ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নর্দমায় কে ছুঁড়লো আমাদের ভবিষ্যৎ?

প্রকাশিত: ০৬:১৩ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫

অবাধ তথ্য প্রবাহ, প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং মিডিয়ার স্বপ্রণোদিত ভূমিকায় দেশ বিদেশের বিরাজমান পরিস্থিতি, ঘটনা, দুর্ঘটনা এখন আমরা গণমাধ্যমে সরাসরি দেখতে পাই। গত মঙ্গলবার বিকেলে সুয়্যারেজের ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা থাকার কারণে পাঁচ বছরের শিশু নীরব চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। তার আগে গত বছরের ছাব্বিশ ডিসেম্বর শিশু জিহাদের মৃত্যু হয়েছিলো ঠিক একইভাবে। আমাদের জাতীয় জীবনে ‘রানা প্লাজা’ ধ্বসের ঘটনাটি এমনই একটি দুর্যোগপূর্ণ ঘটনা যা দেখে সারা পৃথিবীর মানুষ হতবাক, নির্বাক এবং স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে দেখতে হয়েছে শত শত পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত, চাপা পড়া খণ্ডিত দেহ। মনে পড়ে এক মহিলা গার্মেন্টস কর্মীর ভবনের নিচে আটকে পরা এবং তার করুণ মৃত্যু দৃশ্য।

মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কবলিত নীরবের মৃত্যুর করুণ দৃশ্যটি সরাসরি দেখাচ্ছিল কয়েকটি গণমাধ্যম। বারবার মনে হচ্ছিলো সময়কে অবহেলা করা হচ্ছে। খুব দ্রুত কেন হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে না শিশুটিকে, গুরুত্ব পাচ্ছে না তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ । চারদিকের আবেগপ্রবণ মানুষগুলো অসচেতনভাবে জীবন বাঁচানোর মূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেলছে। কালক্ষেপণ হচ্ছে অযাচিত, অতি উৎসাহী মানুষের ভিড়ে এবং চাপে। জীবন বাঁচানোর তাগিদের চেয়ে সবাই কেমন যেন প্রদর্শনী এবং মিডিয়া কাভারেজে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। অনেকে হয়তো এ সময় কোনো কাজেই আসছেন না। কিন্তু অযথা ভীড় করে শিশুটির জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছেন। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে সময়মত জীবন বাঁচানোর তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের। কিছু করতে না পারলে পথ রোধ করা একেবারেই উচিত নয়। কিভাবে মৃত্যু ঘটে যাচ্ছে তার চাইতে কিভাবে জীবন রক্ষা করা যাবে, সে বিষয়টিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিৎ। জরুরি অবস্থায় জীবন রক্ষা করাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানবিকতা প্রদর্শন নয়। মানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে বড় ধর্ম আর কি হতে পারে?

উদ্ধারের পর যে লোকটির কোলে শিশুটি নিস্তেজ ও নিথর হয়ে পড়েছিল সে লোকটি কেন ক্যামেরার সামনে এতোটা সময় ব্যয় করলেন? তিনি কি তাহলে জানতেন যে শিশুটির আগেই মৃত্যু হয়েছে? হাসপাতালে নেবার আগেই তারা কেনইবা ভেবে নিলেন যে শিশুটির মৃত্যুই হয়েছে? চারঘণ্টা ধরে যখন শিশুটিকে উদ্ধারের জন্যে তৎপরতা চালানো হচ্ছিলো তখন একজন ডাক্তারকে কেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত রাখা হলোনা? কেন হাসপাতাল থেকে জীবন রক্ষাকারী জরুরি বহনযোগ্য যন্ত্রাদি উপস্থিত রাখা হলোনা? এমনতো  হতে পারতো যে উদ্ধারের পরও ছেলেটি অনেকক্ষণ বেঁচেছিল? উদ্ধারকারী, সমব্যথী মানুষ এবং মিডিয়া কর্মীরা কি জানতেন না যে মুহূর্তের সঠিক সিদ্ধান্ত একটি জীবনকে বাঁচিয়ে দিতে পারে? যেন এক কঠিন শাস্তি, চোখের সামনে ধীরে ধীরে জীবন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু উদ্ধার করার কোনো উপায় নেই, রক্ষা করার কোনো পথও খোলা নেই। এমন দুর্ঘটনাগুলো যদি শুধুই কারো অবহেলা বা অসতর্কতার কারণে হয়ে থাকে, তাহলে দণ্ডিতকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলালে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় বটে কিন্তু তাতে নিশ্ছিদ্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত অসতর্কতার নির্দিষ্ট মূল কারণটি চিহ্নিত না করা হয়। এবং তা প্রতিকারের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা না করা হয়। অন্যথায় সমস্যাটির পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা থেকে যায়। যদি প্রতীকারের ব্যবস্থ্যা না করা হয়, তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হবে। জিহাদ নামের শিশুটির করুণ মৃত্যুর পর যদি শহরের উন্মুক্ত ম্যানহোল গুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো তাহলে কি শিশু নীরব চিরকালের জন্যে নীরব হয়ে যেতো?

গত কিছুদিন আগে মাননীয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুক, ভাইবারসহ আরো কয়েকটি মাধ্যম বন্ধ করা প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে বলেছিলেন ‘‘ফেইসবুকের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশী, তাই জনস্বার্থে সাময়িক কয়েকটি দিনের জন্য আপাতত ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছে’’। কথাটি একজন প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের মুখ থেকে শুনে খুব ভালো লেগেছিল। সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে । অন্তত ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন বা যাবেন’- এ ধরনের উক্তি থেকে আমরা সাধারণ মানুষেরা হয়তো মুক্তি পেয়েছি।

উন্নত অনেক দেশে পথে চলতে গিয়ে পথের ত্রুটির কারণে পথচারী আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা অঙ্গহানি হলে জরিমানা হয়। পথচারী উপযুক্ত প্রমাণ দিতে পারলে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেয়া হয় বিশাল পরিমাণের অর্থ। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো আইন এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত প্রণয়ন হয়নি। তবে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো হয়েও যাবে একদিন। যদিও জীবনের ক্ষতি অর্থ বা অন্যকিছু দিয়ে পূরণ করা যায় না।

দুর্যোগগুলো যখন নিরুপায় হয়ে দেখতে হয়, তখন মনে হতে থাকে যে ঠিক কী কারণে এই দুর্যোগগুলো ঘটে গেলো এবং কি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ঘটনা গুলো নাও ঘটতে পারতো। ঘটনাটির ঘটার পেছনের কারণগুলো কী ছিল, আর দুর্ঘটনাটির জন্যে দায়ী ব্যক্তিটি কে ছিলেন, ঘটনা পরবর্তীতে জীবন রক্ষার্থে কি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিলো, এই প্রশ্নগুলো যে কোনো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত জরুরি বিষয়। কারণ এখন আমরা দেখতে পাই যে শুধু উদ্ধারকারীগণই নয়, সাধারণ মানুষও আবেগ প্রবণ হয়ে মানুষের জীবন রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। তাই এ দুর্যোগ ব্যবস্থা মোকাবেলা করার জন্য উদ্ধারকারী আসার আগেই সাধারণ জনগণ যেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনা নিতে পারে সে জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা। আর এ কাজটি সফলভাবে করতে পারে আমাদের গণমাধ্যমগুলো।

দেখা যায় যে নির্ধারিত উদ্ধারকর্মীগণ হাজির হওয়ার আগেই অনেক জীবনের চির অবসান হয়ে যায়। তাই নির্ধারিত কর্মী ছাড়াও সাধারণ স্বেচ্ছাসেবী গণমানুষকে সতর্ক হতে হবে দুর্যোগটি ব্যবস্থাপনার আগ পর্যন্ত এই ঝুঁকিপূর্ণ জটিল সময়টুকুতে তারা যেন উদ্ধার কাজে সহায়ক হতে পারে। যেন ডাক্তার আসার পূর্বেই রোগীটি মারা না যায় সে জন্য  আঘাতপ্রাপ্ত পথচারীর রক্তক্ষরণটা কিভাবে থামাতে হয় সে প্রাথমিক চিকিৎসার কৌশলগুলো সাধারণ মানুষের জানতে হবে। ‘‘জাজ দি সিচুয়েশন এন্ড টেক প্রপার কাউণ্টার একশন’’- এটি এয়ারলাইন্সের জরুরি অবতরণে নিরাপদে যাত্রী বহির্গমনের একটি নীতি যা জরুরি অবস্থায় সিচুয়েশন বুঝে তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়ে থাকে। এ কথাটি বার বার মনে পড়ছিল যখন নীরব নামের পাঁচ বছরের শিশুটির নিস্তেজ দেহের মিডিয়া ফটোসেশন এবং ভিডিওসেশন চলছিলো।

লেখক : আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স এর ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রশিক্ষক, স্বেচ্ছাসেবী সমাজ কর্মী, এক্টিভিস্ট, সুবিধাবঞ্চিত  নারী শিশু, প্রতিবন্ধী এবং থার্ড জেন্ডার

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন