ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অর্থ রফতানির উদ্বেগ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ০৩:৩২ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০১৫

বাংলাদেশ থেকে অনেক কিছু বাইরে যায়। পোশাক রফতানিতো আমরা বিপ্লব করেছি। সনাতনী পণ্য হিসেবে আরো কত কি যায়। সবই করি অর্থের জন্য। কিন্তু এবার সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠে এলো সেই অর্থেরই নাম। দেশ থেকে পণ্য যত যায় তার চেয়ে বেশি যায় হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ।

বলা হচ্ছে বিদেশে অর্থপাচারে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২১ নম্বরে। এই অবস্থান তৈরি হয়েছে ২০১৩ সালের হিসাবে। ওই বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। গত ১০ বছরে পাচার হওয়া অর্থের গড় হিসাবে বাংলাদেশের এই নেতিবাচক অবস্থান ২৬তম। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য উদ্ধৃত করে বৃহস্পতিবার দেশের গণমাধ্যম এই খবর প্রচার করার পর থেকেই সবার চোখ কপালে উঠেছে।

সুশাসনের এক অনন্য নজির এই অর্থ পাচার। আমাদের কাছে এমন সময় এই খবর এলো যখন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং (ভিত্তি) ও নদীশাসনের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এই সেতু প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকসহ দাতা দেশ আর সংস্থার কত অপমানজনক কথাই দেশকে শুনতে হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে ২০১৩ সালেই এদেশ থেকে তিনটি পদ্মা সেতুর টাকা বাইরে পাচার হয়ে গেছে।   

বিশ্বব্যাপী অর্থপাচার বাড়লেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের পরিমাণ বেড়ে গেছে সবচেয়ে বেশি। কারণ কী? একটি বড় কারণ যারা টাকা বাইরে রফতানি (পাচার) করছেন তারা রফতানি যোগ্য কোনো শিল্পে কেন এই টাকা খাটাননি? আসলে দেশে বিনিয়োগের যে পরিস্থিতি, সেটা কারো কাছেই সন্তোষজনক নয়। একটা দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশে লেগেই আছে। গত কয়েক বছরে অস্থিরতার সাথে যোগ হয়েছে চরম সহিংসতা আর দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এখানে দুর্নীতি কমছে না, বরং বাড়ছে। বিনিয়োগকারীদের পদে পদে হয়রানি হতে হয়। এসব কারণে যাদের হাতে অর্থ উদ্বৃত্ত আছে, তারা দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করছে।

রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং আর আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মূলত দেশ থেকে অর্থপাচার হয়। দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই, অথচ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ছে। এটি অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক। বিনিয়োগ না হলে মূলধনী যন্ত্রপাতি যায় কোথায়? কোনো ব্যবসায়ী ১০ টাকার পণ্য আমদানির কথা বলে দাম দেখায় ৫০ টাকা। সেখানে ৪০ টাকা পাচার করে। আবার যে ব্যবসায়ী ১০ টাকার পণ্য রফতানি করে, সে দেখায় ছয় টাকা। এখানে চার টাকা পাচার করে। এভাবেই দেশ থেকে অর্থপাচার হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় কি করছে তা সত্যি ভাবনার বিষয়।

দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়, দেশে বিনিয়োগের আস্থা নেই। আন্ডার আর ওভার ইনভয়েসিং-এর খেলায় অর্থ চলে যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। গত দশ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাজেটের দেড়গুণ!

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবছর যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেখানে শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির কথা থাকে। বেশ ক’বছর ধরেই বিষয়টি আলোচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সংশ্লিষ্টরা কি একবারও অনুসন্ধানে নেমেছেন যে আসলে হচ্ছেটা কী? অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিলে অর্থ পাচারের হার এভাবে বেড়ে যেতোনা। অর্থ পাচারের একটি দিক আমরা আলোচনায় বলেছি যে, বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য বা সেবা আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং এবং রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানির মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে থাকে।

কিন্তু অনেকেই মনে করছেন রাজনৈতিকভাবে ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকাও চলে যাচ্ছে কানাডার বেগম পাড়াসহ পৃথিবীর নানা দেশে। মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশিদের জন্য ওই দেশের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কাউকে কোনো প্রকার অনুমোদন দেয়া না হলেও বাংলাদেশের এত বিনিয়োগকারী কোন নিয়মে সে দেশে বিনিয়োগ করলেন?

একথা বুঝতে বড় অর্থনীতিবাদ বা পণ্ডিত হতে হয় না যে সুশাসন নেই বলেই এমনটা হচ্ছে। দুর্নীতি বাড়লে অর্থ পাচার বাড়ে। কাজেই দেশে দুর্নীতি রোধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। দেশে নেই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। সর্বত্র একটা আস্থার সংকট। পরিবেশ আর আস্থা না থাকায় যাদের হাতে অর্থ আছে তারা বিকল্প বিনিযোগ যোগ্য জায়গা খুঁজছেন। বাংলাদেশের বেশ ক’টি বড় গ্রুপ এর মধ্যেই মিয়ানমার, কম্বোডিয়াসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে বিনিয়োগ করেছেন বলে খবর হচ্ছে গণমাধ্যমে।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় আস্থার সংকট বাড়ছে। দেশে নাগরিকদের নিরাপত্তা কাঙ্খিত পর্যায়ে না থাকায় একটা উদ্বেগ আর শংকা থাকছে সবসময়। ফলে যাদের সামর্থ্য আছে বিদেশে জমি বাড়ি ও সম্পদ কেনার তারা সেই সুযোগ নিচ্ছেন।

বিনিয়োগের সুযোগ নেই, তাই এক লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়, আবার হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে বাইরে। এক কঠিন বাস্তবটা আমাদের অর্থনীতির জন্য। পুঁজি বিনিয়োগ চায়, নিরাপত্তা চায়। দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে অর্থ কি আর বসে থাকবে? পণ্য রফতানির বদলে সে নিজেই রফতানি হয়ে যাবে।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন