করোনাময় অর্থনীতি এবং আমাদের জিডিপি
ইয়াহিয়া নয়ন
করোনা মহামারির থাবা থামাতে পারেনি বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। বেশ কয়েক বছরের কঠোর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের মনশ্চক্ষুতে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার চিত্রে ভেসে উঠা বাংলাদেশ, আজ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি একনিষ্ঠ উদ্যোগের প্রতীক হিসেবে পুরোপুরিই স্পষ্ট। হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ সেই দেশ সম্পর্কেই এখন প্রাক্কলন করা হচ্ছে ভবিষ্যতের ‘এশীয় বাঘ’ রূপে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দাতাদের অবসাদ ও সেকেলে কর প্রশাসনের সুবাদে রাজস্ব ঘাটতির দরুন প্রচুর চাপ সত্ত্বেও বেশ কয়েক বছর যাবৎ গড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে মাথাপিছু আয়ের দ্রুত পরিবর্ধনই আজ অর্থনৈতিক বিশ্বের কাছে বড় বিস্ময় বাংলাদেশ। অর্থনীতির চাকা সচল রেখে করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করার রহস্য জানতে প্রতিবেশী দেশগুলোও আজ উদগ্রীব।
এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরে দেশে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০২১ এর হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। শিল্পখাতে শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের কারণে এমন প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বাংলাদেশ। এছাড়া বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হচ্ছে এবং সরকারি উৎপাদন বান্ধব নীতিমালার কারনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এই পর্যায়ে যাবে। এদিকে দেশের মূল্যস্ফীতি হতে পারে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। হালনাগাদ প্রতিবেদনে গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনও কমিয়ে এনেছে এডিবি। বলা হয়েছে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। যা আগে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।
জীবিকা রক্ষায় জীবন বাঁচানোর জন্য সরকারের নীতিগুলো বাংলাদেশের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে, যা সাম্প্রতিক কঠিন সময়ে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে একটিতে রাখতে সহায়তা করেছে। বিচক্ষণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, উদ্দীপক ব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির দক্ষ বাস্তবায়ন বাংলাদেশের মহামারি অবস্থায়ও অবস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করেছে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা, দ্রুত টিকা দেওয়া এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের উন্নতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলো প্রশংসাযোগ্য। ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতা, বিদেশি বিনিয়োগ, রপ্তানি বৈচিত্র্য, দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য ধারাবাহিক সংস্কার বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে উদ্দীপিত করবে। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে ত্বরান্বিত করবে ।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে সব দেশের অর্থনীতিই আক্রান্ত হয়েছে, যার ফলে কমেছে মাথাপিছু আয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। আসলে এখানে মূল কৃতিত্বটা অন্য জায়গায় নিহিত। বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিজ্ঞতা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সাহায্য করেছে। ক্ষুদ্র দেশ, অথচ লোকসংখ্যা ১৬ কোটি ৮০ লাখ। এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারার নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে যথাসময়ের অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ, সুদূরদর্শী নগদ উদ্দীপনা, রপ্তানি আয় ও দৃঢ় রেমিট্যান্স অন্তঃপ্রবাহ।
বিশাল জনসংখ্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশ মডেল আজ বিশ্বের কাছে এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত, যেটি তাকে সাহায্য করেছে এশীয় অঞ্চলে সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়া নায়ক বানাতে। করোনার বিস্তার রোধে লকডাউনের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি যখন সংকুচিত হচ্ছিল, সে জায়গায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের উন্নয়নের সুফল সবাই সমানভাবে পাচ্ছে না। অবশ্য এক্ষেত্রে আমরা একা নই। অবশ্য মানুষে মানুষে পার্থক্য সব যুগেই ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বৈষম্য বা অসমতা, যাই বলি না কেন, সারা বিশ্বেই বিদ্যমান।
আসলে, নতুন তথ্য হচ্ছে, অসমতার মাত্রা সম্পর্কে সবাই যা জানে, প্রকৃত মাত্রা তার চেয়ে অনেক বেশি। এককথায় যা ভয়াবহ। নতুন এক বিশ্লেষণে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। অসমতার সরকারি হিসাবে শুধু সেসব অর্থই বিবেচনায় আনা হয়, যার প্রতি কর আদায়কারীদের নজর পড়ে। সাম্প্রতিক এক গবেষণার পর এসব তথ্য জানিয়েছেন পৃথিবীর তিন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যালেট স্টাডসেটার, নিলস জোহানসেন ও গ্যাব্রিয়েল জুকম্যান। তাদের বিশাল কর্মযজ্ঞে পানামা ও সুইজারল্যান্ডের কাছে থাকা অত্যন্ত গোপনীয় দলিলের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। যেগুলো জানার পর বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই আর এর মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে কর ফাঁকির বিস্ময়কর সব তথ্য উঠে এসেছে, যার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সারা বিশ্বের বাঘা বাঘা সম্পদশালীরা।
করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ-সহায়তা অনুমোদন দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বর্তমান বিনিময়মূল্য হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৩০ পয়সা) টাকার অংকে এই অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট সহায়তা হিসেবে বাংলাদেশ সরকারকে এই অর্থ দেবে এডিবি। যা আমাদের অর্থনীতি আরও বেগবান করবে। টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচির আওতায় এডিবি বাংলাদেশকে মোট ৫০ কোটি ডলার ঋণ-সহায়তা দেবে। এর প্রথম কিস্তির ২৫ কোটি ডলার গত সপ্তাহে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বাকি ২৫ কোটি ডলার আগামী বছরের প্রথম দিকে অনুমোদন করা হবে বলে এডিবি ঢাকা কার্যালয়ের বহিঃসম্পর্ক বিভাগের প্রধান গোবিন্দ বর মিডিয়াকে জানিয়েছেন।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র-উদ্যোক্তা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার মাধ্যমেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করতে হবে। তাহলেই টেকসই পুনরুদ্ধার নিশ্চিত হবে। এডিবি বলেছে, ‘এই কর্মসূচি এমনভাবে পরিচালিত হবে, যাতে বাংলাদেশের মানুষের ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষমতা বাড়ে। ক্ষুদ্র, কুটির এবং মাঝারি শিল্পখাতে (সিএমএসএমই) করোনার যে ক্ষতি হয়েছে তা দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়।’ এ সহায়তা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা এবং অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি আনবে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বেগবান করতে সহায়তা করবে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জিকেএস