ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ভারতকে ভয় দেখাতেই তালেবানের সঙ্গে চীনের দোস্তি?

বিভুরঞ্জন সরকার | প্রকাশিত: ০৯:৪৩ এএম, ০৩ আগস্ট ২০২১

দীর্ঘ ২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ বিষয়টি নিশ্চিত করার পর থেকেই আফগানিস্তানে সশস্ত্র তালেবান গোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েছে তারা আফগানিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে সরিয়ে নিজেরা ক্ষমতা দখলের জন্য ‘যুদ্ধ’ শুরু করেছে এবং জুলাই মাসের মধ্যেই দেশটির অর্ধেকেরও বেশি জেলা তাদের দখলে গেছে বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। আবার সাড়ে ১৩ হাজার তালেবান সদস্যকে হত্যার দাবি করেছে আফগান সরকার। আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা তালেবানদের দখলে গেলে দেশটির অবস্থা কি হবে এবং আশেপাশের দেশগুলোসহ বিশ্বরাজনীতিতেই বা তার কি প্রভাব পড়বে তা নিয়ে নানামুখী আলাপ-আলেচনা চলছে। দখলকৃত এলাকায় কঠোর ইসলামি বিধিবিধান কার্যকর করার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। সব ধরনের আধুনিক চিন্তাধারা ও ব্যবস্থার বিরোধী হিসেবেই তালেবানরা পরিচিতি অর্জন করেছে।

জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে দুদিনের জন্য আফগান তালেবান গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রধান মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে দুদিনের চীন সফর করেছেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে তালিবান প্রতিনিধিদের আলোচনা যে ‘সফল' হয়েছে তা উভয় পক্ষ থেকেই স্বীকার করা হয়েছে। উভয় পক্ষ পরস্পরকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। তালেবান মুখপাত্র মো. নায়েমকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, আফগান প্রতিনিধি দল চীনকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, আফগানিস্তানের মাটি থেকে কাউকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেবে না। চীনের উইঘোর মুসলিম বিদ্রোহীদের তালপবানরা কোনোভাবেই সহযোগিতা বা উৎসাহিত করবে না। আফগানিস্তানে নতুন চীনা বিনিয়োগকেও স্বাগত জানানো হবে। অন্যদিকে আফগানিস্তানের ব্যাপারে চীনও নাক গলাবে না।

জানা যায়, পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে বেশ কিছুদিন ধরেই চীন-তালেবানের যোগাযোগের চেষ্টা চলছে । এ ধরনের দূতিয়ালিতে পাকিস্তান বরাবরই ওস্তাদ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দূতিয়ালিতেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের চীন সফর সম্ভব হয়েছিল। তবে পাকিস্তান-চীন-আমেরিকার সম্মিলিত চেষ্টায়ও বাংলাদেশের বিজয় ঠেকিয়া রাখা যায়নি। এবার পাকিস্তান-চীন এবং মুসলিম বিশ্ব তালেবান গোষ্ঠীর ক্ষমতা নিশ্চিতে কতটা সম্ভব হয়, দেখার বিষয় সেটাই। মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তান এমন একটি রাষ্ট্র যে কিনা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতেও দ্বিধা করে না।

এই প্রথম শীর্ষ পর্যায়ের কোনো তালেবান নেতা চীন সফর করলেন। এমন এক সময়ে তালেবান প্রতিনিধি দল চীন সফর করেছেন , যার মাত্র কিছুদিন আগেই চীনের সীমান্তবর্তী আফগান প্রদেশ বাদাকশানের গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলো কব্জা করেছে তালেবানরা। চীন-তালেবান নেতৃত্বের এ বৈঠকের চার দিন আগে ওয়াং ইর সঙ্গে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশিরও একটি বৈঠক হয়। এরপর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে করতে চীন-পাকিস্তান যৌথভাবে কাজ করবে। লক্ষণীয়, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে জো বাইডেনের ঘোষণার পর আফগানিস্তান নিয়ে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলো সবাই কমবেশি অনিশ্চয়তায় ভুগছে। আর সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছে চীন।

আফগান ভূখণ্ড থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী বিদায় নেওয়ার পর দেশটি যে ফের তালেবান যোদ্ধাবাহিনীর দখলে চলে যাবে, তার লক্ষণ ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানের নতুন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে কার কি ধরনের দেনদরবার হবে, এ নিয়ে শুরু হয়েছে ভূরাজনীতির এক নতুন খেলা। আর এ খেলায় শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে উঠে আসছে নতুন এক অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন। চীনের এই উৎসাহ ও তৎপরতা স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। আর এতেই তালেবান-পাকিস্তান-চীনের গাঁটছড়া বাধা ভারতের জন্য একই সঙ্গে উদ্বেগ ও শিরঃপীড়ার কারণ।
যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানকে তাদের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পে যুক্ত করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে চীন। সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের ওপর চীনের লোভ রয়েছে বলেও মনে করেন অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক। তারা বলছেন, চীন নীরবেই আফগানিস্তানে তাদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপরতা শুরু করেছে। দেশটি ইতোমধ্যেই চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে আফগানিস্তানকেও যুক্ত করার কথা বলছে। তবে অন্য একটি পক্ষ বলছে, মধ্য এশিয়ায় ঢোকার জন্য বা তাদের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য আফগানিস্তানকে চীনের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। পাকিস্তান এবং ইরানের সঙ্গে চুক্তি করে তারা সে লক্ষ্য আগেই পূরণ করছে। এখন চীনের প্রধান চিন্তা, আফগানিস্তানে যে কোনো ধরনের অরাজকতা পাকিস্তান এবং ইরানে তাদের হাজার কোটি ডলারের প্রকল্পকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে কিনা।

নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়েও চীনের দুশ্চিন্তা আছে। কারণ আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের যে ৯০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, তার ঠিক ওপারেই উইঘোর মুসলিম অধ্যুষিত চীনা প্রদেশ জিনজিয়াং। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, উইঘোর অঞ্চলে সক্রিয় ইসলামি আন্দোলন বা এটিম-এর তিন হাজার সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে, যাদের সঙ্গে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে তৎপর বেশ কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে। এ কারণে তালেবানদের চীন বলছে, তাদের বৈধতা চীন মেনে নেবে, আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে সাহায্য করবে, কিন্তু বিনিময়ে এটিমসহ অন্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।

গ্লোবাল টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, মোল্লাহ বারাদার বৈঠকে অঙ্গীকার করেছেন, আফগান ভূমি ব্যবহার করে চীনের বিরুদ্ধে কাউকে কোনো তৎপরতা চালাতে দেবে না তালেবানরা। এছাড়া অনেক বিশ্লেষকও মনে করেন, ২০ বছর আগে আল কায়দাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া তালেবানের তুলনায় এখনকার তালেবানরা অনেক বাস্তববাদী। তারা হয়তো আর হঠকারিতার পথে হাঁটবে না। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে মদদ দিয়ে ক্ষমতায় সহজ হবে না । কারণ এসবের পক্ষে বাইরের শক্তির সমর্থন পাওয়া কঠিন। তাই নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য মস্কোতে গিয়েও রাশিয়ার সঙ্গে তালেবান প্রতিনিধিরা কথা বলেছেন বলে জানা যাচ্ছে ।

তারা শিয়াপন্থি ইরানের সঙ্গে কথা বলেছে এবং ইরানের সমর্থন সহানুভূতি আদায়ে সক্ষম হয়েছে। তালেবান নিয়ে চীনের ভরসা হয়তো সেখানেই। আরেকটি ভরসার কারণ বড় মিত্র পাকিস্তানের প্রভাব। একই সঙ্গে, তালেবানরাও বুঝতে পারছে, গদিতে টিকে থাকতে হলে তাদের বিপুল টাকাকড়ি দরকার হবে। বর্তমান বিশ্বে সেই টাকা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র চীনের। ফলে চীনের আস্থা অর্জন ছাড়া তাদের সামনে ভালো বিকল্পও খোলা আছে বলে মনে হয় না ।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘটনায় বেশি উদ্বেগে রয়েছে ভারত। সম্প্রতি হঠাৎ করে আফগানিস্তানে কর্মরত কূটনীতিকদের ভারতে ফিরিয়ে আনার ঘটনার মধ্যেই তার প্রতিফলন দেখা গেছে। হেরাত, জালালাবাদ এবং মাজার-ই-শরীফে ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এখনো বন্ধ করা না হলেও, সেগুলোতে কাজকর্ম কার্যত স্থগিত হয়ে গেছে। এ ঘটনার দিনকয়েক আগেই ভারতীয় সহায়তায় নির্মিতব্য একটি বাঁধে তালেবান হামলায় কমপক্ষে ১০ নিরাপত্তা রক্ষীর মৃত্যু হয়। ওই বাঁধের পেছনে ৩০ কোটি ডলার খরচ করছে ভারত।

এছাড়া গত জুনে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও বলা হয়, মার্কিন সেনা ফিরিয়ে নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই কাবুলে সরকার পতন নিশ্চিত করবে তালেবানরা। তালেবানরা আবার ক্ষমতা নিলে ভারতেরই যে ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি এটা যেকোনো বিশ্লেষক-গবেষকদেরই নজরের বাইরে নেই। বিগত দুই দশকে সেদেশে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। তবে এসবের বাইরেও মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢোকার উদ্দেশ্যে ভারতের জন্য আফগানিস্তান এখন খুবই জরুরি। দেশটির বুকের ওপর দিয়েই ইরান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে দুটি পাইপলাইন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। তাছাড়া কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে এবং লাদাখ নিয়ে চীনের সঙ্গে বিপজ্জনক দ্বন্দ্বে রয়েছে ভারত। এখন আফগানিস্তান নতুন আরেকটি শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হলে সেটি বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে নয়াদিল্লির জন্য। আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা নীতির নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব যদি পাকিস্তান কব্জা করতে পারে, তাহলে সেটা তা হবে ভারতের জন্য আরেকটি বড় বিপদ। কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরিতা নতুন নয়।

ভারত কি তবে দর্শকের আসনে বসে শুধুই খেলা দেখছে? তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে? তা নিশ্চয়ই নয়। তলে তলে তারাই নিশ্চয়ই ঘুঁটি সাজাচ্ছে এবং কোথাকার জল কোথায় গিয়ে থিতু হয় তা দেখছে। গত মাসে দুবার দোহায় গিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। গত সপ্তাহে মস্কো যাওয়ার পথে তেহরানেও নামেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, তিনি যখন ওই দুটি দেশে গেছেন, তখন নিজেদের পৃথক এজেন্ডা নিয়ে তালেবান নেতারাও সেখানে অবস্থান করছিলেন। প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি কাকতালীয়? নাকি পরিকল্পনারই অংশ? তালেবানের সঙ্গে কোনো মীমাংসা নয়- প্রকাশ্যে এই নীতি নিলেও তালেবানের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের চেষ্টা ভারতের চলছে না, তা কে নিশ্চিত করে বলতে পারে?

আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করলে সেটা বাংলাদেশের জন্যও কম দুশ্চিন্তার কারণ নয়। পাকিস্তান সব সময় জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক। এরমধ্যেই নতুন করে কয়েক হাজার পাকিস্তানি আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। আফগান-পাকিস্তান হয়েই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ এসেছে। আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান – এমন স্লোগান প্রকাশ্য রাজপথে যারা দিয়েছে তাদের শিকড় কি আমরা মূল থেকে উৎপাটনে সক্ষম হয়েছি? আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থানকে দূরের ঘটনা হিসেবে না দেখে তার গতিপ্রকৃতি আমাদেরও যেন শ্যেনদৃষ্টিতেই থাকে। পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজ। এক জায়গার আগুন বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগে না।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/এমকেএইচ