ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন : কারা লাভবান?

ইরানী বিশ্বাস | প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ০৮ অক্টোবর ২০২১

চলছে ইউনিয়ন নির্বাচন মৌসুম। সরকারের তৃণমূলের এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে গ্রামগঞ্জের হাটে, মাঠে, চায়ের দোকানে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে। একদিকে প্রার্থীর তৎপরতা, অন্যদিকে সমর্থকদের উচ্ছ্বাস, দুই মিলে যেন উৎসবের আমেজ। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য এসব তৃণমূল প্রার্থীরা সারাবছর লবিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। উপর মহলের সু-দৃষ্টি কামনা করতে যারপর নাই মরিয়া। কিভাবে ভোটের প্রার্থী হওয়ার টিকেট পাওয়া যাবে, সেই কাজেই মূলত এদের মনোযোগ বেশি থাকে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলের অফিসে বেড়ে গেছে প্রার্থীদের আনাগোনা। সারাবছর এমপি-মন্ত্রীদের বাসভবন বা কার্যালয়ে ধর্না দিলেও এখন তাদের দেখা যাচ্ছে দলীয় কার্যালয়ে। কারণ একটাই, কোন ভাবে যদি দলীয় নেতা-নেতৃত্বদের খুশি করে একটা মনোনয়ন ট্রাম কার্ড পাওয়া যায়।

দলীয় মনোনয়ন পাওয়াকেই অনেকে বিজয়ী মনে করছেন। অবশ্য এর কারণও আছে। গত পৌর নির্বাচনের দলীয় মেয়র প্রার্থীদের প্রায় সকলে বিজয়ী হয়েছে। এ দৃষ্টান্ত সকল ইউনিয়ন নির্বাচন প্রার্থীদের মনোবল আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে দলীয় মনোনয়ন পেতে সর্বস্ব বিনিয়োগ করছে সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অনেকেই দল বদলের অগ্রযাত্রায় শরিক হয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল ছাড়া মনোনয়ন পত্র বিক্রিতে আর কোন দল অংশগ্রহণ করেনি। সুতরাং অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনক্ষুণ্ণ হয়ে দলবদল করে ক্ষমতাসীন দলে ভিড়তে শুরু করেছেন। নব্য দলভারি করা প্রার্থীরা মরণকামড় দিতে নিজেদের মনোনয়ন পত্র নিলামে কিনে নিচ্ছেন। যে যত বেশি লবিং করছেন তার মনোনয়ন পাওয়ার অগ্রাধিকার তত বেশি। ফলে দীর্ঘদিন দলের সঙ্গে থাকা বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা ছিটকে পড়েছেন। আবার এলাকায় সুনাম থাকা সৎ-নিষ্ঠাবান নেতাও বাদ পড়ে যাচ্ছেন এই মনোনয়ন দৌড় প্রতিযোগিতা থেকে।

গত ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও প্রতীক নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন শুরু হয়। এ বিষয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। জারিকৃত প্রজ্ঞাপন সারা দেশের জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল। সমাজের যে জায়গায় রাজনীতির আধিক্য দেখা গিয়েছে, সেখানেই অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্ম হয়েছে।

একটা সময় ছিল যখন ছাত্র সমাজকে বলা হতো দেশের বিবেক। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতো। কিন্তু বর্তমানে সেই ছাত্র সমাজের অনেকেই নষ্টদের তালিকায়। তারা নেশাগ্রস্ত হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পরিবর্তে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাস্তার পাশে ফুটপাত দখল করে দোকান বসিয়ে প্রতিনিয়ত চাঁদা তোলার কাজ করছে। জমি দখল, অবৈধ সম্পদ দখলের মতো ঘৃণ্য কাজে ছাত্র রাজনীতি জড়িত।

ইতিহাস বলে দেয়, তৎকালীন ছাত্রসমাজের যারা রাজনীতি করতো তারা মেধাবী এবং সম্পদশালী ঘরের সন্তান ছিল। সুতরাং তাদের মনোভাব ছিল দাতা। তারা মানুষের দুঃখ-কষ্টে এগিয়ে আসতো। অনেকেই বাবা-মায়ের কাছ থেকে অর্থ এনে দলের কাজে দান করতেন। এমন অনেক মহান নেতাদের কথা ইতিহাসে লেখা না থাকলেও রাজনৈতিক ভাবে জানা যায়। তারা ছিলেন আদর্শ, যাদের কথায় মানুষ জীবন দিতে প্রস্তুত থাকতো সব সময়।

ছাত্র সমাজের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? দায়ী আমাদের রাজনীতির অপব্যবহার। রাজনীতির মতো পবিত্র শব্দটি এখন অপবিত্র অর্থে চলে যাচ্ছে। যে রাজনীতি শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা করেছে। সেই রাজনীতি আজ বুড়ি গঙ্গার পানির মতো কলুষিত হয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হতে পারে, বর্তমান ছাত্র সমাজের সামনে কোন আদর্শবান রাজনৈতিক নেতা নেই। যার আদর্শ ছাত্র সমাজকে সৎ-নিষ্ঠাবান হতে সাহায্য করতে পারে।

কথায় আছে, ‘বড় গাঙ মরে গেলেও তার রেখা থেকে যায়’ অর্থাৎ বিবেকবান মানুষ গরীব হলেও আদর্শ নষ্ট হয় না। তবে বিবেকহীন মানুষ সবসময় সুযোগ সন্ধানী হয়। অভাব মানুষকে হয়, মহৎ করে না হয় অসৎ করে। তবে বর্তমান সময়ের অধিকাংশ অভাবী মানুষেরা অসৎ হয়ে উঠছেন।

রাজনীনিতে সম্পদের গন্ধ পেয়েছে মানুষ। যে কারণে ডাক্তারির মতো সেবামূলক কাজ বাদ দিয়ে রাজনীতিতে সময় দিচ্ছেন তারা। যে কারণে দেশের মানুষ সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ডাক্তারগণ এখন চিকিৎসায় মনোযোগ না দিয়ে রাজনীতি করছেন। ফলে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা কাগজে কলমে উন্নত হলেও তার সুফল জনগণ পাচ্ছেন না। মানুষ অসহায় হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে চিকিৎসার জন্য চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

আমরা কিছু হলেই ভারতের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করি, উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করি। ভারতের সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার দেবী শেঠী। যাকে বাংলাদেশের আপামর মানুষ এক নামে চেনেন। তাঁর গুনকীর্তনে মানুষ বিভোর। তিনি মানুষের সেবায় হাসপাতাল তৈরি করছেন। ভারতের গুণী মানুষদের তাঁর হাসপাতালে সারপ্রাইজ দেওয়ার ঘটনাও আমরা পেপার পত্রিকায় জানতে পেরেছি। তাঁকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে দুইবার। কথাও বলেছি, এমনকি গল্পও করেছি। এমন দেবতুল্য মানুষকে রাজনীতি কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি চাইলে ভারত কেন বাংলাদেশেও একটা অনারেবল রাজনৈতিক পদ দিতে পারে। তবে তিনি কখনোই চাননি রাজনীতি। তিনি বলেছেন, রাজনীতি যেমন জনগণের সেবামূলক কাজ, ডাক্তারিও তেমনি জনগণের সেবামূলক কাজ।

অথচ বাংলাদেশের ডাক্তারদের এমন অবস্থা, যেন রাজনীতি না করলে নামের আগে ডাক্তার শব্দটি টিকিয়ে রাখা যাবে না। শুধু ডাক্তার নয়, গ্রামের হাইস্কুল শিক্ষক থেকে কলেজের শিক্ষকরাও রাজনীতিতে সক্রিয়। এতে শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশা থেকে সরে যাচ্ছেন শিক্ষকরা এবং ছাত্ররা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

মাত্র এক দশক আগেও ইউনিয়ন নির্বাচন ছিল শুধুই ইউনিয়নের বিষয়। গ্রামের সকলে মিলে ঠিক করতো কাকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান করা হবে। একবছর যে নির্বাচিত হতো, তার কাজ যদি সুষ্ঠু-স্বচ্ছ হতো তাহলে পরের বছরও তিনি নির্বাচিত হতেন। এমন অনেক ইউনিয়নে একই চেয়ারম্যান বারবার নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। তখন তারা ছিল মুখ চেনা। সারাবছর তাদের কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হতো, নির্বাচনে তাকে পুরস্কার হিসেবে ভোট বা সমর্থন দিয়ে জয়ী করা হতো। এসব নির্বাচিত হওয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা মানুষের কাছাকাছি থাকতো। তাদের সুবিধা অসুবিধায় এগিয়ে আসতো।

বর্তমানে যে নিয়ম হয়েছে, তাতে প্রার্থীরা এখন আর জনগণের কাছে যায় না। তাদের আর জনদরদী বলা হয় না। কারণ তারা জানে জনগণ চাইলেই আমি ভোটে প্রার্থী বা নির্বাচিত হতে পারবো না। সুতরাং জনগণ বাইপাস হয়ে গেছে। জনগণ চাইলেই তাদের কাঙিক্ষত নেতা-নেত্রীকে নির্বাচিত করতে পারছে না।

এসব তৃণমূল প্রার্থীদের দরকার ট্রাম কার্ড। এই ট্রাম কার্ডের আশায় সারাবছর ঢাকার সাথে তাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। আগে পুকুরে বড় মাছ হলে বাবা-মাকে খাইয়ে খুশি হতো। এখন এসব প্রার্থীরা মনোনয়ন দাতাদের খাওয়ানোতে ব্যস্ত। উপঢৌকন ছাড়া নেতা-নেত্রীদের বাসভবনে কেউ আসে না। বাজারের সেরা মাছ, ফল, মিষ্টি এমনকি শাড়ি, গয়না নিয়ে ছুটতে দেখা যায় তৃণমূল ইউপি মনোনয়ন প্রার্থীদের।

এতো গেল সারাবছরের লবিং সিস্টেম। যাতে নেতা-নেত্রীরা তাদের নাম এবং চেহারা মনে রাখেন। এরপর মাঠের জমি বিক্রি করে বা ধার দেনা করে মনোনয়নের ট্রাম কার্ড নিলামে কিনে নেন। এখানে জনগণের কৃতিত্ব কি? সুতরাং কেন তারা জনগণের খেদমত করবে? এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনগণের প্রাপ্য সেবা কেড়ে নিচ্ছেন মনোনয়ন বাণিজ্য নামে যারা দোকান খুলে বসেছেন।

ক্ষমতাসীন দলের অনেকের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ। কিন্তু কেন? তখনই আইন সংশোধন, পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করা হয় যখন দেশের স্বার্থ বা জনগণের স্বার্থে মঙ্গল বয়ে আনে। স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হবে- এই আইন কার স্বার্থে বা কার মঙ্গলের জন্য করা হয়েছে জানা নাই। এমন একটি আইন শুধু রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাসীন নেতা-নেত্রীদের পকেট ভারী ছাড়া আর কোন মঙ্গল বয়ে আনছে না। অতি জরুরি ভিত্তিতে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করা প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন