বুকের ভেতর ঘৃণার আগুন
১৯৭১ সালের মে মাসের ৫ তারিখ বিকেলবেলা পিরোজপুরের বলেশ্বর নদের ঘাটে পাকিস্তান মিলিটারি আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। পুলিশ প্রশাসনের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা হিসেবে শুধু আমার বাবাকেই নয়, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা হিসেবে আব্দুর রাজ্জাক এবং মিজানুর রহমানকেও একই সঙ্গে গুলি করে তাদের সবার মৃতদেহ বলেশ্বর নদে ফেলে দিয়েছিল। পিরোজপুরের নদীতে জোয়ার-ভাটা হয়, তাই এই তিনজন হতভাগ্য মানুষের মৃতদেহ দিনে দু’বার জোয়ারের পানিতে উত্তরে যাচ্ছিল এবং ভাটার টানে দক্ষিণে নেমে আসছিল। তিন দিন পর আমার বাবার মৃতদেহ কাছাকাছি একটা গ্রামে নদী তীরে এসে আটকে গিয়েছিল। গ্রামের মানুষেরা আমার বাবাকে চিনত, তাদের মনে হলো, ‘আহা, এই মৃতদেহটি মাটি চাইছে।’ তাই তারা ধরাধরি করে আমার বাবার মৃতদেহটি তুলে নদী তীরে কবর দিয়ে দিল। অন্য দু’জনের সেই সৌভাগ্য (!) হয়নি এবং তাদের মৃতদেহ শেষ পর্যন্ত নদীতে ভেসে হারিয়ে গিয়েছিল।
১৯৭১ সালে সেটি এমন কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘাঁটি গেড়েছে এ রকম যেকোনো জায়গার আশপাশে যেকোনো নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকলেই দেখা যেত নদীতে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান মিলিটারি এই দেশের মানুষকে নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে। মানুষ হয়ে মানুষকে এত অবলীলায় এবং এত নিষ্ঠুরতায় হত্যা করা যায়, সেটি আমরা আগে কখনো কল্পনা পর্যন্ত করতে পারিনি। একজন মানুষ যখন ঘর থেকে বের হতো সে আবার ঘরে ফিরে আসবে কি না, সেই বিষয়টি নিয়ে তার আপনজনেরা কখনো নিশ্চিন্ত হতে পারত না।
মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবাই মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে বলেছেন। তারা যদি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে থাকতেন তাহলে এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে মানুষকে বিশ্বাস করার কথা বলতে পারতেন কি না, আমি নিশ্চিত নই। ১৯৭১ সালে এই দেশে পাকিস্তান মিলিটারি যে ভয়ংকর তাণ্ডব এবং হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, সেটি দেখে আমাদের প্রজন্ম পাকিস্তান নামক দেশটির মানুষ নামক প্রজাতির ওপর বিশ্বাস চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছিল। অন্যদের কথা জানি না, এত দিন পরেও আমি এখনো একজন পাকিস্তানের মানুষকে দেখলে তার ভেতরে এক ধরনের দানবকে খুঁজে পাই।
পবিত্র কোরআন শরিফে লেখা আছে, মানুষ যখন বেহেশতে যাবে তখন তার বুকের ভেতর থেকে সকল প্রতিহিংসা সরিয়ে দেওয়া হবে। কথাটি অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়, এই পৃথিবীতেই যদি একজন মানুষ তার বুকের ভেতর থেকে সব প্রতিহংসা দূর করতে পারে তাহলে পৃথিবীটাই তার কাছে বেহেশত হয়ে যেতে পারে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি আমাদের দেশে যে ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতন চালিয়েছে, সেটি আমি নিজের চোখে দেখেছি এবং সে কারণে আমার বুকের ভেতর এই রাষ্ট্রটির জন্যে যে তীব্র ঘৃণা এবং প্রতিহিংসার জন্ম হয়েছে, আমি কোনো দিন তা থেকে মুক্তি পাব না। এই রক্তলোলুপ ভয়ংকর দানবদের কারণে পৃথিবীটা আমার জন্যে কখনো বেহেশত হতে পারবে না। সব সময়ই সেই দেশটি এবং সেই দেশের দানবদের জন্যে আমার বুকে ঘৃণা এবং প্রতিহিংসার আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকবে।
অথচ পাকিস্তান নামক দেশটি রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে জানিয়েছে যে, ১৯৭১ সালে তারা আমাদের দেশে কোনো গণহত্যা করেনি, এই দেশের মানুষের ওপর কোনো নির্যাতন করেনি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ নামে দুজন যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে তারা এই বিচিত্র ঘোষণাটি দিয়েছে। আমরা যতটুকু জানি, তারা এর চাইতেও অনেক বেশি জানে যে, ১৯৭১ সালে তারা এই দেশে ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। আমি বেশ কয়েক বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নামে ছোট একটি পুস্তিকা লিখেছিলাম। এই পুস্তিকার তথ্যসূত্রগুলোর বেশির ভাগ দিয়েছিলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের লেখা বই থেকে। তারা নিজেরাই সেখানে স্বীকার করেছে যে, এই দেশে তারা ভয়ংকর গণহত্যা করেছে, তারপরও যখন পাকিস্তান সরকার এখনো ‘জানে না’ যে ১৯৭১ সালে এই দেশে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তখন বুঝেই নিতে হবে ‘ডাল মে কুচ কালা হায়’। এই দেশের অনেক মানুষ পাকিস্তানের এই নির্জলা মিথ্যা কথা শুনে ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। আমি ক্রুদ্ধ হইনি এবং অবাকও হইনি। আমরা যারা আমাদের জীবনের একটা অংশ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে কাটিয়েছি এবং নিজের চোখে ১৯৭১ দেখেছি, তারা খুব ভালো করে জানি এটি হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম পাকিস্তানি কর্মকাণ্ড। যেখানে সত্য ভাষণ করা হলে লাভ হয় সেখানেও এই রাষ্ট্রটি মিথ্যাচার করে। এই দেশের ইতিহাস হচ্ছে মিলিটারি জেনারেলদের ইতিহাস। এই দেশের সবচেয়ে সম্মানী মানুষ সেই দেশের নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী আব্দুল কাদির খান পৃথিবীর চোখে একজন আন্তর্জাতিক অপরাধী। এই দেশে মেয়েরা লেখাপড়া করতে চাইলে তাদের মাথায় গুলি করা হয়। এই দেশটির জন্যে যার বুকের ভেতরেই যতটুকু ভালোবাসা থাকুক না কেন আমার বুকের ভেতর বিন্দুমাত্র ভালোবাসা কিংবা সম্মানবোধ নেই। বিদেশ যাওয়ার সময় প্লেন যখন পাকিস্তানের ওপর দিয়ে উড়ে যায় আমি তখন অশুচি অনুভব করি।
দুই.
১৯৭১ সালে জীবন বাঁচানোর জন্যে আমাকে দেশের আনাচকানাচে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। আমার বয়সি কিংবা আমার চাইতে ছোট কিশোর তরুণেরাও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে পাকিস্তান মিলিটারির সাথে বীরের মতো যুদ্ধ করেছে। আমাদের মতো মানুষেরা যারা অবরুদ্ধ পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলাম, তাদেরকে পাকিস্তান মিলিটারির সব রকম পৈশাচিক নির্মমতা নিজের চোখে দেখতে হয়েছে। মনে আছে একদিন গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ করে এক দল পাকিস্তানি মিলিশিয়ার মুখোমুখি হয়ে গেলাম। আমার চোখের সামনে তারা একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ল। বাড়ির ভেতর থেকে পুরুষ মানুষটি কোনোভাবে প্রাণ নিয়ে বের হয়ে এসে আমার সামনে থর থর করে কাঁপতে থাকল এবং আমি বাড়ির ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শুনতে পেলাম। যখন নিজের স্ত্রীকে একদল পাকিস্তানি মিলিশিয়া ধর্ষণ করতে থাকে তখন সেই স্ত্রীর আর্তনাদ শুনতে থাকা স্বামীর চোখে যে ভয়াবহ শূন্য একধরনের দৃষ্টি থাকে সেটি যারা দেখেছে তারা কখনো ভুলতে পারে না। আমিও পারিনি, কখনো পারব না।
এই অবস্থায় স্ত্রীটির মতো বাংলাদেশে আরো তিন থেকে চার লাখ মহিলা এই পাশবিক নির্যাতন সহ্য করেছে। রেপঅবনানকিং নামে আইরিশ চ্যাং এর লেখা একটি অসাধারণ বই আছে, যে বইটিতে নানকিংয়ের অধিবাসীদের ওপর জাপানিদের অমানুষিক নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এই বইটিকে একটা ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই বইয়ের শুরুতে আইরিশ চ্যাং লিখেছেন, নানকিংয়ে নারী ধর্ষণের যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল তার সাথে তুলনা হতে পারে শুধু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি মিলিটারিদের দিয়ে বাংলাদেশের নারীদের ধর্ষণ।
সারা পৃথিবীর ইতিহাসে পাকিস্তানি মিলিটারির এই ভয়ংকর নির্যাতনের একটি জ্বলন্ত ইতিহাস থাকার পরও পাকিস্তান সরকারের সাহস আছে সেই সত্যটিকে অস্বীকার করার! এই রাষ্ট্রটিকে যদি আমরা ঘৃণা না করি তাহলে আমরা কাকে ঘৃণা করব?
তিন.
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দানবদের হাতে যারা আমার মতো আপনজনদের হারিয়েছেন তাদের বুকের ক্ষত কখনো শুকিয়ে যাবে না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কিংবা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মতো যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে তাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ কার্যকর করার পর শহীদদের আপনজনেরা হয়তো খানিকটা হলেও শান্তি পাবেন। ফাঁসির রায় কার্যকর করার পর এই দেশের কোনো মানুষের মুখ থেকে এতটুকু সমবেদনার কথা শোনা যায়নি কিন্তু পাকিস্তানের মানুষদের হাহাকার শুরু হয়ে গিয়েছিল! যারা একাত্তর দেখেনি কিংবা যাদের ভেতরে যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল পাকিস্তানের হাহাকার শুনে তাদের সব সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। আসমা জাহাঙ্গীর খুব সঠিকভাবেই বলেছেন, সৌদি আরবে যখন প্রায় রুটিন মাফিক পাকিস্তানি অপরাধীদের মাথা কেটে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তখন একটিবারও পাকিস্তান সরকার সেই সব হতভাগ্যদের জন্যে বিন্দুমাত্র দরদ দেখায় না, কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় নিয়ে বিচার করে যখন বাংলাদেশি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর করা হয় তখন হঠাৎ করে তাদের দরদ উথলে পড়ে!
১৯৭১ সালে পাকিস্তান এই দেশে কোনো গণহত্যা ঘটায়নি বা কোনো যুদ্ধাপরাধ করেনি- এই নির্জলা মিথ্যা কথাটি বলার সাথে সাথে তারা বাংলাদেশের সাথে ‘ভাই’ এবং বন্ধুর মতো সুসম্পর্ক তৈরি করা নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলেছে। দুই দেশের জনগণ পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে দুই ভাইয়ের মতো ভবিষ্যৎ সম্পর্ক গড়ে তুলবে এরকম আশা প্রকাশ করেছে।
বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। বাংলাদেশের মানুষের পাকিস্তান নামক দেশটির জন্যে কোনো ভালোবাসা থাকার কথা নয়। তারা বড়জোর এই দেশটিকে সহ্য করবে যদি তারা নতজানু হয়ে তাদের সব অপরাধের কথা স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চায়। যেহেতু তাদের ভেতরে আমরা সেরকম কিছু দেখতে পাচ্ছি না তাহলে পাকিস্তান নামক এই রাষ্ট্রটির সাথে কোনো একধরনের সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তাটুকু কী? চুয়াল্লিশ বছর পরে হলেও আমরা আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশকে গ্লানিমুক্ত করার চেষ্টা করছি। এ জন্যে এই সরকারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আরো পরিষ্কার করে বলতে হলে বলব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং সাহসের জন্যে তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞার শেষ নেই। চুয়াল্লিশ বছর পর হলেও আমরা যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারি তাহলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির কৃতকর্মের জন্যে তাদের বিচার কেন করতে পারি না? এই দেশের সাথে আমাদের কোনো একটা সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন কোথায়?
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ফোরাম যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিটিকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছিল। (তারা যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কথা বলতে এসেছিলেন তখন একটা চত্বরে প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডার একটা করে গাছ লাগিয়েছিলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই চত্বরটির নাম সেক্টর কমান্ডার চত্বর।) সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সদস্যরা এখন নতুন করে একটা দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে! আমার মনে হয় এটি একটি অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি। ১৯৭১ সালে আমরা যারা পাকিস্তান মিলিটারির হাতে আমাদের আপনজনকে হারিয়েছিলাম আমাদের ক্ষোভ একশ গুণ বেড়ে যায় যখন আমরা দেখি সেই হত্যাকারী দেশ আস্ফালন করে ঘোষণা করে তারা কোনো দোষ করেনি! আমাদের আপনজনেরা তাহলে খুন হলো কেমন করে, নদীর পানিতে তাদের মৃতদেহ ভেসে বেড়ালো কেমন করে?
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সাথে আমি কখনো সরাসরি কথা বলতে পারব না। যদি পারতাম তাহলে আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতাম, ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষের ওপর যে নৃশংস তাণ্ডব চালিয়ে গণহত্যা করেছ, সেই অপরাধের জন্যে আমরা তোমাকে কখনো ক্ষমা করিনি। তোমাদের এত বড় দুঃসাহস, এত দিন পর তোমরা সেটি অস্বীকার কর?
আমাদের বুকের ভেতর যে ঘৃণার আগুন জ্বলছে তোমরা তার তাপ সহ্য করতে পারবে না। ১৯৭১ সালে আমরা তোমাদের দূর করে দিয়েছি।
তোমরা দূরেই থেকো, আমাদের কাছে এসো না।
লেখক : মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এআরএস/আরআইপি