কিডনি রোগ নিয়ে ভালো থাকা
‘বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২১’ এর প্রতিপাদ্য হলো ‘Living Well with Kidney Disease’ অর্থাৎ ‘কিডনি রোগ নিয়ে ভালো থাকা’। কিডনি রোগী হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় এটাই এবারের মূল প্রতিপাদ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৫ সালে সারাবিশ্বে পাঁচ কোটি মৃত্যুর মধ্যে তিন কোটি মৃত্যু কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। একবার কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলে তার চিকিৎসাব্যয় এতবেশি যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশের ১০ ভাগ কিডনি বিকল রোগী দীর্ঘমেয়াদি এই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না। বাকি ৯০ ভাগ রোগী অর্ধচিকিৎসা বা বিনাচিকিৎসায় মারা যায়। অনেক পরিবার বসতভিটা বিক্রি করে সহায়সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়।
আবার অন্যদিকে অর্থ খরচ করেও অনেক রোগী রোগ ও তার চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য, তার পছন্দ অনুযায়ী বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণে চিকিৎসকের সাথে খোলামেলা আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে না।
এটা ঠিক যে যারা একবার কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়, তারা আতঙ্কিত হয়ে যায়। ভয় পেয়ে যায় কারণ একবার আক্রান্ত হলে তার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ, এই জন্য যে সময়মতো চিকিৎসা না পেলে আস্তে আস্তে রোগটি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং পাঁচটি পৃথক ধাপ অতিক্রম করে তা রোগীকে একটি জটিল পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। কেউ যদি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভোগেন তার শেষ পরিণতি হবে কিডনি বিকল, আর কিডনি বিকল হলে তার বেঁচে থাকার উপায় মাত্র দুটি। এক কিডনি সংযোজন, অন্যটি ডায়ালাইসিস। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে চিকিৎসার এই দুটি পদ্ধতিই অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে রোগীকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করেই চিকিৎসা করাতে হয়। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক কষ্টের কারণে তারা সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারে না। নিজের উপার্জনের পথগুলো সচল রাখতে পারে না। একসময় তারা ঘরে বসে যায়। অর্থব্যয়ের অক্ষমতা, সঠিকজ্ঞানের অভাব সবকিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে, ফলে ডাক্তার যে ধরনের ব্যবস্থাপত্র দেন সেটাই তাকে মেনে নিতে হয়। এতে সে তার নিজস্ব পছন্দ, মতামতের প্রয়োগ, এমন কিছুই করতে পারেন না। এর ফলে একতরফাভাবে তার ওপর দেয়া চিকিৎসকের মতামত মেনে নিতে হয়।
এ বছরের বিশ্ব কিডনি দিবসের বার্তায় বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে, কেউ যদি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে যায় তখন কিডনি রোগ সম্পর্কে তার সংশয় এবং ভীতি দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। রোগটি সম্পর্কে তাকে পুরোপুরি ধারণা দিতে হবে। যখন রোগী তার রোগ, কারণ, পরিণতি ও বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হবে, তখন সে তার পছন্দ অনুযায়ী বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণে চিকিৎসকের সাথে মতবিনিময় করতে পারবে। তার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে তার জন্য উত্তম এবং সঠিক চিকিৎসার পথটি বেছে নিতে পারবে। এ জন্য কিডনি রোগী, তার পরিবারের সদস্য, তার যত্নকারী, বন্ধুবান্ধব, সকলকেই এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
অনেকের জ্ঞান আছে কিন্তু তার আর্থিক সক্ষমতা নেই। আমরা জানি উন্নত দেশগুলোতে চিকিৎসাবীমার সুবিধা আছে। বীমাকৃত নাগরিকদের জটিল রোগসমূহের চিকিৎসা সার্বিক দায়িত্ব সরকারের তত্ত্বাবধানে বীমাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে থাকে। ফলে রোগীকে তার চিকিৎসার জন্য আর্থিক বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হয় না। আমাদের মতো দেশে এখনও গরিব মানুষ অর্থাভাবে চিকিৎসা নিতে অক্ষম, অন্যদিকে অনেকে আবার ব্যয়বহুল কিডনি চিকিৎসা চালাতে গিয়ে একপর্যায়ে নিঃস্ব হয়ে যায়।
সে জন্যই এ বছরের বিশ্ব কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্যের বার্তাটি হচ্ছে যে, ধনী-গরিব সকল কিডনি রোগীর চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। আর এই কাজটি কে করবে? সরকার ও নীতিনির্ধারকদের, এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এই সমস্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা অবশ্যই স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।
চিকিৎসক, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন রোগীদের সচেতন করার জন্য এগিয়ে আসতে পারে। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া- এই সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে। এভাবে সকলকে যদি সচেতন ও প্রশিক্ষিত করে তোলা যায় তবে রোগীরা চিকিৎসকের সাথে আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত পথটি বেছে নিতে পারবেন।
স্বাস্থ্যবীমা অথবা আথির্ক সহায়তা দিয়ে যদি সকল রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়, তবে হতাশা কেটে যাবে ও তাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস জন্ম নেবে। যা নিয়ে সে পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিকসহ সব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকতে পারবে। চাকরিজীবী রোগী তার চাকরি চালিয়ে যেতে পারবে, ব্যবসায়ী ব্যবসায়িক কাজ করতে পারবে। এভাবেই একজন কিডনি রোগী তখন অসহায় ঘরবন্দি না থেকে অন্য দশটা মানুষের মতো সমস্ত পারিবারিক সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশীদার হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস); অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কিডনি রোগ বিভাগ আনোয়ান খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
এইচআর/বিএ/এএসএম