ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিজয়ের মাসে নতুন অঙ্গীকার

প্রকাশিত: ০২:৪৮ এএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

১৯৭১ থেকে ২০১৫। আমরা এগিয়ে এসেছি ৪৪ বছর। অথবা ৪৪ বছর আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আমরা ৪৪ বছর এগিয়ে এসেছি। কিন্তু এই এগিয়ে আসার পশ্চাতে কত দুঃখ-বেদনা, কত ত্যাগ-তিতিক্ষা, স্বজন হারানোর অশ্রুঝরা পথ আমাদের পার হতে হয়েছে তার হিসেব রাখার কে আছে? যারা সরাসরি দুঃখ পেয়েছে, বেদনায় জর্জরিত হয়েছে, যারা সহায় ও সম্বলের পাশাপাশি স্বজন হারিয়ে বেঁচে জীবন নিয়ে থাকাটাকে একেবারে নিঃস্ব ও রিক্ত করতে বাধ্য হয়েছে তাদের অশ্রুধারার মর্ম আমরা কি করে বুঝবো? বিশেষত আমরা যারা বিনা ত্যাগের বিনিময়ে নির্ভেজাল এক স্বাধীন ভূখণ্ড লাভ করেছি। শুধু লাভ নয়- ভোগ করছি স্বাধীন দেশের অপরিমেয় আনন্দ, আলো ও সুবাতাস। অশ্রু ঝরাইনি, স্বজন হারানোর দুঃখ ও বেদনা কতটা গভীর ও ব্যাপক হতে পারে জীবনে একবারের তরে বুঝতেও চেষ্টা করিনি, মানুষের জীবনে ত্যাগের তীব্রতা কতটা ব্যাপক হতে পারে তাও ভ্রমে কখনো অনুধাবন করিনি। কেবল স্বাধীন দেশের মাটিতে স্বাধীনভাবে চলেছি, ফিরেছি, ঘুরেছি, আনন্দে মেতেছি- মাতোয়ারা হয়েছি।  

বিজয়ের মাস এলে হয়তো বৎসরান্তে স্থানীয় শহিদ মিনার কিংবা জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে লোক দেখানো ফুলের স্তবক নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এই দেশমাতৃকার জন্য, এই স্বাধীন দেশের জন্য কিংবা যদি বলি ৩০ লাখ শহিদের জন্য মাত্র এইটুকু করেই স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করা কতটুকু নৈতিক তা না জেনেও নিজে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সেই আনন্দে, সেই স্ফূর্তিতে গা ভাসিয়েছি নিরবধি নিরন্তর। কখনো খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাসের পর মাস কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে সংগ্রামরত ছিলেন। ভাবতে চেষ্টা করিনি কী ভয়ানক সংগ্রামে এদেশের তিরিশ লাখ মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল, কী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল দুলক্ষ মা-বোনকে। আমরা এসব ভাবিনি, ভাবি না। এও ভাবিনা কত অসহায় মুক্তিযোদ্ধা এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছে। খোঁজ রাখার অবকাশ পাই না তারা এই স্বাধীন দেশে দুবেলা দুমুঠো খাবার পচ্ছে কি না। হয়তো এসব ভাবতেও আমাদের ভাল লাগে না। আমরা আমাদের ভালোলাগার বাইরে এক পা হাঁটি না। নিজের সুখ ও স্বার্থের বিপরীতে কিছু চিন্তাও করি না কখনো।

আমাদের ভাবনার জগতে বিন্দুমাত্র জায়গা যদি থাকতো দেশমাতৃকার জন্য ভাববার, স্বাধীনতার জন্য ভাববার, স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদ ও আত্মদানকারীদের জন্য ভাববার তাহলে হয়তো তিরিশ লাখ শহিদের আত্মা শান্তি পেত, দুলক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানোর বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব হতো, দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যেত যে-লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল নানা ক্ষেত্রেই তার প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা মানবিক চিন্তার বা মানবীয় চিন্তার শক্তি আর অবকাশটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। যদি ভাববার শক্তি ও অবকাশ থাকতো স্বাধীন দেশ, মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তিসহ নানা বৈচিত্র্যে এগিয়ে যেতাম আরো অনেক দূরে- উন্নতির শিখরে। আমরা দেশ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ ও তার আদর্শ নিয়ে ভাবি না। ভাবি না বলেই সেই সুযোগ নিয়ে একটি মহল গণতন্ত্রের ছদ্ম পোশাকের নিচে পরাজিত পাকিস্তানি আদর্শ লুকিয়ে রাষ্ট্রের মালিক সেজে বসেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর। এরা ভেবে নিয়েছিল দেশটি তাদের। আর যুদ্ধে যারা শহিদ হয়েছেন বা বেঁচেছিলেন তাদের স্বজন ও মুক্তিযোদ্ধারা উল্টো বনে গিয়েছিলেন দেশের শত্রু। অন্তত উর্দিপরা রাষ্ট্রশক্তি দীর্ঘ দিনে দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ বলে কিছু নেই। অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করারও কিছু নেই, কোনো মানে নেই। বর্তমান নিয়ে চিন্তা করার পাকিস্তানি লেবাসে ‘সবক’ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সব আদর্শ, মানুষের ত্যাগ, আর অবারিত অশ্রুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের শৃঙ্খলিত করে ফেললো কৌশলে।

স্বীয় মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করে সেনা শাসক মেজর জিয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে ফেললেন। পরাজিত, ঘৃণিত, নরঘাতক, নারীলোলুপ পাকিস্তানপন্থিরা দলে দলে জিয়ার কৌশলী পতাকা তলে জড় হয়েছিল নানারূপ লোভ-লালসা চরিতার্থ করায়। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ একজন মুক্তিযোদ্ধার দ্বারা এমন অপবিত্র হবে তা কেউ ভাবতে পেরেছে বলেও মনে হয় না। পরাজিত পাকিস্তানি দোসরেরা জীবনে এদেশে রাজসম্মান লাভ করলো। মরণেও পেল রাজধানীর হৃদয় বলে খ্যাত মহান জাতীয় সংসদ চত্ত্বরে কবরে ঠাঁই। জিয়ার জীবদ্দশাতেই শাহ আজিজুর রহমান এবং খান এ সবুর সংসদ ভবন এলাকায় সমাধিস্থ হয়। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হলো অপমানিত। তবে, কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধা অবশ্য জিয়ার দলেও জুটে গিয়েছিল। এরা সমবেত হয়েছিল আওয়ামী বিদ্বেষ প্রসূত মনোভাব নিয়ে- আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার সংকল্প নিয়ে। যেমন তারা বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানাও মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। সময়ের ব্যবধানে ইতিহাস কথা বলে ওঠে- কথায় বলে ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’।

আজ ইতিহাস তার সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছে বললে খুব বেশি বলা হবে না। বরং এক অবিনাশী সত্যকথনই হয়ে উঠবে তা। বাংলাদেশ আজ সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছে। এই পথেই এগিয়ে যাচ্ছে সম্মুখের পানে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ আবার সরব হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ এর প্রেরণা আজ ধারণ করেছে নতুন প্রজন্মের লাখো কোটি তরুণ। আশা করা যায়, ইতিহাসের এ পথরেখা থেকে এই প্রজন্মের কোনো তরুণের বিচ্যুতি ঘটবে না। এই প্রজন্ম ইতিহাসের এক অমোঘ দায় মেটানোর ভার কাঁধে নিয়েছেন- তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দেশি-বিদেশি সকলের শাস্তির বিষয়ে সোচ্চার। কিন্তু কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তরুণ প্রজন্মের সেই আহ্বান উপেক্ষা করে চলছে। ফলে, আশা করা যায় এসব রাজনৈতিক দল যে কোনো সময়েই তার অস্তিত্ব হারিয়ে ইতিহাস হয়ে যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের প্রশ্রয় দানকারীদের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্যের কোনো স্থান আছে বলে আমাদের জানা নেই। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীর বিচার মেনে নিয়ে এবং এর পক্ষে দাঁড়িয়ে এদেশের তরুণদের সম্মুখে সৎরাজনীতির দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য এদেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এক উদাত্ত আহ্বান থাকলো। সজীব ওয়াজেদ জয় সম্প্রতি জাতীয় যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন সেখানে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থানকারী রাজনৈতিক দলসমূহের পক্ষ থেকে সাড়া আসা উচিৎ। কারণ, দেশকে এগিয়ে নিতে চাইলে, আধুনিক জাতি গঠন করতে চাইলে একটি আদর্শগত ঐক্য সম্পন্ন দলসমূহ এক ব্যানারে কাজ করতে পারলে জাতির মঙ্গল, জাতীয় মঙ্গল।

এবারের ডিসেম্বর আমাদের সামনে সেরূপ এক অঙ্গীকার নিয়ে সমাগত। বিজয়ের এই মাসে আমরা বলতে পারি প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীর অন্তত কয়েক জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এই স্বস্তি নিয়ে বিজয়ের মাস, এই স্বস্তি নিয়ে এবারের বিজয় দিবসের উদযাপন। একই সাথে আমাদের কামনা থাকবে- ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী এবং তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতারা সহসাই নিশ্চিহ্ন হবে। তরুণ প্রজন্ম যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে- সেহেতু প্রত্যয়ের সাথেই বলা যায় বাঙালির জীবনে ইতিহাসের আর বিচ্যুতি ঘটবে না। সত্য এক ইতিহাসের পাটাতনে দাঁড়িয়ে এক সত্যনিষ্ঠ জাতি গঠিত হয়ে আগামী দিনের পৃথিবীতে নেতৃত্ব দান করবে সে আশা আমাদের সকল তরুণের অন্তরে অন্তরে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন