ফিলিস্তিনিদের ওপর অন্যায় অত্যাচার ও কিছু কথা
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের অব্যাহত বিমান হামলা দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২২০ ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৬৩টি শিশুও রয়েছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর যে অন্যায় অত্যাচার করা হচ্ছে তা কোনভাবেই আমরা মেনে নিতে পারি না।
বিশ্বের যেদিকে তাকাই শুধু অশান্তি, রক্তপাত আর হানাহানি। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বিশ্বের কোথাও না কোথাও রক্তপাতের ঘটনার সংবাদ পাওয়াই যায়। সমগ্র পৃথিবীতেই যেন এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। আজ মুসলিম জাহানের অবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যায়, তাদের অবস্থা কোন পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছে। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মাঝে নেই কোন ঐক্য। মহানবীর শিক্ষা আজ আমরা ভুলে বসেছি। যেখানে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার সমগ্র উম্মাহ একটি দেহের ন্যায়। যদি সেই দেহের কোন একটি অঙ্গ ব্যথা পায়,তাহলে তার ব্যথায় সারা শরীর ব্যথিত হয়।’ (মুসলিম) অথচ আজ ফিলিস্তিনি মুসলিম ভাইদের রক্ত ঝড়ছে, নিষ্পাপ শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে আর বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দ নীরব ভূমিকা পালন করছেন।
একদিকে মুসলমানদের মাঝে এক্য নেই, অপরদিকে কিছু ক্ষমতাধর মুসলিম রাষ্ট্রের আবার প্রকাশ্য ও গোপন সখ্যতা রাখে ইসরাইলের সাথে। তবে একটা বিষয়ে খুবই আশ্বস্ত আর তা হলো ইসরাইলের বা ইহুদিদের ধরা খাওয়ার সময় সন্নিকট। কাদের হাতে খাবে এটা ভিন্ন কথা। কারণ পবিত্র কোরআনে আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে বলা হয়েছে ইসরাইল জাতিগোষ্টি বা ইহুদিদেরকে আবার ফিলিস্তিনে একত্রিত করা হবে। তারপর তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। বলা হয়েছে- ‘এরপর আমি বনী ইসরাঈলকে বললাম, তোমরা এই প্রতিশ্রুত দেশে বাস কর।
এরপর যখন পরবর্তীকালের (আযাবের) প্রতিশ্রুতি (বাস্তবায়িত হওয়ার সময়) আসবে, তখন তোমাদের সবাইকে বিভিন্ন জাতি হতে গুটিয়ে নিয়ে আসবো। (সুরা বনী ইসরাইল: ১০৪)
২ নভেম্বর ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে এ প্রতিশ্রুতির প্রথম অংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। দেশান্তরিত ও ভবঘুরে ইহুদিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসে ইসরাইলে একত্রিত হয়েছে। এখন দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ তাদের চূড়ান্ত ধ্বংসের বাস্তবায়নের পালা। আর এটাও হবে। হওয়াটা নিশ্চিত। সেই সময় আসবে কিন্তু এই যে বছরের পর বছর ধরে নিষ্পাপ শিশু ও নিরিহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে তা আমাদের সহ্যের বাহিরে।
ইতিহাস থেকে দেখা যায় ইহুদীরা পূর্বেও কয়েক বার বড় বড় শাস্তির সম্মুখিন হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৭ অব্দে বিবিলিয়নের বাদশা নেবুচাদনেজার এর মাধ্যমে, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট টাইটাসের মাধ্যমে আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের মাধ্যমে। আবারো হয়তো তাদের জন্য বড় কোন শাস্তি আসবে। কেননা পবিত্র কোরআনের যেহেতু এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি রয়েছে আর সেই দিনের জন্য আমরা অপেক্ষাও করছি।
তবে এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় নিষ্পাপ শিশু ও নিরীহ মানুষ যে প্রাণ হারাচ্ছে এর দায় কে নিবে? সমগ্র বিশ্বে আজ মাজহাবের ফেরে মরছে সাধারণ নিরীহ মানুষ। আজ পাকিস্তানে যেমন সুন্নিরা আক্রান্ত হচ্ছে শিয়াদের দ্বারা শিয়ারা আক্রান্ত হচ্ছে সুন্নিদের দ্বারা আবার আহমদিয়া সদস্যরাও সেখানে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাকিস্তানে আজ এমন কোনো দিন অতিবাহিত হয় না যেখানে মাজহাবের ফেরে ডজন খানেক লোককে প্রাণ না হারাতে হয়।
এছাড়া ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ বিশ্বের বহু দেশে কেবল মাত্র এই মাজহাবের কারণে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাতে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। চালানো হচ্ছে নিরীহ নিরপরাধ অবোধ শিশুদের ওপর একের পর এক বর্বরোচিত হামলা। সম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে নির্যাতন এর মূলেও কিন্তু মাজহাব। ফিলিস্তিনি শিশুরা প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে। এসব শিশুদের একটিই প্রশ্ন ‘কেন তারা বিশ্বের অন্যান্য শিশুদের মতো বাঁচতে পারবে না, তাদের একটাই আকুতি, আমাদের কি দোষ, আমাদেরকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দাও’।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনি এক শিশুর কান্নার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ভিডিওতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডিল ইস্ট আইকে ছোট্ট নাদিন কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘কী করব আমি, বলুন? ওই ধ্বংসস্তুপ সরাবো? আমার সত্যিই ভয় করছে। আমার স্বজনদের জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। কিন্তু কী করা উচিত এখন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই যাতে লোককে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু এখন কিছুই করতে পারছি না।’
তাকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘আমি যখনই এসব দেখি, আমার কান্না পায়।
শুধু ভাবি, কেন আমাদের ওপরেই হামলা হচ্ছে? বাড়ির লোকেরা বলে, আমরা মুসলিম বলে ওরা আমাদের ঘৃণা করে। এখানে এত শিশু থাকে। কেন শিশুদের ওপর বোমাবর্ষণ করছে ওরা? এটা অনুচিত।’ আসলে শিশুদের তো কোন মাজহাব বা ধর্ম নেই। সব শিশুই জন্মগ্রহণ করেন এক অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তার উম্মত হিসেবে কিন্তু পরবর্তিতে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে একেক জন ভিন্ন ভিন্ন মত-পথ অনুসরণ করে।
বেশ অনেক বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বে চলছে মাজহাবি যুদ্ধ। ওয়াহাবী আর সুন্নিরা আক্রমণ চালাচ্ছে শিয়াদের ওপর। ইয়েমেনের রাজধানী সানায় যুদ্ধবিমান থেকে একের পর এক বোমাবর্ষণও তখন প্রায় করা হত আর এতে প্রাণ হারাত শতশত ইয়েমেনি মুসলমান। যেহেতু সৌদি আরবের অর্থের কোনো সমস্যা নেই তাই সৌদি আরবের সাথে মিসর, জর্ডান, মরক্কো, সুদান, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশকে একাত্মতা ঘোষণা করতেও আমরা দেখেছি।
অপর দিকে ইয়েমেনে হামলায় সৌদি আরবকে অস্ত্রপাতি সরবরাহ ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এক মুসলমান ভাই অপর মুসলমানের আঘাতে মড়ছে আর এর জন্য সহায়তাও করছে অপর মুসলিম দেশ। এ ধরণের বিষয়গুলো আমাদেরকে অনেক ভাবিয়ে তুলে। জেরুজালেম আল আকসা মসজিদ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য পবিত্র স্থান। এটি রক্ষায় বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে অবশ্যই দরদ থাকার কথা এবং ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানোর কথা। কিন্তু বাহ্যত আমরা তা প্রত্যক্ষ করছি না। তাই ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের বিকল্প নেই। যেভাবেই হোক মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে।
এইচআর/এএসএম