প্রীতিলতা: অকৃতজ্ঞ উপমহাদেশের আবক্ষ দায়বদ্ধতা
অপরাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক সার্বভৌমত্বের দেয়াল যখন ঠিক মতো গড়ে উঠেনি তখনো এখানকার মানুষের নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাস, আচার, ধর্ম, ধর্মকে কেন্দ্র করে উৎসব, পার্বণ সব কিছুতেই ছিল একাত্মা। ভৌগোলিক সীমারেখার দূরুত্ব আমাদের নাড়ি বা শিকড়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা আর দায়বদ্ধতার অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিয়েছে। নাড়ির বন্ধনেও যোগ করেছে র্স্বাথপরতা।
এ উপমহাদেশের সংস্কৃতি ত্যাগের, রক্তের বিনিময়ে নির্মিত এর ঐতিহ্যের স্তম্ভ। ভাতৃত্বের ঐতিহ্য উদাহরণ যেমন রয়েছে এ সংস্কৃতিতে, তেমনি অনেক প্রতীয়মান দৃষ্টান্ত আছে মীরজাফরিপনার। দেশ মাতৃকার মাটির টানে, স্বাধীন দেশের বাসনায় শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে বাংলার দামাল সন্তানেরা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের বুকের তাজা রক্ত। নিঃশেষে করেছেন দান সবুজ সতেজ প্রাণ। ভেঙ্গেছেন কপাট, কেটেছেন ললাট। কৃতজ্ঞ করেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সাধনায় কালে কালে ঘটেছে বহু বিদ্রোহ। ফরাজী আন্দোলন থেকে শুরু করে সিপাহী বিদ্রোহ, নীল চাষীদের নীল বিদ্রোহ, পাবনার কৃষক বিদ্রোহ, মাস্টারদার স্বদেশী আন্দোলনসহ ছোট বড় নানা অনেক বিদ্রোহ। উপমহাদেশের স্বাধীনতার প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছিল সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের কণ্ঠ থেকে। স্বার্থান্বেষী কিছু গোষ্ঠী মাস্টারদার স্বদেশী আন্দোলনকে আজো সাম্রাজ্যবাদীতার দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্যবাদী বলে নেতিবাচক আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন।
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম আরেক মুক্তিযোদ্ধা ও বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব বীর বাঙালি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে তিনিই প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ, যিনি সর্ব প্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতের অন্ধকারে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব (যার সাইনবোর্ডে লিখাছিল, ‘‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ”) দখলের সময় ১৫জনের একটি বিপ্লবীদল পরিচালনা করেছিলেন তিনি। গুলিবিদ্ধ বীরকন্যা রক্তচোষা ব্রিটিশদের হাতে আটক না হতে প্রায় একশ গজ দূরে সায়ানাইড খেয়ে রক্তাত দেহখানি সমর্পণ করেন মা-মাটির বুকে।
অভিন্ন বাংলার যে তরুণী নিজের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদের কবল মুক্ত করার জন্য যে ‘মরণ-স্বপন’ দেখেছিলেন, তার কর্মপন্থা যুগের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসন্দেহে আজ পরিত্যক্ত হয়েছে। এখন স্বাধীন দেশের ধনবান কর্তার ধনবতী বিবিরা আজ যারা ‘নারী অধিকার’ নামে আমাদের ‘গোপাল ভাঁড়ের গল্প’ শুনিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা- “কোথায় আমার নারী- আমার মা, আমার কন্যা অথবা আমার বোন শ্রীমতি প্রীতিলতার আত্মাহুতির স্বীকৃতিসূচক অধিকার?!”
প্রীতিলতা তার আত্মাহুতির মধ্যে দিয়ে উপমহাদেশের মুক্তিকামী ‘ভারতবাসী’কে মানুষ বানিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু ‘কুকুরগুলো’ এখনও ঠিক তখনকার মতোই রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তাঁর অপারগতা অনস্বীকার্য। নিশ্চিয় বিচক্ষণ প্রীতিলতা ঠিক বুঝতে পারছেন আমরা আসলে বড্ড অকৃতজ্ঞ। আর কিইবা কারার করার আছে আমাদের। এতো আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। সীরাজদ্দৌলার নুন খাওয়া বিশ্বাসঘাতক সেনাপতির বংশধর আমরা। স্বভাবতই কবি গুরু যথার্থই বলছেন, ‘‘সাতকোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।’’
অনাড়ম্বর ও ভাবলেশ ছাড়াই ওই আবক্ষ দেহখানি আজো পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়! সর্বশেষ প্রায় ৮০ বছর পর ২ অক্টোবর ২০১২ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তাঁর আবক্ষ অবতার নির্মাণ করেছে দায়মুক্তির বাসনায়। সমগ্র ভারত উপমহাদেশকে যে ভগবান স্বাধীন ভূখণ্ড দান করেছেন নিজের জীবনের বিনিময়ে, তাঁর কপালে জুটেছে মাত্র ১০০ (প্রায়) বর্গফুটের বেদী! স্থানীয় পর্যায়ে মে মাসে তাঁর জন্মবার্ষিকীতে শুধু একটা দায়সারা গোছের ফুলের মালা লক্ষ্য করা যায় প্রতিবছর।
কে নিবে এই দায়? স্বাধীন ভারত না শুধু স্বাধীন বাংলাদেশ? মানুষের মাঝে প্রকৃতিকে খুঁজে বেড়ানো আমার শখ। কোন অভৌত সম্পর্কে আমি অনুগামী ভক্ত নই। আমার ভালো লাগা রক্ত-মাংসের মানুষের সর্ম্পকায়নে। আমি সার্বজনীনতায় বিশ্বাসী। তিনটি ভিন্নপথে আমার কর্মস্থলের পথপরিক্রমা। প্রতিদিন ইচ্ছে করেই পাহাড়তলী রেলওয়ের পথ দিয়ে স্বদেশী ভগবানদের আত্মাহুতির ইতিহাস রোমন্থনে দেবী রাণী প্রীতিলতার আবক্ষ মূর্তির সামনে দিয়ে লজ্জ্বিত অবনত মাথায় সমগ্র ভারবর্ষের পক্ষে দায় মুক্তির বৃথা চেষ্টা করি।
এখনকার যামানায় রাজনীতি একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, দেশ তার বিকিকিনি পণ্য, দেশপ্রেম সে ব্যবসার শর্তসাপেক্ষে পরিবর্তনশীল র্ধম, আর সার্বভৌমত্ব একটা পরিবারতন্ত্র বা রাজতন্ত্র কর্তৃক ভূসম্পত্তির পরিসীমা। শুনেছি পুঁজীবাদি চাটুকার বুর্জোয়া কর্তৃক ওপার বাংলায় মাস্টারদা এবং এপার বাংলায় প্রীতিলতাকে নিয়ে ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে। এপারেও এমন একটি প্রয়াসের কথা শোনা যাচ্ছে।
প্রীতিলতার ভাস্কর্যের বেদীমূলে সোনার মাল্য খচিত হবে প্রায় শত বছরেও যা আজ অব্দি হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিম বঙ্গ প্রশাসন অথবা ভারত সরকার কিইবা অবদান রেখেছেন সেই রক্তিম সোনালী স্মৃতি অম্লানে! এ দায় কি শুধু একা বাংলাদেশের? চট্টগ্রামে বর্তমান ভারতীয় হাইকমশিন কার্যালয় থেকে শ্রীমতি প্রীতিলতার আবক্ষ মূর্তির দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটারের মধ্যে। কখনোতো দেখেনি বা শুনিনি যে, তারা প্রাতিষ্ঠানিক কোন উদ্যোগ, অনুষ্ঠান বা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন সেই আবক্ষ দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে।
পরিশেষে, ইংরেজ কবি Robert Browning এর The Patriot নামক কবিতা থেকে উদৃতি দিয়ে শেষ করব:
‘মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দৃশ্যপট সর্ম্পূণ বদলে যায়। সহর্সে, পরম উচ্ছ্বাসে একদিন যে দেশ প্রেমিককে জনগণ পুষ্পার্থে বরণ করে নিয়েছিল, মাত্র এক বছর পর সেই দেশ প্রেমিককেই জনগণ প্রস্তরাঘাতে রক্তাক্ত করে। জনগণ তাঁকে ভুল বুঝল। তার উপর সব ভালোবাসা, সম্মান ফিরিয়ে নিল, পুষ্পস্তবকের পরিবর্তে প্রস্তরাঘাত করল, ব্যঙ্গবদ্রিুপে জর্জরিত করল। ফাঁসির মঞ্চে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার ভাগ্য বিড়ম্বনায় দেশ প্রেমিক মোটেও হতাশ নন। বরং তিনি ঈশ্বর বিশ্বাসে অটল থেকে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন যে, জনগণের বিচার যাই হোক মরণোত্তর জীবনে ঈশ্বর তার প্রতি অবশ্যই ন্যায় বিচার করবেন, তার প্রাপ্য তাকে দেবেন।’
যে জাতি তার পূর্বপুরুষকে সম্মান দিতে জানে না, সে জাতি কখনও পৃথিবীর বুকে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারবে না। পারলেও তা দীর্ঘস্থায়ী বা সম্মানজনক হয় না। বোধ আছে বলেই এর উদয় হয়। আর বোধোদয় হয় বলেই আমরা অপরাধ বুঝতে পারি, বুঝতে পেরে তা মোচনের চেষ্টা করি। বোধ, মানে মূল্যবোধ আমাদের ভাবিত করুক আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্য প্রেরণার সন্ধানে, ইতিহাস চেতনার উদ্ভাবনে। তবেই সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও পরাধীনতার ছোবল থেকে উদ্ভাসিত হবে মুক্তির সূর্যালোক, আন্দোলোক ও মঙ্গলালোক।
লেখকঃ কলামিস্ট
[email protected]
এইচআর/জিকেএস