ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ই-কমার্স এবং ফটকাবাজির সুযোগ

ড. মাহবুব হাসান | প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

ই-কমার্স নিয়ে বেশ উদ্বেগে আছেন সাধারণ ক্রেতা ও ডিজিটাল ব্যবসা নিয়ে ভাবিত মানুষ। কারণ, কিছু ই-কমার্সের ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বা কতিপয় এই ব্যবসায় প্রতারণার নতুনমাত্রা যোগ করেছে , তাই-ই এখন তাদের ‘কাল’ হয়ে দেখা দিয়েছে বা দিচ্ছে। ই-ভ্যালি ও ই-অরেঞ্জ-এর মালিক-মোক্তার ধরা পড়ার আগেই তাদের নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল, টের পাওয়া যাচ্ছিল তারা টাকা পাচারের সাথে জড়িত, এবার তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবার পর জানা যাচ্ছে তারা কি অপকর্ম করেছেন।

কেউ ১১শ কোটি টাকা, কেউবা তারো চেয়ে বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে গ্রাহকদের কাছে থেকে। অথচ তাদের মূলধন তেমন কোনো মোটা অংকের নয়। বাকিতে তারা মালামাল কিনতেন। এমন একজন বাকিতে মোটর বাইক বিক্রেতা আল মামুন এদের একজনের কাছে পাবেন মাত্র ৭ কোটি টাকা। যমুনা গ্রুপ তাদের সাথে ব্যবসা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওয়ালটনও বেশ কয়েক কোটি টাকা পাবে ই-ভ্যালির কাছে, শোনা কথা হলেও, সত্যতা রয়েছে।

ই-ভ্যালির যে একাউন্টে গ্রাহকদের টাকা জমতো, সে একাউন্টও শূন্য। এদিকে ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করছে না তারা। তাদের টাকা দেশেই নেই। সে টাকা পাচার হয়ে গেছে। এর জন্য দায়ী কে? কাকে বা কাদের দায়ী করবো? আর কারা দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে ক্রেতাদের পণ্য দেবেন বা টাকা ফেরত দেবেন?

এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা দায়ী করবো সরকারকে। আমরা সরাসরি সরকারকে দোষারোপ করি। কেন না, সরকার হচ্ছে সব কিছু পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত বডি। কিন্তু আসলে, মানে সরকারের ওই সব কাজ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেই শাখার লোকজনই দায়ী যারা ই-কমার্স-এর অনুমোদনদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং এ-বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু অনুমতি দেবার আগে কি তিনি/তারা নিজের ক্ষমতার শক্তিটা পরখ করে নিয়েছেন? অর্থাৎ ই-কমার্স চালু করার জন্য সরকারের এই বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন প্রণীত হয়েছে কি না, তা অনুসন্ধান করে দেখেছেন? আইন প্রণীত হয়ে থাকলে তারা ধারা-অনুধারা বা উপধারায় কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তার কি মর্মমূল, তা বুঝে, আইনি ব্যাখ্যা পড়ে, বুঝে অনুমতি দিয়েছেন?

আসলে এ-সবের কিছুই করতে হয়নি তাদের। কারণ তাদের হাতে কোনো আইন নেই। ফলে আইন নির্দেশিত পথ তাদের জানাও নেই। কিন্তু কলমের এক খোঁচায় বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম বললেন, [ বাংলাভিশন টিভির এক টক শোতে] আজ পর্যন্ত কোনো আইন তৈরি হয়নি ই-কমার্সের। তথ্যটা কতোটা নির্ভরযোগ্য? জানি না। তবে, তিনি যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ই-কমার্স প্রতারণা নিয়ে কাজ করছেন, তিনি অনেকটাই বেশি জানবেন আমাদের চেয়ে। তিনি বললেন, এখনো ই-কমার্স শিশুকালে আছে। এইরকম প্রতারণা বন্ধ করতে হলে এখনই তার লাগাম টেনে ধরা উচিত। সেই লাগামটা হচ্ছে সাময়িকভাবে এই বাণিজ্য বন্ধ রেখে আইনপ্রণয়নও নীতিমালা তৈরি করে, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সচেতনভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগটা দিতে হবে।

কথা তিনি মন্দ বলেননি। একটি সম্ভাবনাময় বাণিজ্য খাতকে এ-রকম প্রতারণার হাত থেকে বাঁচাতে হলে এ-রকম সিদ্ধান্তই জরুরি বলে মনে করি। শিশু অবস্থায় থাকা এই ই-কমার্সের বাজারের আকার মাত্র ১৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের জন্য হয়তো কিছুটা বড়ই এ-অংক, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সামনে তা বিন্দু পরিমাণই। দুদক আইনজীবী খোরশেদ আলমের কথাই যথার্থ বলে মনে হয়। কিন্তু টিভিতে দেশের অভিজ্ঞ বিভিন্ন ভাষ্যকার বলছেন, এর মধ্যেই ই-কমার্স খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৮শ কোটি টাকার মতো। কোনটা যে সত্য তা বোঝার উপায় নেই। আসল হচ্ছে হাজার হাজার গ্রাহক প্রতারিত হয়েছে ই-অরেঞ্জ ও ই-ভালির মাধ্যমে। ধামাকা নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানও হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য গ্রাহকদের সরবরাহ না করে প্রতারণা করছেন। এই সব প্রতারিত গ্রাহকদের অর্থ কি তারা ফেরত পাবেন? নাকি তারা পণ্য পাবেন। আইনি ব্যবস্থায় ক্রেতারা জিতবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আইনি প্রক্রিয়াটা যে খুবই জটিল ও প্রলম্বিত, তা সবারই জানা। কবে নাগাদ সে রায় হবে এবং সেই টাকা কবে পাওয়া যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা আদালতও দিতে পারবেন না। কোথায় মিলবে সেই টাকা, কে তা বলতে পারেন? কারণ টাকাগুলো বেহাত হয়েছে, পাচার হয়ে গেছে।

আমরা কি জানি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কতো? না, জানি না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এক হাজারটি প্রতিষ্ঠান এই বাণিজ্যে আছে। ‘ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ [ই-ক্যাব] এর সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৬০৯টি। সব সদস্যই যে ই-কমার্সে সচল, এমনটা নাও হতে পারে। আবার সবাই বাণিজ্যে থাকতেও পারে। সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানই যে ইভ্যালি বা ধামাকা, ই-অরেঞ্জের মতো প্রতারণার ফাঁদ পেতে অনলাইনে ব্যবসা করছে, তা তো নয়। অধিকাংশই নতুন এই ব্যবসার নৈতিক নীতিতে ব্যবসা করছেন। দেশে একটা জোর ডিজিটাল হাওয়া চলছে এখন, সেটা বোঝা যায়। এতোগুলো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র কয়েকটির প্রতারণার জন্য গোটা উদীয়মান বাণিজ্য সেক্টর ¯্রােতটির সম্ভাবনা নষ্ট হতে বসেছে।

আমাদের তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট [থ্রি জি] চালু হয় ২০১৩ সালে। ওই সালেই বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ২০১৩ সালেই শুরু হয় ই-কমার্সের। ইন্টারনেট ভিত্তিক এই ব্যবসার প্রধান অবলম্বন বলে, গ্রাহক বাজারে যাওয়া/ আসা ঝুঁকি, রাস্তার জ্যাম ও ট্যাক্সি ভাড়া, স্কুটার ভাড়া বা রিকসার ভাড়ার খেসারত দিতে নারাজ। যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাড়া এতোটাই বেড়েছে যে তা কল্পনাও করা যায় না। মধ্যবিত্ত মানুষ-এর নাভিশ্বাস উঠার যোগাড়। ই-কমার্সের দ্রুত অগ্রগতির পেছনে এটা একটি কারণ। এরাই মূলত বিভিন্ন রকম পণ্য কিনছে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে। ২০২০-২১ সালে এর অগ্রগতি শতকরা ৫০ ভাগ।

হাইকোর্ট বলেছে, ই-কমার্স সম্পর্কিত কোনো আইন নেই, আছে একটি কমিশন। সেই কমিশনই ই-কমার্স পরিচালনায় কাজ করছে। ঠিক এ-কারণেই ই-ভ্যালি যখন বাজার দরের চেয়ে অনেক কমে বা অর্ধেক দামে কোনো পণ্য গ্রাহককে দেবার প্রলোভন দেয়, তখন কমিশন চোখ বন্ধ করে চা খায়। যখন পণ্যের অর্থ পরিশোধ করার ২/৩ মাস পর সেই পণ্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা রাখে, তখনও তারা খোশগল্পে মেতে থাকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কি কাজে ব্যস্ত থাকে, তা তারাই ভালো জানেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল হিসাব দেখে কতো টাকা লেনদেন হলো। এর বাইরে তাদের কি দায়িত্ব? তাদের হিসাবে ই-কমাসেরও সংখ্যা ১ হাজার। ই-ক্যাব বলছে ১৬০৯টি। অর্থাৎ কোনো পক্ষই সঠিক কিছু জানে না। দেশের বাণিজ্যের ই-কমার্স কিভাবে চলছে, তা আমরা বলতে পারছি না। সংশ্লিষ্টরাও বলতে পারছেন না।

একটি সম্ভাবনাময় বাণিজ্যের পথটিকে এভাবে গোবলেট করার পেছনে কি কারণ আছে? তা খুঁজে দেখতে হবে। কারণ এই সম্ভাবনাময় ওয়েতেই লুকিয়ে আছে আমাদের উৎপাদনভিত্তিক পণের সম্প্রসারিত বাজার ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সোপান। সেই সোপানে চড়ে বসতে হলে সব কিছু বাদ দিয়ে আইন প্রণয়ন এক নম্বরের কাজ। সরকার কেন এ-কাজটি করেননি, সে জবাব কি দেবেন? জবাব দেবার যে নৈতিকতা তা কি বহন করেন সরকার? সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেন আইন না করে ই-কমার্স চালু করলো? তবে, তারা অনুমতি দিতে পিছপা হয়নি। কারণ তাদের গাঁটছড়া প্রতারকদের সাথে। তাদের ব্যাংক একাউন্ট ও সম্পদের হিসাব নেয়া জরুরি কাজ। কেননা, প্রতারক শ্রেণি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের লোভের আগুনে ঘি ঢেলে অনুমতিপত্র পেয়ে গেছেন। সেই অনুমতিপত্র যে অবৈধ/ বা প্রশ্নসাপেক্ষ তা তাদের বোধ জাগেনি। তারা কেবল টাকা বানানোর ফাঁদ হিসেবে এই ই-কমার্সকে দেখেছেন।

যারা প্রশ্নবিদ্ধ বাণিজ্যেরত, তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। সবার আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লাগামও টেনে ধরতে হবে। কেন না, গোড়ায় তারাই প্রধান দোষী। কেন তারা সরকারের সামনে ই-কমার্স আইন প্রণয়নের কথা তোলোনি বা সেই উদ্যোগ নেয়নি, কেন তার আগেই ‘ঘোড়ার আগেই গাড়ি/ বা গাড়ির আগে ঘোড়া’ জুড়ে দিয়ে দিব্বি হাওয়া খাচ্ছেন, তার খেসারত দিতে হবে। আগে আইনি শক্ত ভিত রচিত হোক, নীতিমালা তৈরি হোক, প্রতারণার আইনি ও নীতিমালার ফাঁক বন্ধ করার প্রয়াস নেয়া হোক, তারপর ই-কমার্সের ঘোড়া ছুটুক।

লেখক : কবি, সিনিয়র সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন