বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে জানতেন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সপরিবারে শহীদ হওয়ার আগে থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের খবর পেয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনে আন্দোলন-সংগ্রাম ও কারাবরণের সময়ও কিছু বাঙালির স্বার্থপরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা কতটা সংকট সৃষ্টি করেছিল, তার অনুপুঙ্খ হদিসও জানতেন। তিনি কারাগারে থাকার সময় জওহরলাল নেহরুর The Discovery of India, Glimpses of World History বই দুটি পড়েছিলেন। অন্য সময় আলবেরুনির ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থটিও পাঠ করেছিলেন।
এ ছাড়া তিনি দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে ছিলেন সচেতন। এ জন্য ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার দাবিনামা পেশ করে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলে তার অনুভাবনায় আসে বাঙালির চরিত্রকথন- ‘বাংলাদেশ শুধু কিছু বেইমান ও বিশ্বাসঘাতকের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করল। আমরা সাধারণত মীর জাফর আলী খাঁর কথাই বলে থাকি। কিন্তু এর আগেও ১৫৭৬ সালে বাংলার স্বাধীন রাজা ছিল দাউদ কারানী। দাউদ কারানীর উজির শ্রীহরি বিক্রম-আদিত্য এবং সেনাপতি কাদলু লোহানী বেইমানি করে মোগলদের দলে যোগদান করে। রাজমাবাদের যুদ্ধে দাউদ কারানীকে পরাজিত, বন্দি ও হত্যা করে বাংলাদেশ মোগলদের হাতে তুলে দেয়।
এর পরও বহু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এই বাঙালি জাত। একে অন্যের সঙ্গে গোলমাল করে বিদেশি প্রভুকে ডেকে এনেছে লোভের বশবর্তী হয়ে। মীরজাফর আনল ইংরেজকে, সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করল বিশ্বাসঘাতকতা করে। ইংরেজের বিরুদ্ধে এই বাঙালিরাই প্রথম জীবন দিয়ে সংগ্রাম শুরু করে; সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয় ব্যারাকপুর থেকে। আবার বাংলাদেশে লোকের অভাব হয় না ইংরেজকে সাহায্য করার। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত এই মাটির ছেলেদের ধরিয়ে দিয়ে ফাঁসি দিয়েছে এ দেশের লোকেরাই সামান্য টাকা বা প্রমোশনের জন্য।
পাকিস্তান হওয়ার পরও দালালি করার লোকের অভাব হলো না, যারা সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে দিয়ে দিচ্ছে সামান্য লোভে। বাংলার স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করছে, তাদের বুকে গুলি করতে বা কারাগারে বন্দি করতে এই দেশে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অভাব হয়নি। এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ এত উর্বর; এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আবার পরগাছা আর আগাছাও বেশি জন্মে। জানি না বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে এই সোনার দেশকে বাঁচানো যাবে কিনা!’ (২০ জুন ১৯৬৬)
বাঙালি ‘পরশ্রীকাতর’, বাঙালি ‘বিশ্বাসঘাতক ও বেইমান’-এর প্রমাণ আছে খুনিচক্রের আচরণে। যেমন ১৯৭৫ সালের ২ আগস্ট পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা বাহিনীর ইনচার্জ হিসেবে ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে মেজর ফারুক নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করত। আত্মস্বীকৃত খুনি বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে সে কথা স্বীকার করেছে। এ ছাড়া খুনি ক্যাপ্টেন হুদা, ডালিম এবং নূরও ধানমন্ডির বাসায় যাতায়াত করত। ক্যাপ্টেন হুদা মাঝেমধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ডিউটি ফোর্স দেখাশোনার জন্য যেত। মেজর নূর শেখ কামালের বন্ধু হিসেবে সেই বাড়িতে উপস্থিত হতো। মেজর ডালিম অনেকবার বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পরিচিত, তার গৃহে যাতায়াতকারী এসব ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধু যাকে তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেছেন সেই মোশতাক জাতির পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ফল পাওয়ার আগেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর তাজউদ্দীন আহমদ সরে যাওয়ার পর সেই সুযোগ প্রসারিত হয়। মোশতাক ১৯৭৩ সালের শুরুতেই ক্ষমতা আরোহণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় থেকে পুরোদমে ষড়যন্ত্র করে শক্তিশালী চক্র গড়ে তোলে।
১৯৭৫ সালের মার্চে অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার পর পাঁচ মাসে সফলতা আসে। মেজর রশিদ এই পাঁচ মাসে সেনাবাহিনীর মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়ে, মিথ্যাচার করে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করে। ঠাণ্ডা মাথায় মেজর রশিদ সফল হয় তার গুটির চালে। জিয়া নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে চললেও তার সম্পৃক্ততা ছিল ষড়যন্ত্রে। আগামাসি লেনের বাসার ছাদে মুজিববিরোধী মিটিং করে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বোস্টার। কুমিল্লার বার্ড, গাজীপুর শালনা হাইস্কুল, দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ, দশপাড়া গ্রামের বাড়িতে রশিদ, ফারুক, অন্যান্য সেনা অফিসার মিলিত হয়ে ভবিষ্যতের ১৫ আগস্ট সম্পন্ন করেছিল।
আমরা জানি, বঙ্গবন্ধুর মতো সাহস এ দেশে আর কারও মধ্যে দেখা যায়নি। ফাঁসির মঞ্চ থেকে তিনি একাধিকবার ফিরে এসেছেন, আপস না করে। এ জন্য বাংলার মানুষ তার নেতৃত্বে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। সারাদেশের মানুষের সমর্থন ছিল বলেই পাকিস্তানি শাসকরা মুজিবকে ভয় পেত। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা ও হয়রানি নিত্যসঙ্গী হয়েছিল তার। ছয় দফা আন্দোলনের সময় ছাত্ররা যুক্ত হয়ে তার নেতৃত্বকে আরও মজবুত করেছিল।
ক্রমান্বয়ে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারকে উৎখাত করার জন্য আন্দোলন বেগবান করেন বঙ্গবন্ধু। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মুজিব জনগণের রায়ে বারবার নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। তার আপসহীন নেতৃত্ব আর সাহসী পদক্ষেপ আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছিল। একইভাবে সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিপুল সমস্যার আবর্তে পড়েও দিশাহারা হননি কখনো। মানুষকে তিনি বড় বেশি বিশ্বাস করতেন, বড় বেশি সারল্যে মাখা ছিল তার ব্যক্তিজীবন।
একদিকে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা, অন্যদিকে দেশের উন্নয়ন ও মানুষের অগ্রগতির চিন্তায় উন্মুখ বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্রষ্টা। আসলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন- নানা ঐতিহাসিক ঘটনা ও ইতিহাস-সংলগ্নতায় আকর্ষণীয়। একজন অসাধারণ রাজনৈতিক সংগঠক, এক অনলবর্ষী বক্তা এবং অঙ্গীকারদীপ্ত সাধনায় নিবেদিত এই অসাধারণ মানুষটি তার লক্ষ্যকে স্থির করে সারাজীবন কাজ করে গেছেন। এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালির শত-সহস্র বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে বিবিসির জরিপে গণমানুষের ভোটে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে হত্যাকাণ্ডের পর ভীতসন্ত্রস্ত খুনিরা রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তাকে মুছে ফেলার জন্য তড়িঘড়ি জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় কবরস্থ করে। ৩২ নম্বর থেকে জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় তাকে পাঠানো হলো ঠিকই, কিন্তু জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব আরও বেশি প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়ে উঠলেন। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা, বাংলার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাসহ সব সুকৃতি। বাংলাদেশের আরেক নাম শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ খুনি ও বিশ্বাসঘাতকরা জয়ী হতে পারেনি। তারা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
লেখক : ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস