বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন: ধর্মনিরপেক্ষতার বাংলাদেশ
আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। আজ বাঙালি জাতির শোকের দিন। আজকের এ দিনে বাঙালি জাতি হারিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে রাজধানী ঢাকায় সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। যার নির্দেশে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা। সেই তাকেই কি না জীবন দিতে হলো এ দেশেরই কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে, যা ছিল কল্পনারও অতীত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি ও বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে কালজয়ী নাম। বিশ্ববাঙালির গর্ব-মৃত্যুঞ্জয়ী মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। জাতীয় জীবনে তার আদর্শের বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তার প্রতি সত্যিকার সম্মান জানানো সম্ভব। যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আমরা হারিয়ে ফেলতে বসেছি, সেই নেতাকে দেখে বিশ্ব দিয়েছিল অভূতপূর্ব কিছু বিশেষণ। তাকে নিয়ে কিউবার প্রখ্যাত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে উল্লেখ করেছিল ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ নামে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা মন্তব্য করেছিল- ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।’ তাই তার আদর্শ ও নীতিকে কোনভাবেই আমরা ভুলতে পারি না।
তিনি বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছুটে বেড়িয়ে বাঙালির কাছে পৌঁছে দেন পরাধীনতার শিকল ভাঙার মন্ত্র। সে মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে স্বাধীন দেশে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল। তাঁর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে।
বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি, তেমনি ছিলেন একজন প্রকৃত মুসলমান। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের কর্মপ্রয়াস ছিল বাংলার জনগণের শোষণ ও মুক্তির অন্বেষণ। বড় বিচিত্র, বর্ণাঢ্য আর কীর্তিতে ভরা তার সারাটা জীবন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদার চেতনার অধিকারী একজন খাঁটি ঈমানদার মুসলমান। তিনি কখনও ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন নি।
বাংলাদেশকে সকল ধর্মের সকল মানুষের জন্য শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালীন শাসনামলে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণার্থে গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামোগত পদক্ষেপ যেমন ছিল, তেমনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের বিষয়াদি বিবেচনায় রেখে তিনি ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গ্রহণ করেছিলেন বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানা ব্যবস্থা। তিনি যেমন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, তেমনি বাংলাদেশে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের প্রচার-প্রসারের স্থপতিও তিনি। এ দু’টি অনন্য সাধারণ অনুষঙ্গ বঙ্গবন্ধুর জীবনকে দান করেছে প্রোজ্জ্বল মহিমা।
ইসলামের চিরন্তন মানব কল্যাণকামী বৈশিষ্ট্য ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন ভাষণে মহানবী (সা.)-এর ইসলামের সুমহান শিক্ষা, অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আপোষহীন অবস্থান, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা ও মোনাফেকির বিরুদ্ধে ধর্মের শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি তার সুদৃঢ় অঙ্গীকার বাস্তবায়নের নিরলস প্রচেষ্টার কথা সব সময় বঙ্গবন্ধু ব্যক্ত করতেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য-স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর রমনার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না।...এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয়ভাবে সব মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার উৎস ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রবর্তিত মদীনা সনদের সেই মহান অতুলনীয় শিক্ষা, যেখানে উল্লেখযোগ্য শর্ত ছিল- ‘মদীনায় ইহুদি-খ্রিস্টান, পৌত্তলিক এবং মুসলমান সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।’
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতেও ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী। তিনি বলেছিলেন- ‘...আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’
১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর পুনরায় জাতীয় সংসদে তিনি বলেন: ‘জনাব স্পীকার সাহেব, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাবিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয় নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি’।
ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি আর এই নীতিকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি চেয়েছিলেন প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। পূর্ণ নিরপেক্ষতা ছাড়া পক্ষপাতহীন ন্যায় বিচার করা যে সম্ভব নয় তা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন।
স্বাধীনতার এতটি বছর পরও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে এক শ্রেণির মানুষ এখনও বিরোধিতা করে আসছেন। এইতো গত ৩ জুলাই ২০২১ সংসদের অধিবেশনে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকার সমালোচনা করেছিলেন। কোরআনে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা নেই বলে তিনি দাবি করেছিলেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখা সাংষর্ষিক বলেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেতা হারুনের বক্তব্যের কড়া জবাব দেন। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গটি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য বলেছেন, কোরআন শরিফে নাকি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা নেই। আমি বলবো অবশ্যই আছে। আমাদের নবী করিম (সা.) বলেছেন, অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হতে। তিনি এই শিক্ষা দিয়েছেন। আমাদের কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম সব ধর্মের মর্যাদা দেয়। কোরআন শরিফে আছে “লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন” অর্থাৎ যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। যার যার মতামত সে সে প্রকাশ করবেন। এটা প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতাই আসে। যতই তিনি (এমপি হারুনুর রশিদ) অস্বীকার করুন, যেভাবেই তিনি ব্যাখ্যা দেন। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। যুগ যুগ ধরে এটা চলছে। হ্যাঁ অবশ্যই নিজের ধর্ম পালনে সব সময় গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল থাকতে হবে। এটা আমাদের শিক্ষা। এটা নবী করিম (সা.) সব সময় বলে গেছেন। কাজেই এ ধরনের কথা সংসদে না বলাটাই ভালো।’ (বাংলা ট্রিবিউন) চমৎকারভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবারো স্পষ্ট করলেন বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমাদের প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা যেন পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং নীতি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলেই রাষ্ট্র ও দেশ হবে সুখি, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ।
এইচআর/জিকেএস