ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পিতা-মাতার অসহায় প্রবীণজীবন ও সন্তানের দায়

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ১২ মে ২০২১

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

পরিবার মানব জীবন-মায়ার সূতিকাগার। সভ্য মানুষ বিবাহের মাধ্যমে পরিবারে গড়ে। শিশুর জন্ম দেয়, লালন পালন করে বড় করে তোলে। এক সময় তারা বয়স্ক হয়, পরিবারে নিজেদের ভূমিকা পালন করে ও প্রাকৃতিক নিয়মে সবাই মরণকে বরণ করে নেয়। জন্ম নিলেই জীবমাত্রেরই একদিন জীবনাবসান হবে। তার এটাই জীবনের ধর্ম।

মানব জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত করার জন্য যুৎসই পরিবেশ প্রয়োজন। একটি সুস্থ-সবল পরিবার সেই ভারসাম্যপূর্ণ সুন্দর ও যুৎসই পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে পারে। যেখানে মানব জীবন সার্বিক নিরাপত্তা খুঁজে পেতে পারে। পারিবারিক নিরাপত্তা থেকে একজন মানুষ সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেকে সুষ্ঠুভাবে বিকশিত করার ভরসা পেয়ে থাকে। সেজন্য বলা হয় পরিবার হচ্ছে সবচে বড় সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

এছাড়া একটি পরিবার হচ্ছে মানুষের আত্মিক বন্ধনের বাহন। নিকটাত্মার আত্মীয়তার বন্ধনে গড়ে উঠে পারস্পরিক আস্থা ও আত্মবিশ্বাস। সন্তান লাভ ও ভালবাসার আবহ পরিবারের মধ্যেই বিকশিত না হলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। ভঙ্গুর সমাজে সামাজিক নিরাপত্তাবোধ বিঘ্নিত হয় এবং মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। ফলত সূচিত হতে থাকে সামাজিক অনাচার ও অপরাধ। এজন্য দেখা যায় পারস্পরিক অবিশ্বাস ও মারামারি, কলহ। এসব কলহও ও ঝগড়া-বিবাদ দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে থাকলে মানবতার বিপর্যয় ঘটে।

পারস্পরিক আস্থা ও আত্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে সভ্য মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে ভালবাসে। দলবদ্ধতা প্রাণিজীবনকে বিশেষ নিরাপত্তা দান করে। এজন্য বন্যপ্রাণিরও পরিবার ও গোত্র আছে। তারা সহজে দলছুট হয় না। বিপদে আপদে এক অপরকে অন্যদের আক্রমণ থেকে আগলে রাখে।

আধুনিক জীবনের মায়াজালে পড়ে বিপদ হয়ে হয়েছে সভ্যতার সেরা জীব মানুষের। তারা সবচেয়ে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান। তাই সারা পৃথিবীতে বিচরণ করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে এই দু’পায়ী জীব। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ পেটের তাগিদে ছুটে বেড়িয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। শিল্পবিপ্লবের অব্যবতিত পরে মানুষের চেতনা ও চাহিদা বিপুল পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় মনের গতিও বহুগুণ বেড়ে যায়। এজন্য নতুন জীবন ও জীবিকার অন্বেষণ ও মানব স্থানান্তর শুরু হলে পরিবারের কাঠামোর পরিবর্তন শুরু হয়ে যায় ব্যাপকভাবে। উপমহাদেশে বৃটিশদের আগমনের পর বাঙালির স্থানান্তর ধারণা সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকা থেকে শুরু হয়। কয়লা খনি ও ভারী শিল্পে কাজ করার জন্য এসব এলাকা থেকে বৃটিশরা শ্রমিক সংগ্রহ শুরু করলে বহু মানুষ প্রবাস জীবনে চলে যায়।

এভাবে আমাদের শ্রম বিকিকিনি ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার মহোৎসব শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ইউরোপ আমেরিকায় আমাদের যাত্রা শুরু এবং আজকের নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রাচ্যের নানা দেশে চলে যাওয়া মানুষের মধ্যে গতি বয়ে আনে। পরবর্তীতে এর সাথে যুক্ত হয় শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থণাসহ আরো নানা কিছু। এভাবে অদ্যাবধি মানুষের বিদেশে চলে যাওয়া একটি পেশা ও কারো কারো মধ্যে একটি নেশার বিষয়ে পরিগণিত হয়েছে।

আর হবেই না বা কেন? বাংলাদেশের মত একটি ক্ষুদ্র ও জনবহুল দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ এখন প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো কষ্টার্জিত রেমিটেন্সের উপর সর্বাংশে নির্ভরশীল। দেশে ভাল কর্মসংস্থান না থাকায় আমাদের তরুণরা জীবন বাজি রেখে দেশের সহায়-সম্বল বিক্রি করে হলেও বিদেশে চলে যেতে চায়। এভাবে বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশী মানুষ বিদেশে ঠাঁই নিয়েছে। দেশের উচ্চশিক্ষিত, সরকারী বড় চাকুরীজীবীরাও দেশের মায়া ত্যাগ করে সব ছেড়ে দিয়ে সোনার হরিণের আশায় পরিবার নিয়ে চলে যান বিদেশে। যেখানে অনেকের সম্মানজনক কোন চাকুরী নেই। এখনও ডিভি লটারি অথবা গভীর সমুদ্রপথ, গহীন বন ইত্যাদি পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমান অনেকে।

ইউএনডিপির এক তথ্যমতে বাংলাদেশের আঠারো কোটি জনগোষ্ঠীর দুই কোটিরও অধিক বৈধ অথবা বিদেশে বসবাস করেন। ষোল কোটি থাকেন দেশে। এছাড়া আমাদের রয়েছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। যার মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার হাজার নারী ও পুরুষ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি দেন। তাদের মধ্যে বিবাহিতরা প্রায় সবাই প্রাথমিকভাবে সুখের পরিবার ছেড়ে বিদেশে চলে যান। কেউ কেউ কোনসময়েই আর পরিবারকে নিয়ে যেতে পারেন না। সুখের আশায় টাকা পাঠান তারা নিজ আপনজনদেরকে। কিন্তু বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে অনেকের উদাসীনতা, অবহেলা ও অনাদরে ভেঙে যায় দেশে ফেলে রেখে যাওয়া অগণিত সুখের পরিবার। যার কোন পরিসংখ্যান জানা নেই কারুরই।

পারিবারিক ভাঙন সুখকর নয়। দরিদ্র প্রবাসী শ্রমিক ছাড়াও আমাদের দেশে উচ্চবিত্ত পরিবারে বিচ্ছিন্ন থাকার প্রবণতা আরো বেশি লক্ষ্যণীয়। কয়েক বছর পূর্বে আমার মেয়েকে ভর্তি পরীক্ষা দেবার জন্য গিয়েছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার এক বন্ধু যার সঙ্গে জাপানে দীর্ঘদিন থেকেছি। তিনি সেখানে পড়ান। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, পরীক্ষার আগে তাঁর বাসায় মেয়েকে নিয়ে চলে আসতে। তিনি উত্তরায় থাকেন। ভাবী ও বাচ্চাদের কথা জিজ্ঞেস করায় যখন জানতে পেরেছিলাম পরিবারের ওরা সবাই কানাডা প্রবাসী। তিনি একাই ঢাকার উত্তরায় একটি ফ্লাটে থাকেন। একথা জানার পর তাঁর বাসায় আর যাওয়া হয়নি।

তবে তাঁর সাথে দুপুরে লাঞ্চের সময় তার চেম্বারে দেখা হয়েছিল। তিনি আমাদের জন্য বিরতির সময় খাবারের প্যাকেট কিনে এনেছিলেন। সেসময় সেখানে বেশ ক’জন প্রফেসরের সংগে কথা হয়েছিল। জেনেছিলাম তাদের প্রায় অর্ধেকেরই পরিবার বিদেশে। নিজ দেশে তারা সবাই পরিবার সন্তান-সন্ততি ছাড়া একা একা ফাঁকা বাড়িতে কালাতিপাত করছেন! ক’দিন পূর্বে স্বনামধন্য কলামিস্ট প্রফেসর মরহুম রহমানের একা উত্তরার বাসায় থেকে নির্জনে মৃত্যুবরণের কথা জানতে পেরে মনটা বিষাদে ভরে গিয়েছিল। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি দান করুন।

এভাবে শুধু জাহাঙ্গীরনগরেরই নন, দেশের বহু প্রতিষ্ঠানের নামজাদা লোকের পরিবার বিদেশে আছেন অথচ তারা দেশে একা একা অসহায় জীবন যাপন করে চলেছেন। সেই ২০০২ সালে একবার যুক্তরাষ্ট্রে ও ২০০৬ সালে টরেন্টোতে কনফারেন্সে গিয়ে আত্মীয়ের সাথে কয়েকদিন ঘুরেছি অনকেগুলো বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়। তখনই অনুভব করেছিলাম কি পরিমান বাংলাদেশী পুরুষ অভিভাবকহীন পরিবার সেখানে সন্তানদের শিক্ষা ও নানা কারনে কালাতিপাত করছেন। আমাদের অনেকেই তাদের দ্বিতীয়, তৃতীয় ঠিকানা তৈরী করেছেন বিভিন্ন দেশে বহু আগে থেকেই।

তবে এটা কোন জীবন হলো? দেশে শূন্য বাড়িতে একা পড়ে থাকা কেন? এটা তো মানব জীবনের জন্য বড় অমানবিক ব্যাপার। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ নবজাতক ও শিশুদের চেয়েও অসহায় হয়ে পড়ে। এসময় উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস থাকায় রোগ-শোক বেশি হয়, থাকে না কোন নিরাপত্তা। নিজে হাত দিয়ে ভাল খাবার তুলে খাওয়া দুরে থাক এসময় অনেকে ওষুধের নামটাও পড়তে পারেন না। একগ্লাস পানিও নিজে ঢেলে খাবার শক্তি রাখেন না।

বৃদ্ধ বয়সে এই ধরণের নিরাপত্তাহীনতা বেশি হওয়ায় অনেকে ভেঙে পড়েন। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে আগলে রাখে। তাই পরিবার বা আপনজন ছাড়া কাউকে একা একা একটি বাসায় বাস করার কথা ভাবা উচিত নয়। হ্যাঁ, যাদের একবারেই কেউ নই তাদের জন্য আধুনিক বৃদ্ধনিবাসের কথা ভাবা যেতে পারে। তবে কেউ পরিবারের মধ্যে কলহ করে অথবা অভিমান করে বৃদ্ধ নিবাসে থাকাটা সুখকর নয়- এটা যৌক্তিক সমাধান নয়। পরিবারের কলহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ পরিবারের মধ্যেই পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে মিটমাট করে ফেলা উচিত। সেটা নিজেকে অনেকটা বিষয় ছাড় দিয়ে করতে হলেও করতে হবে। সন্তানদেরকে ছোটকাল থেকে ভালমানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যারা একবারেই সেটা করতে পারবেন না তার জন্যই শুধু আধুনিক বৃদ্ধনিবাসের থাকার কথা ভাবা যায়।

কারণ, আপনজন ছেড়ে দূরে দূরে থাকা মানে দুকূলে অশান্তি। মৃত্যু তখন আরো শীতল হয়, আরো কাছে আসে। অভিমান করে কারো বহুদূরে নির্জনে কোথাও মহাবিপদ বা মৃত্যু হলে তখন আপনজন ছাড়া আর কে এগিয়ে আসে? ভাবতে হবে আপন সবসময়ই আপনজন।

অসুস্থতার সময় মাকে মা বলে ডাক দিয়ে করুণ আর্তি জানালেও সবার ভাগ্যে কি মায়ের মধুর সেবা জোটে? সবার বৃদ্ধ বয়সে সবার মা সচল বা জীবিত পাবার ভাগ্য কি সবার কপালে থাকে না। তাই সুযোগ থাকলে সবাই মিলেমিশে পরিবারে থাকি ও ভাল থাকার চেষ্টা করি। একটু চেষ্টা করলে পরিবার সবার জন্য শান্তির ঠিকানা হতে পারে।

সকল সন্তানদের উচিত তাদের বৃদ্ধ বাবা মায়ের প্রতি সবসময় বিশেষ খেয়াল রাখা। উৎসবের দিনগুলোতে তাদের খবর রাখা। বিশেষ করে জীবন-জীবিকার তাগিদে বৃদ্ধ বাবা মাকে একা ফেলে নিজেরা বিদেশে গিয়ে অথবা দেশে আলাদা থেকে আরাম আয়েসে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমোদে মেতে না থাকা। এজন্য আমরা সচেষ্ট হই এবং বৃদ্ধ অসহায় বাবা-মা সহ পরিবারের সবার মতামতকে শ্রদ্ধা করতে শিখি, পরস্পরের প্রতি আরো বেশি উদার ও মানবিক হই।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

এইচআর/এমকেএইচ