বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অন্তর্নিহিত বাণী এখনো প্রাসঙ্গিক
তসলিমা আক্তার
হাইকোর্ট ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ এক রায়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় এ ভাষণ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ দু’যুগের বেশি সময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ করে রাখে।
যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে ভয় পায়, তাদের জন্য হাইকোর্টের এ রায় একটি কঠোর সতর্কবার্তা। বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু ক্লাসে/কোর্সে বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক ভাষণ পড়ানো হয়। চারবছর আগে একজন আইনজীবীর দায়ের করা এক রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট প্রদত্ত এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্ম জাতির পিতার নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আরো বেশি করে জানতে পারবে। সকল অপশক্তি মোকাবিলায় এর চেয়ে বড় মোক্ষম অস্ত্র আর কী হতে পারে! এ রিটের শুনানিতে হাইকোর্টের ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ এর নির্দেশনার আলোকে সরকার ৭ মার্চকে ‘জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। উচ্চ আদালত একইসাথে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) ঐতিহাসিক ভাষণস্থলে বঙ্গবন্ধুর তর্জনি উঁচিয়ে ভাষণের ভঙ্গির ভাষ্কর্য নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছে। মুজিববর্ষের মধ্যে সারাদেশে সকল জেলায় ও উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের নির্দেশনাও দিয়েছে হাইকোর্ট।
বিশ্ব নেতাদের বেশ কিছু ভাষণ বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু কোর্সের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। পাঠ্যসূচিভুক্ত এসব ভাষণের মধ্যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল সমাবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। কোটি কোটি বাঙালিকে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কঠিন শপথে উদ্দীপ্তকারী বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকণ্ঠের ভাষণ শিক্ষার্থী বিশেষ করে সাহিত্য অনুরাগীদের কাছে অত্যন্ত আগ্রহের একটি বিষয়। ঐতিহাসিক এ ভাষণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে- পাবলিক এড্রেস সম্পর্কিত সকল যোগাযোগ দক্ষতার ফলপ্রসূ প্রয়োগ, যার জন্য ভাষণটি যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বিশেষ করে শিক্ষকদের কাজে ‘টেক্সবুক এক্সামপল’-এর মর্যাদা লাভ করেছে।
প্রত্যেক নেতাই একজন শিক্ষক বা ভালো যোগাযোগ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি। এ অনন্য দক্ষতা আমরা বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্য করি। একজন শিক্ষক যখনই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দেখবেন, শুনবেন, পড়বেন, তিনি নিশ্চিতভাবে শিক্ষণীয় কিছু না কিছু পাবেন, যোগাযোগ দক্ষতা সম্পর্কিত বিষয়তো অবশ্যই।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মতো আর কোনো সেরা ভাষণ বিশ্বকে এতটা নাড়া দিতে পারেনি। অনলাইনে ক্লিক করলে এ ভাষণের ওপর ব্যাপক লেখালেখি মুহুর্তের মধ্যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ নিয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো জার্নাল, সংকলন, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গবেষণাপত্র, সংবাদ প্রতিবেদন, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-এর খবর প্রকাশিত হচ্ছে। মার্কিন নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজউইক’-এর ৫ এপ্রিল, ১৯৭১ ইস্যুতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অভ্ পলিটিক্স’ (রাজনীতির কবি) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে শুরু থেকেই চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছিল। সে সময় নিউজউইকের এ মূল্যায়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকে বিশ্বের দৃষ্টি ফেরাতে সহায়তা করে।
সাহিত্যের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি মনে করি, প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতাই একজন কবি। কবিদের মতো রাজনৈতিক নেতারাও তাদের জনগণকে একটি স্বপ্নের জগতে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুও ছিলেন সে ধরনের একজন বড়োমাপের কবি, একজন রাজনীতির কবি যিনি তাঁর দেশের মানুষকে স্বপ্নে বিভোর, মন্ত্রমুগ্ধ করতে পেরেছিলেন। সে স্বপ্ন ছিল হাজার বছরের পরাধীনতার শিকল ভেঙে একটি স্বাধীন দেশ পাবার, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার। কবিরা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান, স্বপ্নকে বাস্তব করার কথা নাও ভাবতে পারেন। একজন রাজনীতির কবি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি যে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, এবং তাঁর জনগণকে যে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর করেছিলেন, তিনি তা বাস্তবে রূপ দিতে সমর্থ হয়ে ছিলেন। এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক বড় বড় নেতা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।
একমাত্র বঙ্গবন্ধুই হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন পূরণে সফল হয়েছিলেন। আর তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং জাতির পিতা। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছেদ্য। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধুও থাকবেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখানোর ষড়যন্ত্র কখনো সফল হয়নি। বরং যড়যন্ত্রকারীই বারবার ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
বহুলপ্রত্যাশিত স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক- ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ খ্যাতি এনে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য জনসভায়, অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছেন। তাঁর প্রত্যেকটি ভাষণই এক একটি কবিতা। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল তাঁর সেরা ভাষণ, ‘মাস্টারপিস’। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নেতৃত্বের মোহনীয়তা, জ্ঞানের প্রগাঢ়তা, চিন্তার গভীরতা, ব্যক্তিত্বের বিশালতা- সবদিক থেকেই তিনি তখন চূড়ান্ত শিখরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যখন এ ভাষণ শুনতো, তারা এক অসাধারণ মানসিক শক্তি পেতো। অর্ধ-শতাব্দী পরও আমরা যখনই এ বিশ্বসেরা ভাষণ শুনি, রক্তে একটা আলোড়ন অনুভব করি। এ ভাষণের শব্দগুলো এমনি এক বিস্ময়কর গাঁথুনিতে গাঁথা যে, এর একটি শব্দও এদিক-ওদিক করার সাধ্য কারো নেই। কেউ এতে কলম ধরতে পারবে না। আমরা যখন এটি পড়ি, আমরা যখন এটি শুনি- আমাদের কাছে মনে হবে এক অবিস্মরণীয় শক্তিধর কবিতা, কখনো গদ্য মনে হয় না।
জনসমাবেশে তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় অত্যন্ত দক্ষ বঙ্গবন্ধুর আরেকটি সহজাত গুণ ছিল লেখালেখি। এ ক্ষেত্রেও তাঁর প্রতিভা ছিল অসাধারণ। দৈনিক ইত্তেহাদসহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকতায় তাঁর দক্ষতা আমরা লক্ষ্য করি। এছাড়া, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ (বঙ্গবন্ধুর প্রায় ১৩ বছরের কারাবাসের দৈনন্দিন ডায়েরির ওপর গ্রন্থ) ‘আমার দেখা নয়া চীন’ এবং ‘স্মৃতিকথা’ (প্রকাশের অপেক্ষায়) গ্রন্থে আমরা তাঁর স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ সৃজনশীল লেখালেখির প্রতিভা লক্ষ্য করি।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়--জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের ৭ মার্চের ভাষণ ও এর পটভূমি নিয়ে ব্যাপক পড়াশুনা করতে হয়। এসব ছাত্রছাত্রীকে বিশ্বসেরা অন্য ভাষণগুলোও অধ্যয়ন করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘দ্য গেটিসবার্গ এড্রেস’, মার্কিন মানবতাবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ (আত্মজীবনী ও ভাষণসমূহ)। রেফারেন্স হিসেবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল, সোভিয়েত নেতা ভ্লাদিমির লেলিন, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং, ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন, ভারতের অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী এবং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু’র ভাষণগুলো শিক্ষার্থীদেরকে পড়ানো হয়।
বিশ্বসেরা ভাষণগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অবস্থান সবার ওপরে। এটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। এ ভাষণের বিশেষত্ব হচ্ছে; কোন ধরনের স্ক্রিপ্ট বা টকিং পয়েন্টস ছাড়াই বঙ্গবন্ধু একেবারে এক্সটেম্পো এ ভাষণ দেন। বর্তমানে প্রাপ্ত স্ক্রিপ্ট অডিও-টেপ শুনে তৈরি করা। আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু এ ভাষণ দিয়েছেন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এ ধরনের প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে ভাষণ দিতে আমরা আর কোন নেতাকে দেখি না। আব্রাহাম লিংকনের সেরা ভাষণ ‘দ্য গেটিসবার্গ এড্রেস’ ছিল মাত্র ৩ মিনিটের, শব্দ সংখ্যা ২৭৫ এরও কম। ‘ব্যাটেল অভ গেটিসবার্গ’-এ নিহত সৈন্যদের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রদত্ত এ ভাষণের স্ক্রিপ্ট পূর্বে তৈরি করা ছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল তার সেরা ভাষণ “নেভার ওয়াজ সো মাচ ওড বাই সো মেনি টু সো ফিউ” দিয়েছিলেন ‘ব্যাটল অভ ব্রিটেন’ যুদ্ধে রয়েল এয়ার ফোর্সের নিহত পাইলটদের স্মরণে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর একক নেতৃত্বে দীর্ঘ দুই যুগের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনরত নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে অনতিবিলম্বে স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিতে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়েন। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গড়িমসি ছলচাতুরি থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার এ চাপ তৈরি হয়। বায়ান্নো’র ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নো’র যুক্তফ্রন্ট, বাষট্টি’র শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টি’র ছয়দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনের পর বাঙালিরা ঘোষণা করে, তারা স্বাধীনতা ছাড়া আর ঘরে ফিরবে না। অন্যদিকে পাকিস্তানি জান্তার ভাষায় এক পক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং তারা যে কোন মূল্যে তা দমন করবে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা বঙ্গবন্ধু কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদী দুর্নাম মেনে নিতে রাজি ছিলেন না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সহানুভূতিও বঙ্গবন্ধুর বিবেচনায় ছিল। এজন্যই তাঁকে ৭ মার্চের ভাষণের শব্দ নির্বাচন করতে হয়েছে অনেক চিন্তাভাবনা করে, অনেক কৌশলী হয়ে। তিনি কতটা কৌশলী ছিলেন! বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের শেষ দিকে আসন্ন যুদ্ধে শত্রু মোকাবিলায় যার যা কিছু আছে তা নিয়ে তৈরি থাকতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম—এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং সর্বাত্মক নির্দেশনা প্রদান করেন। অবশ্য, ভাষণের প্রায় মাঝামাঝিতে ২৫ মার্চ ডাকা এসেম্বলি সেশনে যোগ দেয়ার বিষয় চিন্তাভাবনা করতে বঙ্গবন্ধু ৪টি শর্ত দেন। এসব শর্তের মধ্যে ছিল--মার্শাল ‘ল’ প্রত্যাহার, সেনা সদস্যদের ব্যারাকে ফেরানো, বাঙালি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মকভাবে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা “আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো”। এ ভাষণে পরপরই পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “তোমরা আমার ভাই--তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না”। ভাষণে বঙ্গবন্ধু চলমান হরতালে সরকারি, আধা-সরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেন। একইসাথে দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ বিবেচনা করে রিক্সা, ঘোড়াগাড়ি, রেল, লঞ্চ প্রভৃতি হরতালের বাইরে রাখার ঘোষণা দেন। ভাষণে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধুর সেই কঠোর হুঁশিয়ারি, “আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকের উপর হত্যা করা হয়-”; “কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না, ভালো হবে না” সেই থেকে সবার মুখে মুখে। একই ভাষণে দেশবাসীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর আকুতি, “এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়--মনে রাখবেন”। এভাবে এ ঐতিহাসিক ভাষণে আমরা কোমল হৃদয়ের মানবিক বঙ্গবন্ধু এবং একইসাথে লক্ষ্য অর্জনে অবিচল, কঠোর ও আপোষহীন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাই।
কথোপকথনের ভঙ্গি ৭ মার্চের ভাষণকে সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করেছে। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও নির্যাতনের পুরো ইতিহাস সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী এ ভাষণে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে বিশাল জনসভায় জনতা, ভয়াবহ সাইক্লোনে মহাসাগরের তীব্র ঢেউয়ের মতো উদ্বেলিত হতে থাকে। তাঁর উদাত্ত আহ্বান পুরো বাঙালি জাতিকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি করে তোলে।
ভাষাশৈলী ও যোগাযোগের বিবেচনা থেকেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের বিশেষ গুরু্ত্ব রয়েছে। ভাষা শিক্ষণ জ্ঞানের আলোকে আমরা জানি, পুরোপুরি বোধগম্য যোগাযোগের জন্য একজন ব্যক্তি প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ ৩টি শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন। জনসমাবেশে ভাষণের ক্ষেত্রে বোধগম্য যোগাযোগের জন্য বক্তাকে আরো অনেক ধীরগতিতে কথা বলতে হয়। শত শত লাউড স্পিকার ব্যবহার করে রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখের বেশি মানুষের বিশাল সমাবেশে সর্বোচ্চ বোধগম্য যোগাযোগের জন্য শব্দের এ হিসাব হবে সাধারণ শব্দসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। তাত্ত্বিক এ হিসাবের সাথে বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণের শব্দসংখ্যা একবারে মিলে যায়। প্রায় ১৯ মিনিটের সে ভাষণে শব্দসংখ্যা ১,১০৭। অসাধারণ বক্তা বঙ্গবন্ধু বোধগম্য যোগাযোগের সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে সে ভাষণে প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন।
একেবারে এক্সটেম্পো ৭ মার্চের ভাষণে কোন শব্দের অনর্থক পুনরাবৃত্তি বা কোন অপ্রাসঙ্গিক শব্দ দেখা যায় না। অবশ্য দু’একটি ক্ষেত্রে বক্তব্যে জোর দেয়ার জন্য শব্দের পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে। গণমানুষ থেকে ওঠে আসা সহজাত নেতা বঙ্গবন্ধু তাঁর ভরাট কণ্ঠ, উচ্চারণ, স্বরের ওঠানামা, ব্যক্তিত্ব, বডি ল্যাংগুয়েজ বিশেষ করে তর্জনি উঁচিয়ে সেরা সেই ভঙ্গির মাধ্যমে এতটাই সহজবোধ্য ছিলেন যে, সে বিশাল সমাবেশে উপস্থিত প্রত্যেকে তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। ভাষণ দেয়ার সময় সমাবেশে প্রতিটি অংশের দর্শক- শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তিনি যেভাবে ঘুরছিলেন, সে কৌশলও ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভাষণে গণমানুষের মুখের ভাষা ব্যবহার এটিকে আরো ফলপ্রসূ করেছে। যেমন বঙ্গবন্ধু ভাষণে পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “৭ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না”। এখানে আঞ্চলিক ভাষার শব্দচয়ন বক্তব্যকে অনেক বেশি বলিষ্ঠ করেছে।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের এ অতুলনীয় দক্ষতা বঙ্গবন্ধু বহু বছরের সাধনায় অর্জন করেছেন। তিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ ভাষণ দিয়েছেন তাৎক্ষণিকভাবে, কোন ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই। ডায়াস থেকে জনসমাবেশের মানুষ দেখেই তাৎক্ষণিক বক্তব্য তৈরি করার এক অসাধারণ মেধা তাঁর ছিল। কারো সাথে কোথাও কথা বললে দীর্ঘদিন পরও তিনি তাকে মনে রাখতে পারতেন। এমনকি নামও মনে রাখতে পারতেন। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি মানুষের মনের ভাষা বুঝতেন। আর তাই তিনি ছিলেন সারা দেশের গণমানুষের নেতা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর, ইউনেস্কো’র ‘মেমোরি অভ্ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ এ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ অন্তর্ভুক্তির আগে, ইউনেস্কো’র আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিটি’র সদস্যগণ ২০১৭ সালের ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর প্যারিসে সংস্থাটির সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে একটি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টিকারী এ জ্বালাময়ী ভাষণের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন করেন। মূল্যায়ন কমিটি’র সদস্যগণ বারবার ভাষণের ভিডিও দেখেন এবং বিস্মিত হন- ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উঁচু একজন বাঙালি নেতা তাঁর শব্দের বিস্ফোরণে স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত জনতার সমুদ্রে কীভাবে ঝড় তুলে চলেছেন! ইউনেস্কো বলেছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে এমন অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে, যেখানে সকল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অন্তর্নিহিত বাণী এখনো প্রাসঙ্গিক বলে বিশ্ববাসীকে এটি এখনো উদ্দীপ্ত করে বলে ইউনেস্কো’র ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।
পিআইডি ফিচার
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, ঢাকা।
এইচআর/জিকেএস