করছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসআই-এর অন্যতম সংগঠকও ছিলেন এই পাকিস্তানি। পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীর, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম এবং জামায়াত-শিবিরকে। মাযহার খান নামে ওই কূটনীতিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশবিরোধী ভয়ঙ্কর সব তৎপরতার তথ্য-প্রমাণ পেয়ে সরকার পাকিস্তানকে জানায় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে চলে যেতে হয়। এবার ২৩ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করে নেয় পাকিস্তান সরকার।

এক বছরে দুই দুই জন কর্মকর্তার এমন পরিণতি নজিরবিহীন এক ঘটনা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এসব কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আছে। যত ধরনের অপরাধ আছে, সব পারে পাকিস্তানিরা, তা সে কূটনীতিক হোক আর যেই হোক। দীর্ঘদিন ধরে এই কূটনীতিকরা ভারতীয় জাল রূপির বড় ব্যবসার সাথে জড়িত। মাঝে মাঝেই এরা ধরা পড়ে। এর একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে, আর তা হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজার ধ্বংস করে দেয়া। কূটনৈতিক সুবিধা নিয়ে এই দূতাবাসের কর্মকর্তারা জড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর সব কাজে।

একটি দেশের কূটনৈতিক মান, সেদেশের সন্মান ও মর্যাদা ভাবনা কতটা নিম্নমানের হলে এক বছরে দুই দুইটি এমন ঘটনা ঘটতে পারে? ভিসা কর্মকর্তা মাযহার খানের পর ফারিনা আরশাদ। দূতাবাসটির ‘সেকেন্ড সেক্রেটারি’ (রাজনৈতিক) পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা বাংলাদেশে বসে এই দেশের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠলো। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিনি যেমন জঙ্গি নেটওয়ার্ক মনিটর করছেন, তেমনি জাল মুদ্রার ব্যবসাতেও নেপথ্যে থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানিদের নাক গলানো তাদের এক বিশেষ রোগ। এর পূর্বে শোনা গেল ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে ৫০ মিলিয়ন রুপি দেওয়ার কথা দিয়েছিল পাকিস্তান ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)। আর তা স্বীকার করেছিলেন সাবেক এই সংস্থার সাবেক চিফ আসাদ দুররানী। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে এ বিষয়ে এক শুনানিতে তিনি এ বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন।

পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দিকে নজর রাখা দরকার। কিন্তু আরো নজরদারি দরকার পাকিস্তান থেকে যারা এখানে ব্যবসার নামে আসে বা পাকিস্তানের সাথে এদেশের যারা ব্যবসা করে। বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণসহ বাংলাদেশে ব্যবসার আড়ালে বেশ কিছু পাকিস্তানি নাগরিক সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি তৎপরতায় সহায়তা করছে বলে সন্দেহ করছে গোয়েন্দারা। বিশেষ করে কাপড়ের ব্যবসায়ী পরিচয়ে বাংলাদেশে আসছে পাকিস্তানি জঙ্গিরা। ব্যবসার আড়ালেই চলছে এ দেশের উগ্রবাদী অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ।

আবাক করা তথ্য এই যে, বর্তমানে বাংলাদেশে বৈধভাবে বসবাসকারী পাকিস্তানি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। অবৈধভাবে বসবাস করছে আরো অনেকে। ব্যবসা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন অজুহাতেও বাংলাদেশে আসছে অনেকে। এ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান ও তথ্য নেই কোনো দপ্তরে। অনেক পাকিস্তানি নাগরিক বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশনের অবতরণপত্রে বাংলাদেশে অবস্থানের যে ঠিকানা দিচ্ছে, পরে সেখানে খোঁজ নিয়ে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। আর এতেই ধারণা করা যায় এসব পাকিস্তানির একাংশ দেশে জঙ্গিবাদসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড জড়িয়ে আছে।

এরা আসলে ব্যবসায়ী কি না, তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাই, হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ অনেকে একসময় আফগানিস্তান থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে তৎপর হয়েছিলেন। বর্তমানে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা ইজাজ হোসেন পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। পাকিস্তান প্রকৃত অর্থে কোনো দেশ নয়, এক দর্শনের নাম, যে দর্শন বিশ্বের জন্য ভয়ঙ্কর। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল চরিত্র হলো, নিজেরা ফ্যাসিবাদি, মৌলবাদি, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গি হয়েই ক্ষান্ত থাকবে না, এই সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দিবে আশেপাশে, দূরে বহু দূরে।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক একটি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ইন্টেল সেন্টারের এক জরিপ প্রকাশিত হয় এ বছর আগস্টে। এতে বলা হয় বিশ্বের ১০ বিপদজনক দেশের মধ্যে পাকিস্তান অন্যতম। তাহলে আমরা ধারণা করতে পারি সহজেই সেই বিপদজনক রাষ্ট্রের দূতাবাস, অন্তত: বাংলাদেশে, যে দেশে তার জঙ্গি দোসরদের বিচার হচ্ছে, কতটা বিপদজনক হতে পারে! সেদেশের নাগরিক কতটা বিপদজনক আমাদের জন্য?

লাভ-ক্ষতির অংকের হিসেব নয়, সাধারণ কূটনৈতিক ভদ্রতার খাতিরে নয়, বাংলাদেশকে ভাবতে হবে তার অস্তিত্ব নিয়ে। পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক মানে প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্রের সাথে লড়াই করে চলা। পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে অন্য সব দেশের থেকে পাকিস্তানেই সন্ত্রাস সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। পাকিস্তান কি চাইবে বা কি করবে, সেটা না ভেবে আমাদের ভাবতে হবে `জিরো টলারেন্স ফর মিলিটান্সি` নীতি। এই নীতিতে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা পাকিস্তান।  

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক একটা দুষ্টবৃত্তে ঘুরছে এবং তা একই বৃত্তে চিরকাল ঘুরবে। এই `টটোলজি` বা পুনরুক্তি-ফাঁদ থেকে বেরোনোর তাগিদ থাকলে থাকতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান ভাববেনা। তারা  ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায় না, উল্টো অস্বীকার করে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সময় মূলত পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। এসব ছিল ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া, পাকিস্তানের কাছে ফেরত দেয়া ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা সদস্যের যুদ্ধাপরাধের বিচার করা, পাকিস্তানে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারীদের ফিরিয়ে নেয়া, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা সম্পদ ফিরিয়ে নেয়া ও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের সম্পর্ক বাড়ানো। তবে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে যেচে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আবার সামনে আসে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, সে বিষয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হচ্ছে ঢাকাকে। পাকিস্তান সরকার সরাসরি এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। বাস্তবতার নিরিখে হয়তো এখনই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে না বাংলাদেশ, কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনোভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা দরকার।  

পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোতে সেনাবাহিনী এখনও সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। এক দিকে তাদের হাতে তালিবানি দৈত্য, অন্যদিকে বিভিন্ন প্রদেশে নিজের দেশের নাগরিকদের মুখোমুখি হয়ে সেনাকর্তারা নিজেদের বহুচর্চিত গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা হারিয়েছেন। তবুও নেওয়াজ শরীফ যুগে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছে বলা যাচ্ছে না। ভয়াবহ সন্ত্রাসী হানায় দীর্ণ পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আর্থিক মন্দায় দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। তবুও প্রতিবেশীদের সাথে সরলরেখায় চলে না এই দেশ। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিচারে চাই সে দেশের রাষ্ট্র-কাঠামোর বিশ্লেষণ। মনে রাখা দরকার সে দেশের নীতি নির্ধারণে সেনাবাহিনী ও মোল্লাতন্ত্রের বিশেষ অবস্থানের কারণে কোনোদিনই স্বাভাবিক হবে না আমাদের সাথে ওদের সম্পর্ক।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন