ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ‘পরিকল্পিত’

বিভুরঞ্জন সরকার | প্রকাশিত: ১০:০৫ এএম, ২৬ অক্টোবর ২০২১

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে এবার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে উদযাপন করতে পারেনি। অষ্টমীর দিন কুমিল্লার একটি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে হনুমানের কোলে পবিত্র কোরআন পাওয়ার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হওয়ার পর কুমিল্লার বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলা চালানো হয়। কুমিল্লা সদর থানার ওসি ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে সাদাপোশাকে এসে হনুমানের কোল থেকে কোরান উদ্ধার করেন এবং তার সামনেই একজন ফেসবুকে উস্কানিমূলক প্রচারণা চালাতে থাকে।

ওসি সাহেব একটু সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। সম্ভবত তিনি নিজেও একটু আবেগ তাড়িত হয়েছিলেন, কোরআন শরীফের পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে। যেহেতু হিন্দুদের পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়া গেছে সেহেতু কোরআনের পবিত্রতা বিনষ্টের কাজটি কোনো হিন্দুই করেছে, এটা হয়তো ওসি সাহেবের চিন্তাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। তাই হিন্দুদের ওপর আক্রমণের উস্কানি দিয়ে ফেসবুক লাইভকে তিনি বাধা দেননি। বাংলাদেশে হিন্দুদের অনেক বাড় বেড়েছে – এমন মনে করা মানুষের দলে ওসি সাহেবের অবস্থান বলে ধরে নেওয়া হলে ভুল হবে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন দায়িত্ববান সদস্য হিসেবে তার প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল মণ্ডপে কোরআন রাখার ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে যাতে কেউ পানি ঘোলা করার সুযোগ না পায় তার ব্যবস্থা করা। কোনো হিন্দুর পক্ষে যে এই কাজ করা সম্ভব নয়, সেটা বোঝা দরকার ছিল ওসি সাহেবের। কিন্তু আমাদের দেশের আমজনতার মধ্যে যেমন যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি, তেমনি যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকেন, তাদের সবাই সব সময় যুক্তিবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হন – সেটাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। এখন তো জানা যাচ্ছে, কোরআন অবমাননার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির নাম ইকবাল হোসেন, তিনি হিন্দু নন। মণ্ডপে কোরআন রাখলেন একজন মুসলমান, পুলিশকে ফোন করলেন একজন মুসলমান এবং ফেসবুক লাইভেও একজন মুসলমান। কিন্তু এর জন্য কত বড় খেসারত দিতে হলো হিন্দুদের।

কুমিল্লার ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের গাফেলতির বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। কুমিল্লার পর ঘটনা দেশের আরও বেশ কয়েকটি জেলায় বিস্তৃত হয়েছে। কয়েকদিন ধরে প্রায় ২২টি জেলায় বিভিন্ন মন্দির-মণ্ডপে হামলা, প্রতিমা বা মূর্তি ভাঙচুর, হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগের যে ঘটনা ঘটলো তাকে ‘বিচ্ছিন্ন' ঘটনা বলে উপেক্ষার কোনো সুযোগ নেই। এগুলো আসলে এক ধরনের পরিকল্পিত ঘটনা। এগুলোর আসল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ থেকে হিন্দুসহ অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন। বহু বছর ধরেই এই প্রক্রিয়া চলছে এবং হিন্দুদের নীরব দেশ ত্যাগও অব্যাহত আছে। জনসংখ্যার মাত্র ৮/১০ শতাংশ এখন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান। ৯০ শতাংশ মুসলমান। কাজেই বাংলাদেশকে এখন মুসলমানের দেশ হিসেবেই দাবি করা হয়।

কেউ কেউ নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই হয়তো এখনও বলেন ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ'। বাস্তবে এটা এখন কথার কথা। হ্যাঁ, এক সময় বাংলাদেশ অবশ্যই সম্প্রীতির দেশ ছিল। বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের মানুষ পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবেই বসবাস করে এনেছেন। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ধর্মীয় উৎসবের আনন্দও ভাগাভাগি করেছেন। তবে গত প্রায় তিন দশক ধরে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলেছে। এখন ‘সম্প্রীতি’ বিষয়টি নিয়ে আদিখ্যেতা করার অবস্থা নেই।

ধর্ম যার যার উৎসব সবার – এমন গাল ভরা বাক্য উচ্চারিত হয় এখনও কিন্তু বাস্তবে তা পালনে বিপুল সংখ্যক মানুষেরই অনীহা আছে। এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। এর পেছনে বড় ‘অবদান' রাজনীতির। রাজনীতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখার সচেতন চেষ্টা এক সময় আমাদের জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ছিল। সামরিক শাসকরা তাদের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করার জন্য ধর্ম নিয়ে সস্তা খেলা খেলে এখন মানুষের সৎ বিশ্বাসের ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছেন। সামরিক শাসন আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করার সুযোগ করে দিয়েছে, দেশে অন্য ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের কথা না ভেবে সংবিধানে বিসমিল্লাহ্, রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করে একটি ধর্মের আধিপত্য বা প্রধান্যকে বৈধতা দিয়েছে। সম্প্রীতির পরিসর সংকুচিত করে দিয়ে শান্তিতে বসবাসের সবক দিলে তা তো বেসুরো হয়েই বাজবে।

ওয়াজ, নামাজ শেষে বয়ানে এবং অন্য ধর্মীয় আলোচনায় এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শান্তির বাণী উচ্চারিত হয় না। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম এর পক্ষে উদাহরণ তুলে ধরে বক্তব্য না দিয়ে অন্য ধর্মকে হেয় প্রমাণের জন্য, অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের মন বিদ্বিষ্ট করে তোলার জন্য নানা ধরনের বানোয়াট কথা প্রচার চলছে বাধাহীনভাবে। ফলে অন্যের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো, বিশ্বাস নষ্ট করা, সৌহার্দ্যবোধ লুপ্ত করা হয়ে দাঁড়িয়ে আজকাল ধর্ম প্রচারের লক্ষ্য। শুদ্ধ হওয়া, আলোকিত হওয়া, ঋদ্ধ হওয়ার বদলে আমরা সংকীর্ণ হচ্ছি, অন্ধকারের পথে হাঁটছি আর কিছু মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছি, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।

ভাঙ্গা প্রতিমা নতুন করে তৈরি করা যাবে, বিধ্বস্ত মন্দিরও মেরামত হবে, পুরনো ভস্মীভূত ঘরবাড়ি নতুন করে বানিয়ে দেওয়া যাবে কিন্তু তাতে কি সংখ্যালঘুদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে তা দূর করা যাবে? বলা হয়ে থাকে মন ভাঙা আর উপাসনালয় ভাঙা সমান অপরাধ। মন একবার ভাঙলে কোনো ‘অনুদানে'র বিনিময়ে তা আর জোড়া লাগে না।

আমাদের দেশে কোনো একটি অঘটন ঘটলেই শুরু হয় পাল্টাপাল্টি দোষারোপ। সরকার বলে আমরা নয়, ওরা সব অপকর্ম করে। ওরা বলে, আমরা নয়, সব দায় সরকারের। মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু যারা মানুষের জন্য রাজনীতি করেন তারা কি মানুষের বিপদে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন? আমাদের দেশে এখন রাজনীতি মানে কথা। রাজনীতি মানে মিডিয়ার সামনে মুখে ফেনা তোলা। মানুষের জীবন, সম্পদ বিপন্ন হলে কার কি এসে যায়! যার যায় বেদনা, হাহাকার শুধু তার।

এবার হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির হামলা যে কয়েকদিন ধরে চললো, তাতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কি? সব প্রায় সব জায়গায় গা ছাড়াভাবে এবং মোটামুটি দর্শকের ভূমিকায় ছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাদের নিষ্ক্রিয়তা দুর্বৃত্তদের সুযোগ করে দিয়েছে। সরকার এসব ঘটনার জন্য প্রথমেই দায় চাপায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর। তারপর আইওয়াশ হিসেবে শত শত মানুষের নামে মামলা দেওয়া হয়। গণহারে এসব মামলা হয় আসলে বিচার না করার উদ্দেশ্যে, ভুক্তভোগীদের রাগ প্রশমনের জন্য। এবার যেমন চট্টগ্রামে বিএনপির এমন কয়েকজনের নামে মামলা হয়েছে যারা কয়েক মাস ধরে জেলে আছেন।

বলা হচ্ছে এসব কিছুই সরকারের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত একটি মুখচেনা মহলের পরিকল্পনায়। যদি ধরে নেই এটাই সত্য, তাহলে প্রশ্ন আসে সরকারের যে এত এত সংস্থা, গোয়েন্দা দল তারা কি করে? তারা কেন আগে থেকে কোনো তথ্য পায় না? আগে থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয় না? অষ্টমীর দিন কুমিল্লা ঘটনার পর সারাদেশে যদি রেডএলার্ট জারি করা হতো তাহলে কি অন্যসব এলাকায় দুর্বৃত্তরা হামলা চালাতে পারতো। এবার পূজায় কোনো আশঙ্কা নেই – এই তথ্য পুলিশের উধ্র্বতন কর্তৃপক্ষ কোথা থেকে পেয়ে পূজা উদযাপন পরিষদকে আশ্বস্ত করেছিলেন?

২০১২ সালে রামুতে, ২০১৬ সালে নাসিরনগরে, ২০১৭ সালে গঙ্গাচড়ায়, ২০১৮ সালে নবীনগরে, ২০১৯ সালে বোরহানউদ্দিনে এবং ২০২১ সালে শাল্লার ঘটনার পর কেন এসবের উৎস খুঁজে বের করা হয়নি? কেন একটি ঘটনার পেছনের অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি? চোরকে চুরি করার সুযোগ দিয়ে গৃহস্থকে অযথা সান্ত্বনা দেওয়ার ভাওতাবাজির পরিণাম এবারের ঘটনাবলী।

এবার পীরগঞ্জ, নোয়াখালী, চৌমহনীতে উস্কানিদাতা হিসেবে আওয়ামী লীগপরিবারের সদস্যদের নাম এসেছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, অপরাধী ছাত্রলীগের কেউ হলেও ছাড় নেই। মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় বিশ্বাস রাখা হবে কোন ভরসায়? আগেও তো প্রত্যেক ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ কেউ কেউ বলেছেন ‘অপরাধী যেই হোক ছাড় পাবে না'। কি হয়েছে তার?

আমাদের দেশে যতদিন কথায় বড় হওয়ার বদলে কাজে বড় হওয়ার অবস্থা তৈরি না হবে ততদিন দুর্বল প্রতিপক্ষর ওপর সবল প্রতিপক্ষের মার দেওয়ার নীতি অব্যাহতই থাকবে বলে মনে হচ্ছে। ধর্মান্ধ দানবীয় শক্তির উত্থান ঘটছে দেশে দেশে। বাংলাদেশও তার থাবা থেকে মুক্ত নয়। যুক্তি বোধ কমে বাড়ছে গুজবের পেছনে ছোটার প্রবণতা। মানুষের মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতা কমছে। মানুষ তুচ্ছ কারণে উত্তেজিত হয়ে এমন সব কাজ করছে যা তার মানুষ পরিচয়কেও বিদ্রুপ করে। অথচ দানবের সঙ্গে সংগ্রামের জন্য যে প্রস্তুতির প্রয়োজন তার প্রতিজ্ঞা কোথায় আজ ঘরে ঘরে?

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন