কৃষকের স্বপ্ন যেন নষ্ট না হয়!
রাজন ভট্টাচার্য
দেশে হাওর অধ্যুষিত জেলা সাতটি। এখনও এসব জেলার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। এর মধ্যে ধানই প্রধান। বিশেষ করে সিলেটের চার জেলায় বছরে একটি মাত্র ফসল। বোরো ধান লাগানো শেষে চৈত্র মাস থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত কৃষকদের মধ্যে ভয় কাজ করে। শেষ পর্যন্ত ধান ঘরে তোলা যাবে কিনা। যে কোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভাটির মানুষের স্বপ্নই কেবল নষ্ট করে করে না অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। অকাল বন্যা, ঝড় কিংবা শিলাবৃষ্টিতে একবার ফসল নষ্ট হলে বাড়ি বাড়ি অভাব স্পষ্ট হয়। সুনসান হয়ে যায় কোলাহলমুখর গ্রাম। যেন শোকে বাকরুদ্ধ সবাই...। এর বিরূপ প্রভাব থাকে কয়েক বছর।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলেই বেশি ফসল নষ্ট হয়। সেখানে সন্ধ্যায় সবকিছু স্বাভাবিক, সকালে চারদিকে থৈ থৈ পানি। একেবারে ম্যাজিকের মতো। চোখের সামনে সবকিছু তলিয়ে যায় পানির নিচে। বাকরুদ্ধ হন কৃষক আর অসহায় মানুষগুলো। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সর্বনাশ ঠেকাতে কিছুই করার থাকে না। বাঁধই কেবল এসব এলাকার সহজ সরল মানুষের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে পারে। রক্ষা করতে পারে হাওরের ফসল।
প্রতি বছর বর্ষার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে বোরো আবাদে নামেন। ফসল উৎপাদনে অনেক কৃষক ধার দেনা করেন। কেউবা উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ভালো ফসলের আশায় রাতদিন পড়ে থাকেন মাঠে। প্রায় ছয় মাস- জমি ঘিরেই কৃষকের সব চিন্তা, স্বপ্ন। ফলন ভালো হবে। সংসারের সব অভাব ঘুচবে ...। মোটা চাল আর ভাতে বছরজুড়ে প্রশান্তির হাঁসি হাসবে ছেলেমেয়েরা। নতুন ধানের ম ম গন্ধে ভরে উঠবে পাড়া-গাঁ। পিঠা আর পুলিতে কৃষাণিরা নবান্ন উৎসব করবেন। ছোট ছোট বাজারে চায়ের স্টলগুলোতে বসবে জমপেশ আড্ডা আর পান খাওয়ার ধুম। খুশিতে মহল্লায় মহল্লায় চলবে ধামাইল...এরকম কত চিন্তা আর কল্পনার কথা নাড়া দিয়ে যায় রাতদিন। এটা খুবই স্বাভাবিক।
বর্ষায় হাওরের মানুষের ছয় মাস কোনো কাজ থাকে না। এসময় কৃষকরা উৎপাদিত ফসল দিয়েই চলেন। যদি ফসল নষ্ট হয়, এ কষ্ট কৃষকের একার হয় না। ঘরে ঘরে মিলে কষ্টের ছাপ। গবাদিপশু লালন পালনও দুরূহ হয়ে যায়। ফসল নষ্টের খবরে খড়ের দাম বেড়ে যায় অনেক বেশি। খড় জোগাতে না পেড়ে পানির দামে গরু বিক্রি করেন কৃষকরা।
সম্প্রতি হাওরাঞ্চলের বেশকিছু হতাশার খবর চোখে পড়েছে, যা কৃষকের হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠার আগেই সচেতন সবাইকে যেমন আতঙ্কিত করেছে তেমনি হৃদকম্পন বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক বেশি। ২০১৭ সালে ফসলডুবির পর হাওরের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক বেশি আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। তারপরও এমন খবর সত্যিই হাতাশার ও বিস্ময়ের। এমনিতেই হাওর এলাকায় প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পর একবার ফসল নষ্ট হয়। এজন্য অবশ্য কৃষকরা মানসিকভাবে প্রস্তুতও থাকেন। তবে সময় বদলেছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি আর হাওর রক্ষা প্রকল্প কৃষকের মনোবল-সাহস আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জের ৫২টি বড় হাওরের ফসল অকাল বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য এবার ৮১১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসির) মাধ্যমে ৮১১টি বাঁধের কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে ১৩০টির মতো বড় ভাঙন রয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার কথা ছিল। ২৮ ফেব্রয়ারির মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় ৭ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। তাতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাঙনে কাজ শেষ হয়নি। কোথাও কোথাও সদ্য বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে। ফলে হাওররক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে ক্ষোভ ও বিরক্ত সুনামগঞ্জের কৃষকরা।
২০১৭ সালে অনিয়ম লুটপাটের জন্য হাওরের ফসল তলিয়ে গিয়েছিল পরে সেই লুটপাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। তাতে ফসল ফিরে না পাওয়া গেলে কৃষকদের সম্পৃক্ত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য নতুন নীতিমালা চালু হয়েছিল, সেটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু অসৎ সরকারি কর্মকর্তা-রাজনীতিবিদ ও বাঁধ ব্যবসায়ীর জন্য এই প্রক্রিয়া সমালোচিত হচ্ছে বলে খবরে উল্লেখ রয়েছে।
খবরে আরো বলা হয়, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, বাঁধের ওপর সামান্য মাটি দিয়ে বড় অঙ্কের বিল উত্তোলন, আবার কোথাও কোথাও বাঁধ নির্মাণ না করে পানির জন্য অপেক্ষা করার মতো দুর্নীতি এখন হাওরজুড়ে। কৃষকদের সম্পৃক্ত না করে বাঁধের কাজের দায়িত্ব অন্যদের দেয়া, আবার কোথাও কোথাও কাগজে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে কৃষকের নাম দিয়ে বাঁধের ব্যবসা করছে একই শ্রেণির লোকজন। এ কারণে হাওর রক্ষা বাঁধ এখন কৃষকদের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা ও নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার বড় হাওর কালিয়াকোঠার ফসল রক্ষার জন্য হাওয়ার খালের বড় ভাঙনে ৪ মার্চ পর্যন্ত কাজ হয়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ।
শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলামিন চৌধুরী বলেন, এক হাজার মাটি দিয়ে বাঁধ করা যাবে না কোনোটিই। বলা যায়, কিছু বাঁধে অতিরিক্ত মাটি ধরে প্রাক্কলন হয়েছে, কোনটাতে প্রয়োজনের চেয়ে কম মাটি ধরে প্রাক্কলন হয়েছে। জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সব কটি বাঁধের প্রাক্কলন আবার যাচাইয়ের জন্য নিয়েছেন। উপজেলার হাওয়ার খালের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ভাঙনে যে কাজ কম হয়েছে, এর ছবি তুলে আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে পাঠিয়েছি, আমি বলেছি এভাবে বাঁধের কাজ চললে হাওরের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
খবরে বলা হয়, কেবল শাল্লা উপজেলায় এমন চিত্র নয়। সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-অবহেলা এবং লুটপাটে ক্ষুব্ধ কৃষকরা। বাঁধের অনিয়মের আলোচনা ধর্মপাশা, দোয়ারা বাজার, দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় বেশি। হাওর প্রকল্প নিয়ে এত অনিয়ম হওয়ায় জেলাজুড়েই সমালোচনা চলছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে এখনও নয়ছয় চলছে। রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন অব্যাহত। চলছে প্রভাবশালীদের দাপট। সরকারি পর্যায়ের দুর্নীতি থামেনি। দায়সারাভাবে বাঁধের কাজ শেষ করারও পাঁয়তারা যথেষ্ট। এতে স্পষ্ট হয় কৃষি, অর্থনীতি ও কৃষকদের রক্ষায় এখন পর্যন্ত হাওর অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে চলমান প্রকল্পগুলোতে সরকারের নজরদারি একেবারেই কম। এটা সুখবর কোনো সংবাদ হতে পারে না। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মিলে দেশের মূল হাওরাঞ্চল।
এসব জেলার ফসল নষ্ট হওয়া মানেই এলাকার অর্থনীতিতে একটা বড় রকমের আঘাত, যা পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে আরো পেছেনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। অন্তত ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে যেন আর কোনো নয়ছয় না হয়। দ্রুত সব বাঁধের কাজ শেষ করা হোক। বাঁধ নির্মাণে হাওর এলাকা থেকে দুর্নীতির কালো ছায়া সরে যাক। স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ভাবে বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাক ভাটি বাংলার মানুষের স্বপ্ন।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/এমকেএইচ