ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

উৎসবের ভোট, শঙ্কার ভোট

প্রকাশিত: ০৩:১৩ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০১৫

অনেক দিন বাদে সত্যিকারের একটি নির্বাচনী আবহ দেখছি সারাদেশে। নির্বাচন বলতে যে উৎসব, উত্তেজনা; খানিকটা শঙ্কা- তার সবই দেখা যাচ্ছে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে। `সত্যিকারের নির্বাচনী আবহ` কেন বলছি? ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বেশ কয়েকটি নির্বাচন  হয়েছে দেশে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো না সেই অর্থে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বয়কট কিংবা শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো- এসবই ছিলো গত সাত বছরের নিয়মিত ঘটনা। ফলে নির্বাচনগুলো সেই অর্থে আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি। কোনো অর্থেই কিন্তু চায়ের কাপে ঝড় ওঠেনি। সাত বছর পর আবার জমে উঠেছে নির্বাচনী আড্ডা, বিতর্ক। আবারো চায়ের কাপের ঝড়ের আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছে ঘরের ভেতর থেকেও। এ কারণেই বলছি, সত্যিকারের একটি নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে সারাদেশে।

এবারের পৌরসভা নির্বাচন আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি, তৃণমূলে সুশাসন নিশ্চিতকরণ সর্বোপরি স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রয়াণের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রথম স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় দলীয়ভাবে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। যে নির্বাচনে দীর্ঘদিন বাদে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। সাত বছর পর আবারো নৌকা ও ধানের শীষের ভোটযুদ্ধ দেখতে যাচ্ছে দেশবাসী।

স্বৈরাচারের পতনের পর নব্বইয়ের দশক থেকে দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া অর্থবহ কোনো নির্বাচনের কথা আমরা ভাবতেই পারি না। সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি, আস্থাহীনতা আর অবিশ্বাস দেশের প্রধান এবং বড় দুইটি রাজনৈতিক দলকে ভোটের যুদ্ধ থেকে বিরত রেখেছিলো অর্ধযুগের বেশি। সেই ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি`র ফিরে আসাটা অনেক মঙ্গলজনক বিষয়েরই ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে যারা হতাশ পড়েছিলেন, কিংবা হতাশ হতে চলেছিলেন- তারা অন্তত এটুকু আশা করতে পারেন যে শেষ মুহূর্তে খাদের কিনারা থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষার একটা চেষ্টা চলছে। এই চেষ্টাকে সফল করার পুরো দায়ভার সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের।

সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। সেই সুযোগ পেলে নির্বাচন কমিশনকেও প্রমাণ করতে হবে তাদের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে হওয়া অতীতের স্থানীয় সরকার এবং জাতীয় নির্বাচনের কথা একটু ভেবে দেখুন। কোনো নির্বাচনই কিন্তু পুরোপুরি প্রভাবমুক্ত ছিলো না। আবার নগ্নভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে সরকার- সেই অভিযোগও তোলা যাবে না। যদি কেউ তোলেন সেটা কেবলই তর্কের জন্য তুলবেন- এটা হলফ করে বলতে পারি। কারণ এই দেশে তালগাছের মালিকানা ধরে রাখার মতো লোক ঢের আছেন। সাধারণ জ্ঞানে ধরে নেয়া যায়, প্রত্যেকটা সরকারই চাইবে তার লোক কিংবা তার সমর্থিতরাই নির্বাচনে জয়ী হোক। যেহেতু প্রশাসন তার সেহেতু সেই চেষ্টা নিদেনপক্ষে যে করবে না- সেটা বিশ্বাস করার কিছু নেই। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছে উপজেলা নির্বাচনে। গণমানুষের ভোটের অধিকারের জন্য যে আওয়ামী লীগ লড়াই করেছে সারা জীবন, সেই আওয়ামী লীগের হাতেও কালি লেগেছে ওই নির্বাচনে।

আরেক বড় ভাবনার বিষয় বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারবে কিনা। এই ভাবনার কিছু কারণও আছে।

আওয়ামী লীগ ভোট ডাকাতি না করলেও বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে খুব বাজে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। সেটি হলো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার সংস্কৃতি। ২০১৪ সালের ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন ১৫৪ জন। ভাবা যায় অর্ধেকের বেশি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিই ছিলো না! ১৯৯৬ সালে বিএনপি উপহার দিয়েছিলো ভোটারবিহীন একটি জাতীয় নির্বাচন। আর ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ উপহার দিয়েছে প্রার্থীবিহীন একটি নির্বাচন। প্রতিদ্বন্দ্বিহীনতার এই সংস্কৃতি কিন্তু এবারের পৌরসভা নির্বাচনেও দেখা গেছে। সেটা বড় পরিসরে না হলেও শঙ্কিত হওয়ার মতো যথেষ্ট। ২৩৪টি পৌরসভায় এবার বিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হচ্ছেন ছয়জন মেয়র, ৯৪ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং ৪০ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর।

এই যে ১৪০ জন বিনাভোটে জয়ী হচ্ছেন যেসব পৌর এলাকায় সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো প্রার্থীই খুঁজে পাওয়া গেলো না? কেন গেলো না? মাঠ পর্যায়ে পাওয়া তথ্য বলছে, মামলা মোকদ্দমার কারণে এবার নাকি বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের প্রথম সারির বেশির ভাগ নেতাই নির্বাচনে আসেননি। আবার হুমকি ধমকিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে দেয়া হয়নি অনেককে। সেটা বিএনপির প্রার্থীদের জন্য যেমন, তেমনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনেকের ক্ষেত্রেই করা হয়েছে। এসবের দায়ভার সরকার এড়াতে পারে না কোনোভাবেই। আবার এমন একটি সংস্কৃতি যে নির্বাচন কমিশনের সময়ে ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে- সেই কমিশনকে নিয়ে ভাবনাটা অমূলক নয় কোনোমতেই।

এরমধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। নির্বাচন কমিশন সেই অর্থে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি? অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে, এমন বক্তব্য দিয়েই দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে কমিশন। কিংবা এড়ানোর চেষ্টা করছে। শুধু অভিযোগ পাওয়ার জন্য কেন বসে থাকবে নির্বাচন কমিশন? তাদেরতো উচিত নিজ উদ্যোগে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা খতিয়ে দেখা। যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সেই চেষ্টা `রকিব কমিশন` করবে বলে মনে হয় না।

আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন উৎসবমুখর গোটা দেশ। এতে সন্দেহ নেই এক বিন্দু। কিন্তু নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে জনমনে সংশয় আছে যথেষ্ট। সংশয় তৈরির জন্য নির্বাচন কমিশনই অনেকাংশে দায়ী। জনবল থাকা সত্ত্বেও ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে ১৭৫টিতে জনপ্রশাসন থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করা থেকে যেমন বিরত রাখা হয়েছে অনেককে, তেমনি মনোনয়নপত্র ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগও আছে। একটি পৌরসভায় দল থেকে একাধিক মনোনয়নপত্র দাখিল হলে সব মনোনয়নপত্র বাতিল। অথচ আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে তিনটি পৌরসভায় তা মানেনি নির্বাচন কমিশন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানোর অভিযোগও উঠেছে। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে দেখেনি। তাহলে কিভাবে বলি, এই নির্বাচন কমিশন যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করছে অথবা করতে চাইছে?

এই নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ছিলো বরাবরই। সবশেষ পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে। পাঁচ ধাপে সেবার নির্বাচন হয়েছিলো ২৫৩টি পৌরসভায়। এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন সেই কমিশনের অধীনের অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচন ছিলো প্রশ্নছাড়াই নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য। আর বর্তমান কমিশন একদিনেই করতে চাচ্ছে ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচন। এক দিনে এতগুলো নির্বাচনী এলাকায় সুষ্ঠু ভোট আয়োজনের প্রমাণ এই কমিশন দিতে পারেনি। সেক্ষেত্রে এমন ঝুঁকি নেয়ার কোনো দরকার আদৌ ছিলো কি? পাঁচ ধাপে না হোক, অন্তত দুই কিংবা তিন ধাপে নির্বাচন করলে তা অনেক সহজ হতো। এছাড়া, এবার মেয়র পদে দলীয় এবং কাউন্সিলর পদে নির্দলীয় নির্বাচন হওয়ায় নানা জটিলতার মধ্যে পড়তে পারেন ভোটাররা।

কয়েক ধাপে নির্বাচন করলেও যে তা সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ এই কমিশনের অধীনেই কয়েক ধাপে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেগুলোর অভিজ্ঞতা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। বিশেষ করে শেষ ধাপের উপজেলা নির্বাচনগুলোতে কারচুপি আর সহিংসতার কারণে বড় ধরনের সমালোচনায় পড়তে হয় নির্বাচন কমিশনকে। যদিও সেসবের দায় নেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, সেসব অনিয়ম-অসঙ্গতির জন্য তিনি সরকারকেই দায়ী করতে চেয়েছেন। যদিও তা মুখে বলার মতো সাহস বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেই বলেই আমার বিশ্বাস।

কাজেই আপাতত উৎসবমুখর হলেও আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার জায়গাটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। কারণ প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে হতে যাওয়া এই নির্বাচনকে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মোক্ষম সুযোগ হিসেবেই দেখবে সরকার। এই নির্বাচনের রায় নিজেদের পক্ষে নিতে পারলে সরকার আরো জোর গলায় দাবি করতে পারবে, জনগণ পেট্রোল বোমার জবাব দিয়েছে ব্যালট পেপারে। রাজনৈতিকভাবে আরো পোক্তভাবে এগিয়ে যেতে বর্তমান সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় সুযোগ এটিই। শঙ্কাটা সেখানেই। শেষ  ধাপের উপজেলা নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অশুভ কিছুই বয়ে আনবে। বিএনপি তখন দাবি করতে পারবে- এ কারণেই তারা এতদিন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে এতদিন নির্বাচনে আসতে চায়নি। ফের তারা ফিরে যাবে রাজপথে। যদিও সেই শক্তি তাদের অবশিষ্ট আছে কিনা- সেটাই গবেষণার একটা বড় বিষয়। সবমিলিয়ে সাত বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি ঘুরপাক খেতে থাকবে ওই জায়গাতেই। যেটা কারো কাছেই কাম্য নয়।

এমন একটা শঙ্কার জায়গা থেকে সবাইকে বের করে আনতে পারে একমাত্র নির্বাচন কমিশন। তাদেরকে সত্যিকারের নিরপেক্ষ হতে হবে। রাখতে হবে সত্যিকারের সাহসী ভূমিকা। নয়তো সিইসি যতই দায় এড়ানোর চেষ্টা করুন না কেন, ইতিহাসের দায় তিনি এড়াতো পারবেন না কখনোই। ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ চাইছে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ একটি পৌরসভা নির্বাচন। সেই চাওয়ার প্রতি নির্বাচন কমিশন, সরকার, বিরোধী পক্ষ সবাই সম্মান জানাবে- এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন