আফজাল আলীর মৃত্যু এবং মঈন-ফখরুদ্দীদের বিদায় ঘণ্টা
আফজাল আলী একজন রিকশাচালক। শিক্ষার্থীদের এক হল থেকে অন্য হল, এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে বহন করে জীবিকা নির্বাহ করে। হাজারো কষ্ট জীবনে থাকলেও কারো কাছে হাত পাতেননি কখনো। ১/১১-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। ২০০৭ সালের ১৬ই জুলাই মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ২২শে আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে নৃশংসভাবে নিহত হন রিকশাচালক আফজাল আলী। কিন্তু সেই স্মৃতিটাও আমরা কেউ ধরে রাখিনি। আমি রিকশাচালক আফজাল আলীর কথাই বলছি আজ।
২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই বিএনপি-জামায়াত নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পুর্নবাসন শুরু করে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হাওয়াভবন, স্বজনপ্রীতি, বাংলা ভাইয়ের সৃষ্টি, জঙ্গি উত্থান, ভুয়া ভোটার বানানো, গনতন্ত্র হত্যা সহ সব কিছুই করেছে। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট জনসভায় গ্রেনেড হামলাসহ সমাজে যত বীভৎস অসভ্যতা আছে কোনটিই করতে বাদ রাখেনি। নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য যখনই আওয়ামী লীগ উদ্যোগ নিয়েছে সেটিকে কলুষিত, কলঙ্কিত ও ষড়যন্ত্রে পরিপূর্ণতা দিয়েছে বিএনপি। ভুয়া ভোটার বানিয়ে ২০০৭ সালের বাইশে ডিসেম্বর আবার বিএনপি একা একা নির্বাচন করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলার মানুষ সেটি মেনে নেয়নি। প্রতিবাদ করেছে। শত শত লাশ পড়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। অবশেষে সৃষ্টি হয় সেনাপরিবেষ্টিত ১/১১।
উচ্চাভিলাষী ফখরুদ্দীন মঈন উদ্দিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় না হেঁটে রাজনীতিকে কবর দেওয়ার জন্য মাইনাস ফর্মুলা যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মিথ্যে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় শেখ হাসিনাকে। চলে সারাদেশের মানুষের উপর দুর্বিষহ নির্যাতন। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে অলিখিতভাবে কারফিউ দিয়ে ক্যু-করার ফর্মুলায় এগিয়ে যায়।
২০০৭ সাল ২০ আগস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করে সেনা সদস্যরা। খবরটি যথারীতি সারাদেশে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বাদ যায়নি মুক্তি আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কুখ্যাত পাকিস্তানীরা যখন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করে। তখন সারা বাংলার মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। ঠিক সেইসময়ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক অধ্যাপক ড.জোহা পাকিস্তানি সেনাদের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করতে বাধা দেওয়ায় নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করেছিল। পাকিস্তানিদের হাতে এই নৃশংস মৃত্যু বাংলার মানুষ মেনে নেয়নি। ঘটেছে সারা বাংলায় গণঅভ্যুত্থান। মুক্তি পেয়েছিল বঙ্গবন্ধু। এই হত্যাই পাকিস্তানি সরকারের ভিত ভেঙ্গে চুরে চুরমার করে দিয়েছিল।
শিক্ষার্থী উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে একুশে আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মৌন মিছিল হয়। এদিকে অবৈধ সরকারের উপর ক্ষোভ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচেকানাচে। টানটান উত্তেজনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর এবং বাহিরে। ২২ শে আগস্ট ২০০৭, ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট ডাকে। বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই ধর্মঘটকে সমর্থন করে এবং যে যার মত প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবজায়গা ছাত্র ছাত্রীরা মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের লেলিয়ে দেয়া প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। চলছে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এগারটা থেকে সাড়ে এগারোটা তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছি। খবর এলো পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মারা গেছেন। অসংখ্য ছাত্রলীগ কর্মী, সাংবাদিক, সাধারণ শিক্ষার্থী ও অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠনের কর্মীরা আহত হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের বিস্ফোরণ কেমন ছিল চোখে দেখিনি? ইতিহাস থেকে জেনেছি। কিন্তু সেদিনের সেই বিস্ফোরণ, সেদিনের সেই অভ্যুত্থান চোখ দিয়ে দেখেছি। মাঠে কর্মী হিসেবে ভূমিকায় ছিলাম। আবার কেউ কেউ বলছে একজন ছাত্রকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। আন্দোলন যেন গণ আন্দোলনে রূপ নিল। ছাত্র-শিক্ষক, হত্যা যেই হোক। গণ-আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু কন্যার দৃঢ় মনোবলে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডই অবৈধ সেনাসমর্থিত সরকারের পতনকে বেগবান করেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের জের ধরেই সেনাসমর্থিত সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠেছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অবস্থা বেগতিক দেখে বিকেলের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ এবং সকল হল খালি করে দেয়ার ঘোষণা আসলো। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক লায়লা আরজুমান মানু ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ইলিয়াস হোসেন স্যারের ফোন থেকে জানতে পারি নিহত রিক্সাচালকের গ্রামের বাড়ি নীলফামারি জেলায়। ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে খোঁজ নেয়ারও কোনো উপায় ছিল না। এক পর্যায়ে জানতে পেরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম। সেখানে ময়না তদন্ত চলছিল। মেডিকেলে গিয়ে একজন মহিলার সাথে দেখা হলো। তিনি জানালেন যে লোকটা মারা গেছে তার নাম আফজাল। আমার মেসে থাকতো, আমার বাড়িও নীলফামারী। সে কিছু তথ্য দিল। আফজাল আলী নীলফামারী থেকে ২১শে আগস্ট রাজশাহীতে এসেছে রিকশা চালাতে। আর ২২ তারিখে এই ঘটনা। আফজাল আলীকে গুলি করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলের সামনে। পরিতাপের বিষয়, আফজাল আলীর রিকশায় ছিল একজন আহত শিক্ষার্থী। সেই আহত শিক্ষার্থীকে হয়তো হাসপাতালে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল আফজাল আলী। কি ভাগ্য! নিজেই পুলিশের গুলিতে নিহত।
কয়েক বন্ধুসহ কারফিউয়ের মধ্যে মেসে ফিরে এসেছিলাম। সেসময়ের ভীতিকর পরিস্থিতির কথা বলে বুঝানো কঠিন। এক অজানা আশঙ্কায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী শিক্ষার্থীদের মেস ও রাস্তায় বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। এর মধ্যে যুক্ত হলো রাতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের আগমন এবং অকথ্য ভাষায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। অবস্থা বেগতিক দেখে ভোরে লুঙ্গি পড়ে স্টেশনে গিয়ে পুলিশ-সেনাবাহিনীর ধাওয়া ও নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে ফেরত আসতে হলো। সে সময় যান চলাচলও বন্ধ থাকায় হেঁটে-ভ্যানে- রিক্সায় করে নাটোরে এসে ট্রেন ধরে বাড়িতে পৌঁছলাম।
লাশটি পৌঁছানোর খবর শুনে দেখতে গিয়েছিলাম। লাশটি ময়না তদন্তের একদির পর রাত বারোটায় পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। লাশটির দুর্গন্ধ উঠেছিল। গুলি বাম চোখ ভেদ করে মগজ বের হয়েছিল। দাফন সেরে বাসায় ফিরে তখন থেকে এখন পর্যন্ত চিন্তা করি- লাশটির কারণে তৎকালীন ইতিহাসের অনেক কিছুই পরিবর্তন হলো। কিন্তু আফজাল আলীর পরিবারের দুর্বিষহ জীবনের খোঁজ আমরা কেউই রাখলাম না।
কেমন আছেন সেই হারিয়ে যাওয়া সৈনিকের পরিবার- এই বোধ থেকেই গত বছর তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁর সেই বাড়িটি আর নেই। সন্তান-স্ত্রীরাও অভাবের কারণে একেকজন একেক জায়গায় থাকছে। শুধু কি তাই? সেই আফজাল ভাইয়ের কবরও চিহ্নিত করতে পারছে না কেউ। ধার-দেনা করে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল স্ত্রী। সেটি পরিশোধ করতে দালালের মাধ্যমে সম্ভবত সৌদি আরব পাড়ি দিয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার সময় দশ মাসের সন্তান পারুলকে পাওয়া গেলো নানীর বাড়িতে। মামার বাসায় কাজ করে। বাবার নাম বাদে কিছু মনে করতে পারে না। আর নানীও এগুলো মনে রেখে কষ্ট দিতে চান না। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো- মৃত্যুর পর একবার কেউ কিছু চাল-ডাল পাঠিয়েছিলো। পরে আর কেউ খোঁজ নেয়নি।
সেদিনের সেই আফজাল আলী, লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরেছে। সাথে সাথে ভিটেবাড়ি হারিয়েছে। হারিয়েছে সাজানো সংসারটি। দুখিনী মা শুধু দু’চোখ দিয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছে ছেলের কথা মনে করে। সেদিনের সেই আফজাল আলী আজকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেলেও আমরা তাঁকে স্মরণ করতে চাই। পুলিশের গুলিতে নৃশংসভাবে নিহত আফজাল আলীর অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত মেয়ে পারুলের আকুতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন তাকে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয় আর একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বও কিন্তু কম নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিৎ আফজাল আলীর রক্তের ঋণ পরিশোধ করা। আফজালের জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সেনা সমর্থিত সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষা পেয়েছিল। লাশটির জন্যই হয়তো জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলন জোরালো হয়েছিল। অবশেষে মুক্তি। সেই লাশটির কাছে আমাদের অনেক ঋণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে বিনীত অনুরোধ এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ান। জানি, আপনার কাছে এই খবর পৌঁছামাত্রই আপনি সকল রকম সহযোগিতা করবেন। আপনি ছাড়া কেউ খবর রাখে না এদের। পরিশেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলব, যে লাশের উপর দাঁড়িয়ে আজকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করছে, দয়া করে সেই আফজাল আলীর রক্তের ঋণ পরিশোধ করুন। না হলে ইতিহাস কাউকে ছাড়বে না।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক গণিত বিভাগ, সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও পরিচালক, বঙ্গবন্ধু চর্চাকেন্দ্র বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগ।
এইচআর/জিকেএস