ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বেকারদের সম্মানিত বলে সম্বোধন করবেন না

মোকাম্মেল হোসেন | প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ২২ অক্টোবর ২০২১

বদর ফরাজির মুখের রঙ পাল্টে গেল। কী আশ্চর্য কারবার! এরা তাকে বাংলাদেশে মহাকাশ গবেষণার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্ন করছে! সে পড়াশোনা করেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। আকাশের মেঘমালা ও নক্ষত্ররাজি নিয়ে তাকে ছড়া বা কবিতা লেখার কথা বলা যেতে পারে। মহাকাশ গবেষণার সে কী বোঝে? আজকের ইন্টারভিউ নিয়ে বদর ফরাজি খুবই আশাবাদী ছিল।

এখন মনে হচ্ছে ফালতু কাজে সে সারাদিন ধরে এখানে বসেছিল। এদেশে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে মামা-খালুর একটা ব্যাপার আছে। টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়েও নানা কথা শোনা যায়। এ সিস্টেমে তলে তলে নিয়োগের কাজ শেষ করে ফেলা হয়। ওপরে ওপরে পত্রিকায় বিশাল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নানা টেস্ট- ফেস্টের আয়োজন করা হয়। সবই লোক দেখানো ব্যাপার। আই ওয়াশ। ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে বের হওয়ার সময় বদর ফরাজির খু্বই ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করে,
: স্যার, সিলেকশন কি হয়ে গেছে?
সমস্যা হলো, এ ধরনের প্রশ্ন করা যাবে না। ইন্টারভিউ বোর্ডে নিয়োগ প্রত্যাশী যুবক আর পাত্রপক্ষের সামনে বিবাহ প্রত্যাশী যুবতীর মুখে কেউ কোনো প্রশ্ন আশা করে না। প্রশ্নের উত্তর শুনতে চায়। বদর ফরাজি শাহবাগ এসে বাস থেকে নেমে পড়ল। মেসে ফিরে খাওয়া-দাওয়া করে একটা জালালি ঘুম দিতে পারলে তোফা হতো। এখন মেসে যাওয়া যাবে না। তিন মাসের মেসভাড়া বাকি পড়েছে। আজ ভাড়া দে্ওয়ার ফাইনাল তারিখ। চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এক মাস সময় বাড়ানো কোনো ব্যাপার ছিল না। হারুর দোকান থেকে বাকিতে আধা কেজি মিষ্টি নিয়ে মেস মালিকের সামনে গিয়ে বলা যেত-

: চাচা, মিষ্টি খান। ইনশাআল্লাহ, চাকরি কনফার্ম। আগামী মাস থেকে ভাড়া নিয়ে আপনাকে আর টেনশন করতে হবে না...
মেসে ফিরতে হবে রাত ১০টার পরে। মেস মালিকের বাসা বাসাবো এলাকায়। সে নিশ্চয়ই রাত ১০টা পর্যন্ত বদর ফরাজির জন্য জিগাতলার মেসে বসে থাকবে না! বদর ফরাজি ফুটপাতের একটা দোকান থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকল। একটা গাছে হেলান দিয়ে বসার কিছুক্ষণ বাদেই বদর নিজেকে একটা পত্রিকা অফিসে আবিষ্কার করল। এখানে সে এসেছে একটা বিজ্ঞাপন দিতে। বিজ্ঞাপনের ভাষা হচ্ছে এরকম-

: সার্টিফিকেট আছে মূল্যায়ন নেই, কণ্ঠ আছে, আওয়াজ নেই, মন আছে, মনের মানুষ নেই, স্বপ্ন আছে, স্বপ্ন পূরণের নিশ্চয়তা নেই, সাধ আছে, সাধ্য নেই! আর কতকাল আমরা এসব ‘নেই এর মধ্যে থাকব? এবার জাগরণের পালা। এ লক্ষ্যে বেকার সোসাইটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নে্ওয়া হয়েছে। আগ্রহীরা নাম-ঠিকানা, বেকারত্বের বয়স ও এক কপি ছবিসহ নিচের ঠিকানায় চিঠি লিখুন...

কোনো চিঠি আছে কিনা, এ প্রশ্নের উত্তরে মেসের বুয়া এতদিন বদরকে করুণামিশ্রিত হাসি উপহার দিয়েছে। হঠাৎ বদর ফরাজির নামে বস্তা-বস্তা চিঠি আসতে দেখে বুয়া ভয় পেয়ে গেল। বদর বেকার সোসাইটির কমিটি গঠন করার উদ্দেশে এক পূর্ণিমার রাতে সাভার স্মৃতিসৌধের পাশে সবাইকে হাজির হওয়ার অনুরোধ জানাল।

বদরের আমন্ত্রণ পেয়ে নব্য বেকার, হাফ বেকার, ফুল বেকার, অব. বেকার- সবাই দলে দলে সমাবেশে যোগ দিল। আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর ঘোষক মাইকে ঘোষণা করল,
: আজকের সমাবেশে আগত বেকার-বেকারিনীদের স্বাগত জানাচ্ছি। কর্মহীন জীবন নিয়ে আমাদের অশান্তির সীমা-পরিসীমা নেই। এ অবস্থায় বদর ভাইয়ের মতো একজন কর্মবীর...
এ সময় সামনে থেকে প্রতিবাদ ভেসে এলো। প্রতিবাদকারী বলল,
: ভাই, বেকার আবার কর্মবীর হয় কিভাবে?
বিষয়টি নিয়ে মৃদু হৈচৈ শুরু হতেই ঘোষক বলল-
: ঠিক আছে, আমি কর্মহীন বীর বলছি। বন্ধুরা, কর্মহীন বীর বদর ভাই বেকার সোসাইটি গঠন করে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন। এবার তিনি আপনাদের সামনে কিছু বলবেন...
তুমুল হাততালির মধ্যে বদর ফরাজি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
: দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত সম্মানিত বেকার...
আবারও প্রতিবাদ ভেসে এলো। একজন দাঁড়িয়ে বলল,
: বদর ভাই, আপনের যা খুশি বলেন। দয়া করে বেকারদের সম্মানিত বলে সম্বোধন করবেন না!
বদর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
: আচ্ছা, ঠিক আছে! অসম্মানিত বেকার ভাইবোনেরা। জ্যোৎস্নাত-বিধৌত এ পূর্ণিমা রাতে আমার রূপালী শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আপনারা যেভাবে আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন, আমি বিমোহিত। এ মঞ্চে সবাইকে কথা বলার সুযোগ দিলে হাজার রজনীর প্রয়োজন হবে। সেজন্য আমি দেশের প্রতিটি বিভাগ থেকে একজন বেকারকে তার মনের কথা বলার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। প্রথমেই রংপুর বিভাগকে আহ্বান করছি...
বদরের আহ্বান শুনে রংপুর বিভাগের একজন বেকার মঞ্চে উঠে এলো। তার নাম আইনাল। আইনাল বলল,
: বন্ধুরা, আজ আমার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। দয়া করে কেউ আবার আমাকে ভূত ভেবে বসবেন না। তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী এই অর্থে তিন বছর আগে ঠিক এইদিনে সার্টিফিকেট আমাকে মৃত ঘোষণা করে আমার ৩০ বছর পূর্ণ করেছে। শুধু সার্টিফিকেট নয় বন্ধুরা, একটা চাকরি, শুধু একটা চাকরির জন্য আরও একজনের কাছে আমি মরহুম হয়ে গেছি। সে হল ময়না। বলতে লজ্জা নেই, বেকার হওয়ায় আমার দৌড় ছিল বাদাম আর ঝালমুড়ি পর্যন্ত। প্রতিবেশি আজমত উল্লাহর আমেরিকা ফেরত ছেলে কিসমত উল্লাহ যেই ময়নাকে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল, অমনি তার কাছে আমি মরহুম হয়ে গেলাম। আমাদের সাত বছরের প্রেম বাষ্প হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল!
আইনালের পর মঞ্চে এলো রাজশাহী বিভাগের প্রতিনিধি মিস কুমকুম। কুমকুম বলল,
: উপস্থিত কর্মহীন ভাই ও বোনেরা। আইনাল ভাইয়ের বক্তব্য থেকে আপনাদের কী ধারণা জন্মেছে, জানি না। আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনি শুধু ময়নাদের দোষটাই দেখতে পেয়েছেন, ময়নালরাও যে এক্ষেত্রে কম না, সেটাই এখন বলছি। মাস্টার্স শেষ করার পর আমরা দুজন চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম। এক অফিসে ইন্টারভিউ দেওয়ার পর বসের মেয়েকে বিয়ে করার শর্তে ময়নাল চাকরি পেয়ে গেল। ভালোবাসার জন্য আমি হিমালয় খুঁড়ে কোহিনূর আনতে প্রস্তুত ছিলাম। অথচ দেখুন, কী নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা! চার অক্ষরের চিরন্তন ভালোবাসা শব্দটি তিন অক্ষরের চাকরির কাছে ধরা খেয়ে গেল!
এরপর মঞ্চে যে এলো, নিজেকে সে বেকার রত্ন বলে পরিচয় দিল। এ বেকার রত্নের নাম খয়েরউদ্দিন। সে চট্টগ্রাম বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলল,
: জাতীয় একটা সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে আমরা ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত হয়ে পড়েছি, এটা খুবই লজ্জার কথা। ব্যক্তিগত কথা যদি বলি, তাহলে আমার চাকরিওয়ালা ভাইয়ের বৌ যে আমাকে খোদার খাসি, লেজহীন দামড়া ইত্যাদি বিশেষণ সহযোগে বাজার করা, বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নে্ওয়া, লন্ড্রি থেকে কাপড় আনা, বাস-ট্রেনের টিকিট কাটাসহ হাজার রকমের কাজ করিয়ে নেয়, সে সম্পর্কে বলতে হয়। আমি তা বলতে চাই না। কারণ সমস্যাটা জাতীয়।

এবার মঞ্চে ওঠে এলো খুলনা বিভাগের প্রতিনিধি মফিজুল। সে নিজেকে ‘বেকার-এ-বুলবুল’ বলে পরিচয় দিয়ে বলতে লাগল,
: আমি বেকার সমাবেশে উপস্থিত হলেও নিজেকে বেকার মনে করি না। কেন মনে করব? আপনারা কি কখনও শুনেছেন পশুপাখিদের কেউ বেকার বলছে? তাহলে মানুষের বেলায় কেন অপমানজনক এ শব্দ ব্যবহার করা হবে?
সামনে থেকে একজন উচ্চস্বরে বলে উঠল,
: পশুদের মধ্যে গরু-ছাগল দুধ-মাংস ও চামড়া দেয়। পাখিদের মধ্যে হাঁস-মুরগি ডিম দেয়, মাংস দেয়...
মফিজুল তার কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
: আমরাও দেব। কেউ যদি আমাদের প্রতিপালনের দায়িত্ব নেয়, তাহলে শুধু ডিম-দুধ না, পুরো বডি দিয়ে দেব।
এরপর মঞ্চে উঠল বরিশাল প্রতিনিধি মনসুর জোয়ার্দার। মনসুর জোয়ার্দার চেঁচিয়ে বলল,
: আগত লাখো কর্মহীন-কর্মসন্ধানী ভাইবোনেরা। আজকের মহাসমাবেশে আমার দুটি প্রস্তাবনা আছে। একটি হলো আমাদের একটা নিজস্ব সঙ্গীত থাকা প্রয়োজন। এর নাম হবে বেকার সঙ্গীত। এ সঙ্গীতের মাধ্যমে বেকারদের জ্বালা-যন্ত্রণা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-নিরাশা ও হতাশাগুলো সবার কাছে তুলে ধরা হবে।

দ্বিতীয় প্রস্তাবনা হল, দেশে উচ্চশিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত সবমিলিয়ে বেকারের সংখ্যা কয়েক কোটি। বেকারদের প্রায় সবাই ভোটার। এছাড়া তাদের সঙ্গে আছে ভাইবোন, মা-বাবা-চাচা-ফুপা-মামা-ভাতিজা, আছে বন্ধুবান্ধব, চাচি-খালা-ফুপু ও দাদি-নানিরা। বেকার সোসাইটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে অধিকাংশ আসনে জয়ী হওয়া কোনো বিষয়ই না। সরকার গঠনের পর আমার প্রথম কাজ হবে, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে আপনাদের মুক্ত করা।
এ সময় পাশ থেকে একজন বলে উঠল,
: জোয়ার্দার ভাই, এমনভাবে বলতেছেন, যেন আপনি প্রধানমন্ত্রী বনগায়া। ধান্ধা কম করেন। আমির জায়গায় আমরা লাগান।
মনসুর জোয়ার্দার হেসে বলল,
: ওকে, ওকে! ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কাজ হবে বেকার সোসাইটির প্রত্যেক সদস্যের চাকরির ব্যবস্থা করা।
সিলেট প্রতিনিধি দিলীপ কুমার মঞ্চে উঠেই কবিতা আবৃত্তি করল,
: হে বেকারত্ব! জীবন ও যৌবন ধ্বংসকারী বেকারত্ব! এই বাংলায় সত্যিই কি তুমি অবিনাশী? অজেয়? মাফ করবেন, বন্ধুরা। একসময় সুজিতাকে নিয়ে প্রচুর কবিতা লিখেছি। সুজিতা আমাকে ত্যাগ করলেও কবিতা ত্যাগ করেনি। লোকে বলে, কবিদের মাথায় সিরিয়াস কোনো চিন্তা আসে না। এ ধারণা ঠিক না। আমার মাথায় একটা সিরিয়াস চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি মনে করি, দেশে সরকারি কর্ম কমিশন নামে যে প্রতিষ্ঠান আছে, তার নাম পরিবর্তন করে বেকার কমিশন রাখা দরকার। কর্ম যেখানে অলীক, সার্টিফিকেট যেখানে কাগজের ঠোঙ্গা, সেখানে এ নামটাই পারফেক্ট।

সবশেষে ঢাকার প্রতিনিধিকে আহ্বান জানানো হল। ঢাকার প্রতিনিধি হিসেবে যে মঞ্চে ওঠল, তার নাম সাকেরা বানু। সাকেরা বানু আবেগমাখা গলায় বলল,
: আপনারা সবাই আমার দিকে তাকান। চেয়ে দেখুন, কী সীমাহীন বেদনা ধারণ করে আছে আমার ঊনত্রিশ বছর ছয় মাস বয়সী রমণী শরীর। আমার হাতে আর মাত্র ছয় মাস সময় আছে। এরপরই চাকরির বাজারে আমি ডিসকোয়ালিফাই হয়ে যাব। বিবাহের ক্ষেত্রে আমি সফল। সফল হয়েছি সন্তান জন্মদানেও। চাকরির ক্ষেত্রে কেন সফল হতে পারছি না? আমি মনে করি, এর জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। দায়ী শাসকগোষ্ঠী। দায়ী প্রচলিত রাজনীতি। আপনারা আগে এগুলোর পরিবর্তন করুন। এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে না পারলে এ দেশের বেকারদের বোবাকান্না আর দীর্ঘশ্বাসের অবসান কখনই হবে না।
সাকেরা বানুর কথায় বদর ফরাজি অভিভূত হয়ে গেল। হাততালি দেওয়া দরকার। সে হাততালি দিতে গিয়ে টের পেল, দুই হাত এক করা যাচ্ছে না। অবাক হয়ে এর কারণ অনুসন্ধান করতেই দেখল, তার সামনে দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এদেরই একজন বদরের এক হাত ধরে আছে। বদর সোজা হয়ে বসতেই অপর পুলিশ ফুর্তিমাখা গলায় বলল,
: পার্কটারে বাসা মনে কইরা তো জব্বর একটা ঘুম দিলেন! মেলা রাত হইছে। এইবার বাসায় যান।

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক।
[email protected]

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন