ইসলামে মেরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, রাহমাতুল্লিল আলামিন, বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য লাভ করে পবিত্র মেরাজের মাধ্যমে। তাই মেরাজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
মহানবির (সা.) মেরাজ নিয়ে উম্মতে মুহাম্মদিয়ার মাঝে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। কেউ মনে করেন বিশ্বনবির (সা.) মেরাজ বোরাকযোগে মসজিদুল হারাম, বাইতুল্লাহ থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা সশরীরে ভ্রমণ করে সেখান থেকে ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য অর্জন এবং তার সঙ্গে বাক্যালাপ করেছেন।
অপর একশ্রেণির বিশ্বাস, এ ঘটনা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবির (সা.) এই সফর দৈহিক ছিল না আধ্যাত্মিক? এ বিষয়ে আমাদের কুরআন খুলে দেখতে হবে যে, এতে কি উল্লেখ রয়েছে।
এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, ‘তিনি পরম পবিত্র ও মহিমায়, যিনি রাত্রিযোগে আপন বান্দাকে মসজিদুল হারাম (সম্মানিত মসজিদ) থেকে মসজিদুল আকসা (দূরবর্তী মসজিদ) পর্যন্ত নিয়ে গেলেন, যার চারদিকে আমি বরকত মন্ডিত করেছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’
এ আয়াতে মহানবির (সা.) এক কাশফ বা দিব্য দর্শন, যা রাত্রিকালীন সফর সম্পর্কে ব্যক্ত হয়েছে, যা অধিকাংশ তফসিরকারকের মতে মেরাজ আধ্যাত্মিক স্বর্গারোহণ বলে পরিচিত।
এখানে মক্কা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত মহানবির (সা.) ইসরা (রাত্রিতে ভ্রমণ) আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, এটি মহানবির (সা.) নবুয়তের একাদশ বছরে সংঘটিত হয়েছিল আর কোনো কোনো খ্রিস্টান লেখকের মতে তা নবুয়তের দশম বছরে ঘটেছে। ইবনে সা’আদ এবং মারদাওয়াইয়ের মতে, হিজরতের এক বছর আগে রবিউল আউয়াল মাসের ১৭ তারিখ এ ঘটনা ঘটেছে (আল খাসাইসুল কুবরা)। বায়হাকিও বর্ণনা করেছেন এটি হিজরতের এক বছর বা ছয় মাস আগে সংঘটিত হয়েছিল।
বিভিন্ন বর্ণনা মতে, এটাই স্পষ্ট হয় নবুয়তের দ্বাদশ বছরে হিজরতের এক বছর বা ছয় মাস আগে ইসরার ঘটনা ঘটেছিল। হজরত খাদিজার (রা.) মৃত্যুর পর হজরত মহানবি (সা.) তখন তার চাচাতো বোন হজরত উম্মে হানির (রা.) ঘরে বসবাস করতেন। কিন্তু অধিকাংশ পন্ডিতের মতে, মেরাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়তের পঞ্চম বছরে।
এতে দেখা যাচ্ছে, এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময়ের মধ্যেও ৬-৭ বছরের ব্যবধান রয়েছে। কাজেই মেরাজ ও ইসরা এ ঘটনা দুটি ভিন্ন ভিন্ন, একটি অন্যটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এছাড়া ওই সব ঘটনা যা মহানবির (সা.) মেরাজের ঘটনা বলে হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে তা ইসরার ঘটনাবলি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।
মেরাজ ও ইসরা মূলত দুটি পৃথক বিষয়। পবিত্র কুরআনের সুরা আন নাজমে মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মেরাজ সম্বন্ধে বর্ণনা দেয়া হয়েছে কিন্তু ইসরা সম্পর্কে কোনো পরোক্ষ আয়াত পর্যন্ত নেই। ইসরা সংঘটিত হওয়ার রাতে মহানবি (সা.) তার চাচাতো বোন উম্মে হানীর (রা.) ঘরে ছিলেন এবং তাকে তিনি (সা.) শুধু তার জেরুজালেম সফরের কথাই বলেছেন, জান্নাত সফরের কোনো কথাই বলেননি।
তিনি (সা.) যদি হজরত উম্মে হানীকে (রা.) কিছু বলতেন তাহলে তিনি (রা.) তার একাধিক বর্ণনার কোনো একটিতে অন্তত এ বিষয়ে উল্লেখ না করে পারতেন না। কিন্তু তিনি (রা.) তার কোনো বর্ণনায় এ কথা উল্লেখ না করায় এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় মহানবি (সা.) যে রাত্রিতে জেরুজালেমে আধ্যাত্মিক সফর করেছিলেন সে রাত্রিতে মেরাজ সংঘটিত হয়নি।
সুরা নাজম ও সুরা বনিইসরাইল থেকে যা জানা যায়, তাহল মহানবির (সা.) ইসরা নামক একটি আধ্যাত্মিক সফর হয়েছে আর মেরাজ নামে আরেকটি আধ্যাত্মিক সফর হয়েছে। মহানবির (সা.) পবিত্র জীবনে মেরাজ শুধু একবারই যে ঘটেছে তাও ঠিক নয়, কারণ ছিনাচাকের যে ঘটনা তা তার শৈশবেই ঘটেছিল, যখন তিনি (সা.) ছাগল চড়াচ্ছিলেন। বিষয়টা স্পষ্ট যে, মেরাজ কোন এক ঘটনার নাম নয়।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে মহানবির (সা.) মেরাজ অনেকবারই হয়েছে। এছাড়া মহানবি (সা.) এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, মুমিনের মেরাজ হয় নামাজের মাধ্যমে। অর্থাৎ মুমিন মুত্তাকিরাও আল্লাহ তাআলার সাক্ষাৎ লাভ করতে পারেন নামাজের মাধ্যমে। এ রাস্তা এখনও খোলা আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত খোলা থাকবে।
মহানবির (সা.) মেরাজকে যারা আধ্যাত্মিক বলে মনে করেন তারা পবিত্র কুরআনের সুরা বনি ইসরাইলের নিম্নে আয়াত উপস্থাপন করেন। মক্কার মুশরিকরা যখন মহানবির (সা.) কাছে দাবি উত্থাপন করে বললেন, তুমি যদি সত্য নবী হয়ে থাক তাহলে আমাদের জন্য ভূমি থেকে প্রস্রবণ প্রবাহিত কর অথবা খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি করো, আর আমাদের ওপর আকাশ টুকরা টুকরা করে ফেল অথবা আল্লাহ এবং ফেরেশতাদের আমাদের সামনাসামনি নিয়ে আসবেন। অথবা তোমার জন্য স্বর্ণ নির্মিত কোনো ঘর হয় অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করো এবং আমরা তোমার আকাশ আরোহণ কখনো বিশ্বাস করব না যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি আমাদের ওপর কোনো কিতাব নাজেল কর, যা আমরা পাঠ করতে পারি। কাফেরদের এসব আপত্তির উত্তরে আল্লাহ তাআলা মহানবিকে (সা.) বলেছিলেন, তুমি বল আমার প্রতিপালক পবিত্র, আমি কেবল একজন মানব রসুল। (সুরা বনিইসরাইল: আয়াত ৯০-৯৩)।
একটু ভেবে দেখুন! তাদের যা দাবি ছিল তা মানবীয় শক্তির অসাধ্য এবং আল্লাহ তাআলার নবি প্রেরণের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করতে পারেন। হ্যাঁ, আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করতে পারেন, কথাটা একান্তই সত্য কিন্তু আল্লাহ তার বিধানের বাইরে কিছুই করেন না। আল্লাহর বিধানে এটা নেই যে, কোনো রক্ত-মাংসের মানুষকে তিনি সশরীরে আকাশে উঠিয়ে নিয়ে যাবেন। যেটা আল্লাহর বিধান পরিপন্থী কাজ তা তিনি কীভাবে করতে পারেন?
এছাড়া সুরা বনি ইসরাইলের ৯৩ আয়াতে মহানবির (সা.) দৈহিকভাবে ঊর্ধ্ব আকাশে গমন অসম্ভব বলে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে এটি একজন মানব রাসুলের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে কীভাবে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে, মহানবির (সা.) মেরাজ দৈহিকভাবে হয়েছিল? আর মেরাজের ঘটনা যদি দৈহিকভাবেই ঘটে থাকত তাহলে কাফেররা মহানবিকে (সা.) অবশ্যই বলত, তুমি না সশরীরে সব আকাশ ঘুরে এসেছ, এখন তাহলে কেন বলছ এটা মানব রাসুলের পক্ষে সম্ভব না?
মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায় হচ্ছে, সে তার প্রভুর ওপর পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট এবং তার প্রভুও তার প্রতি সন্তুষ্ট আর এই পর্যায়ে যখন মুমিনের আত্মা উপনীত হয়, তখনই আল্লাহপাক তাকে মেরাজের মর্যাদায় ভূষিত করেন।
আল্লাহ তাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি, হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠনবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন।
এইচআর/জিকেএস