ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও আর ভয় পায় না

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ১৫ মে ২০২১

সৈয়দ ইফতেখার

ঈদ উদযাপন করলাম আমরা। গ্রামে গ্রামে, মফস্বলে মফস্বলে, শহরে শহরে নানাভাবে স্বাস্থ্যবিধি ভেঙেছে। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যেখানে চোখ রাঙাচ্ছে সেখানে আমরা দিব্যি আনন্দ করছি। আনন্দে দোষ নেই, ত্রুটি হলো সচেতনতা না থাকায়। আর কবে আমরা সচেতন হবো, সেটাই এখন হাজার কোটি টাকার প্রশ্ন।

একটা সত্য ঘটনা বলি, অনেকেই জানেন। এই তো কদিন আগের পরিস্থিতি, ভারতের নয়াদিল্লির একাধিক হাসপাতালে কোভিড রোগীদের ছটফট দশা। রোগীর আত্মীয়দের হাহাকার। জায়গা হয়নি বেডে, মেঝেতেও। বারান্দাও ফাঁকা নেই। উঠান আর হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তাই তখন শেষ ভরসা। চিকিৎসক আসেন, সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড সেবা দেন, আবার কখনও আসেনও না। শ্বাস নিতে না পারা রোগী, ধুঁকতে ধুঁকতে গণমাধ্যমে বলেন, ‘শ্বাস লেনে মে দিক্কাত হো রাহিহে, কুছ কারতা হি নেহি এ লোগ’, অর্থাৎ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু ডাক্তাররা কিছু করছেই না! চিকিৎসা না পেয়ে, অক্সিজেন না পেয়ে রোগীর মৃত্যু হয়েছে বহু। কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য। এখনও পরিস্থিতি খুব একটা ভালো হয়নি। এই তো কদিন আগে বিহার, উত্তরপ্রদেশে গঙ্গায় ভেসে এসেছে শতাধিক মরদেহ। পশ্চিমবঙ্গেও ভয়ানক অবস্থা। করোনায় মৃতদের সৎকারে হাঁপিয়ে উঠেছে পুরো ভারত। তাই তো তাদের ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে নদীতে। কী করুণ সেই সব দৃশ্য, যারা এর মুখোমুখি হয়েছেন তারাই প্রকৃত অর্থে টের পাচ্ছেন ভয়াবহতা। আমরা তার আগে ব্রাজিলের সংকট দেখেছি, প্রত্যক্ষ করেছি যুক্তরাষ্ট্রে মৃতদেহ হিমঘরে পড়ে থাকার বিষয়টি। করোনায় হাজার হাজার মৃত্যু বলে কথা, আর কত সৎকার করা যায়!

আমাদের দেশেও এমন ভয়াবহতার খণ্ড চিত্র দেখা গেছে। করোনা বাড়লে, মৃত্যু বাড়লে, ‘লাশ পড়ে থাকবে রাস্তায়’ এমন কথা আমরা প্রায়ই বলি। এতোটাও খারাপ পরিস্থিতি হয়নি তবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাজুক দশা দেখা হয়ে গেছে। পত্রপত্রিকার লিড ইমেজে আমরা দেখেছি বিভৎসতা। চট্টগ্রামের সেই ছবি আজও কাঁটা দেয় মনে। অ্যাম্বুলেন্সেই শ্বাস কষ্টে শেষবার শ্বাস ত্যাগ, কিংবা অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু— অনেক ঘটনাই কিন্তু ঘটেছে। ভাগ্য ভালো সেগুলো ভারতের মতো এতোদিন স্থায়ী হয়নি। তবে এবার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সেই শঙ্কা করেছে জোরালো। ইতোমধ্যে দেশের অনেক স্থানেই এটি ছড়িয়েছে। ভারত থেকে এই ভ্যারিয়েন্ট বয়ে এনেছেন এমন কিছু রোগীকে তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কত মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, কত স্থানে গিয়েছেন তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।

ইতোমধ্যে গবেষকরা বলেছেন, চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম সংক্রমণের সময় ‘কোভিড-নাইনটিন’ যতটা শক্তিশালী ছিল, বর্তমানে এটির সংক্রমণ ক্ষমতা কয়েক গুণ বেড়েছে। কারণ বহুবার রূপ বদলে করোনা হয়েছে শক্তিশালী। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যার মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ। চীনের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের শুরুতে প্রাথমিক পর্যায়ে একজন করোনা আক্রান্ত রোগী মাত্র দুই থেকে তিনজনের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারতেন। কিন্তু এখন তা বেড়ে গড়ে বহু গুণ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি। কারণ যত ভ্রমণ, যাতায়াত তত সংক্রমণ।

আমরা সীমান্ত বন্ধ করেও পারিনি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে। আমরা আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ করেও পারিনি ঢাকায় রাখতে মানুষকে। ঈদের আগে ঢাকা ছেড়েছেন ৭০ লাখের মতো মানুষ। আমরা ফেরিঘাটের গাদাগাদি দশা দূর করতে পারিনি। ব্যর্থ হয়েছি গ্রামে, শহরে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে। ঈদ আনন্দে কোভিডের কথা ভুলেই গেছেন সবাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা এতো কিছুতে ব্যর্থ হয়ে, আগামীতে কীভাবে রুখে দেবো সংক্রমণ? ছুটি কাটিয়ে মানুষজন ফিরতে সময় লাগবে। তবুও একটা বড় অংশ ফিরলে কী হবে দশা! কীভাবে আমরা সামাল দেবো পুরো বিষয়টাকে? আগের বারের অর্থাৎ ২০২০ সালের অভিজ্ঞতা আমলে নেইনি আমরা। ২০২১ আবার নতুন করে শুরু করেছি এটাই কাল হচ্ছে না তো!

সংক্রমণ রোধে চলমান লকডাউন বা বিধিনিষেধের মেয়াদ ২৩শে মে পর্যন্ত আছে। প্রয়োজনে তা আরও বাড়বে। এখন পুলিশকে বাড়তি ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। এতেই কি রুখে যাবে মহামারি? পরাজিত হবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট? ভাবনাটা কিন্তু এতো সোজা করে ভাবলে হবে না। এ কথা সত্য, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারের ফলাফলে আমরা ভুগবো জুন মাস থেকে। জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরের পরিকল্পনা হাতে আছে তো?

অক্সিজেন মজুদ বাড়াতে হবে, ইউরোপের দেশগুলো থেকে এ নিয়ে সহায়তা নেয়া যেতে পারে। চীন থেকে গেলো বছর বিশেষজ্ঞ দল এসেছিল, এবারও এমন কিছু করা যায় কিনা তার প্রচেষ্টা চালানো জরুরি। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ এবং সাধারণ বেড বাড়ানোর ব্যবস্থা চাই। করোনা পরীক্ষা এখনও হাতের নাগালে আনা যায়নি, সেটির বন্দোবস্ত করা সময়ের দাবি।

কারণ সার্বিকভাবে শঙ্কার বিষয় হলো, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরেকটি ঢেউয়ের কথা। সেটা মাথায় রেখেই এগোতে হবে। এখন মৃত্যু আবার ৩০-৪০ এর ঘরে নেমেছে। আমরা এপ্রিলে শতাধিক মৃত্যু দেখেছি। তেমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আবার আসবে না এ কথা বলাটা ভুল। কারণ অনেকগুলো ভুল আমরা নাগরিক হিসেবে করেছি। প্রশাসনও নিরুপায় হয়ে তা চেয়ে চেয়ে দেখেছে, সব মিলিয়ে বাঙালির এতো আবেগের খেসারৎ বাকি বটে। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, এ কথাই যেন মিথ্যে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছি আমরা।

এমন বাস্তবতায় এটুকু আশার কথা বলা যায়— ভ্যাকসিন সংকট মোকাবিলায় যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে। যদিও সেখানে বাংলাদেশ কূটনীতি, রাজনীতির শিকার, সে অন্য আলাপ। তবুও শেষ পর্যন্ত টিকা আসুন সেটাই চাই। ১২ কোটি প্রাপ্ত বয়স্ক এ বছরই টিকা পাক। মানুষের বাহুতে গণহারে টিকার সিরিঞ্জ ঢুকুক। বিভিন্ন উৎস থেকে আরও এক কোটি ডোজ টিকা কেনার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই আস্থা রাখতে চাই পুরোদমে। শিগগিরই সেটি আলোর মুখ দেখলে; তৃতীয় ঢেউ সামাল দিতে পারা খানিকটা সহজ হবে। এটাই এখন ঈদের খুশির উপলক্ষ।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

এইচআর/এমকেএইচ